Skip to main content

এই যে মাঝে মাঝেই বলতে শুনি, ও এসব বোঝে না, ওকে যা দাও ও খেয়ে নেবে, সে তোমার রান্নায় নুন হোক না হোক, সিদ্ধ হোক না হোক, মিষ্টি হোক না হোক... ও কিচ্ছু বলবে না, চুপ করে খেয়ে উঠে যাবে

ওকে তুমি যা দাও পরে নেবে। পুজোপার্বণ বলো, কি যে কোনো অনুষ্ঠান বলো, যা কিছু একটা পরে চলে যাবে, ওর ওসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই।

এই কথাগুলো যে বলে আর যাকে বলে তারা দুজনেই মনে মনে জানে কথাগুলো কতটা মিথ্যা। কতটা অতিরঞ্জিত। একটা কুকুরও বুঝতে পারে কোন খাবারটা তার রুচি অনুযায়ী আর কোন খাবারটা না। একটা মাকড়সাও জানে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে তার ভালো লাগে থাকতে। আর একটা মানুষ জানে না? তাও হয়!

আসলে এর মধ্যে একটা সুক্ষ্ম অভিনয় আছে। বা বলা যেতে পারে ডিফেন্স মেকানিজম। দেখেছি যে বাচ্চাটা বা যে মানুষটা কিছুটা অবহেলায় বড় হয় তাদের স্বভাবে এইদিকটা জন্মে যায়। সব সময় এমনও নয় যে বাবা বা মা নেই। এমন হয় যে মা বা বাবা হয় তো উদাসীন। অথবা আর্থিকভাবে অপারগ। তবে দেখেছি আর্থিক অপারগতা ততটা বড় কারণ হয় না, যতটা উদাসীনতা হয়। তখন সেই বাচ্চাটার মধ্যে এমন একটা ডিফেন্স মেকানিজম তৈরি হয়ে যায় সে নিজেকে এগুলো থেকে একটা ডিনায়াল মোডে নিয়ে চলে যায়। কিন্তু মনের গভীরে একটা পুঞ্জীভূত অভিমান থেকেই যায়।

আমার কথা এই অভিমানটা নিয়ে। সে মানুষটাকে একটু যত্ন করলে, একটু খেয়াল রাখলে তার চোখের কোল ভরে আসে এমন দেখেছি তো। ওরকম মিথ্যা কাউকে মহত্বের আসনে বসিয়ে কাজ গুছিয়ে নেওয়ার মানুষের অভাব নেই চারপাশে। বিশেষ করে খুব কাছের লোকদেরই বলতে শুনেছি, বাবা ওকে নিয়ে আমার কোনো ঝঞ্ঝাট নেই। আসলে স্পষ্ট করে কেউ সংসারে বলে না ওকে নিয়ে ঝঞ্ঝাট আমার পোষায় না। তাই সে কথাটাই এইভাবে ঘুরিয়ে বলা। আর এই মিথ্যার অভিনয়ে যদি সংসারে শান্তি থাকে তবে আর কি, তাই সেই মহৎ মানুষটিও নিজের মহত্বের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখে রাস্তাটা সুগম করার বৃথা চেষ্টায় কাল কাটিয়ে দেয়। কিন্তু কোনো মিথ্যার আয়ুই সংসারে বেশিদিনের তো নয়। তাই এই মিথ্যাও যেদিন হঠাৎ করে বে-আব্রু হয়ে পড়ে সেদিন ঝড় ঠেকানো দায় হয়। যে এতদিন মহত্বের প্রশংসা করে আসছিল সে সেই মহৎ ব্যক্তিকে হঠাৎ নীচ, কপট ইত্যাদি সোচ্চারে বলতে শুরু করে। আর যে সংসারে শান্তি রক্ষার জন্য এতদিন চুপ করেছিল, সে সমস্ত অভিমান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সমস্ত পৃথিবীর সব মানুষকে মতলবী স্বার্থপর ভাবতে শুরু করে। দুই পক্ষই ভুল করে। কিন্তু কোনো মিথ্যাকে দীর্ঘদিন লালন করার মূল্য তো দিতেই হবে।

আসলে মানুষ অনেক সময় থই পায় না তার গভীরে জমা দুঃখকে সে কিভাবে মোকাবিলা করবে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় উপেক্ষায় না অভিমানে? সে বুঝে উঠতে পারে না। শোক, দুঃখ গভীরে গভীরে তাকে কুরে কুরে খায়। শোক বা দুঃখকে যেহেতু সংসার খুব ভালো চোখে দেখে না, তাই তাকে মহৎ সেজে সুখী মানুষের অভিনয়ে জগতে নামতেই হয়। কিন্তু শোক ভিতরে ভিতরে পুঞ্জীভূত হতে থাকে। তার ঈশ্বরে বিশ্বাস, মানুষে বিশ্বাস ইত্যাদি সমস্ত বিশ্বাস করার ইচ্ছা বা আস্থা রাখার ক্ষমতাকে বিবশ করে দেয়। নিজের ভিতরে এক গভীর অন্ধকারে ডুবতে থাকে। কাকে বলবে? কার সঙ্গে কথা বলবে যে আমার শোক আমার দুঃখ আমায় নিঃস্ব করে দিচ্ছে ভিতরে ভিতরে। আমি অসংবেদনশীল, আত্মেকেন্দ্রিক, চতুর হয়ে উঠছি দিনে দিনে। আমি ঈশ্বরকে অবিশ্বাস করি কিন্তু ঈশ্বরের সামনে আমি কপট ভক্তের অভিনয় করে চলি। কারণ আমার যেন মনে হয় ঈশ্বর একজন চরম ক্ষমতাশালী নীতিহীন মানুষের মত। যে জগতটাকে তার ইচ্ছা মত এক্সপ্লয়েট করেই যাচ্ছে।

সে বলতে পারে না, আমার ঈশ্বর সম্বন্ধে এই নীচ ধারণা আমায় আরো নীচ করে তুলছে। আমি অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি। সবটা বুঝতে পারছি, কিন্তু নিজেকে আটকানোর ক্ষমতা আমার যেন নেই। এই সমস্ত শুরু হয় আমার গভীরে আমার নিজের দুঃখের আর শোকের প্রতি চূড়ান্ত দুর্বলতার জন্য। আমি ওদের ভালোবাসি যেন। কি ভীষণ অনৈতিক অমানবিক এটা, কিন্তু তবু এটাই আমি হয়ে উঠছি দিনে দিনে। আমি কপট, স্বার্থপর, চতুর আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছি। আর সবটাই হচ্ছে আমার গভীরে আমারই প্রশ্রয়ে লালিত আমার দুঃখনুরাগ, শোকের জন্য।

এ কথাগুলো বলার মানুষ নেই। আমাদের সমাজ এই ধরণের কথা বলার সুযোগ করে দেয় না। পাশ্চাত্য দেশে শুনেছি এরকম মানুষদের নিয়ে ছোটো ছোটো গ্রুপ তৈরি হয়। তারা নিজেদের মধ্যে দেখা করে। এক সঙ্গে আলোচনা করে। বুঝতে পারে এই বিশেষ সময়ে সে একা নয়। তার অনুভূতিগুলো অস্বাভাবিক নয়। সে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দেয়। সে হাত ধরার মানুষকেও পায়। বিপন্নতায় নিরাশ্রয় হয়ে পড়ে না সে।

আমাদের এখানে তাকে কপট মহৎ হতে হয়। নিজের ভিতরে জমা পুঞ্জীভূত অভিমান, দুঃখ, বিপন্নতার বোধকে চেপে চলত শিখতে হয়। সঙ্গে জন্মায় মহত্বের মোহ। আমাদের সমাজে আসলের থেকে নকলের দাম বেশি। সাচ্চার থেকে ভণ্ডামির আদর বেশি। এ আমার কথা না, কবীরের উপলব্ধি। তো সেই নকল মহত্বের লোভ চেপে বসলে আরো বিপদ। আর যেদিন থেকেই এই মহত্বের অভিনয় বন্ধ করা হবে সেদিন থেকেই আশপাশের মানুষদের শ্লেষাত্মক কথায় বেঁধা শুরু হবে। "ওর তো আজকাল খুব মুখ হয়েছে,... আজকাল কি কথা শিখেছে…. আজকাল খুব বুঝতে শিখেছে….".....

এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আশেপাশের নকল আত্মীয়-বন্ধু বিয়োগ বা বিরূপ হলেও খাঁটি বন্ধু আত্মীয়ের পরিচয়ও পাওয়া যাবে সঙ্গে সঙ্গে। যারা মুখোশের চিরস্থায়ীত্বের ভরসায় পাশে আসেনি, মুখোশটা খুলে ফেলার অপেক্ষাতেই যেন ছিল।

গভীরে দুঃখ থাকুক, শোক থাকুক, সে যেন আমার শিকড়ে প্রবেশ করে আমার প্রাণরস শোষণ না করে এ খেয়াল রাখাটা আমাদের কর্তব্য। আর মানবিকতা হল, আমার পাশের মানুষটাকে মহত্বের আড়ালে না ঢেকে তার অভিমান বা ডিফেন্স মেকানিজমটা ভেদ করে আসল মানুষটাকে খুঁজে নিয়ে, নিজের ভালোবাসায়, সহমর্মিতায় তাকে আসল মানুষ হতে সাহায্য করা। আমাদের জীবনটা মহাপুরুষ না হলেও চলে, কিন্তু দোষেগুণে ভরা মানুষকে পাশে না পেলে চলে না, এইটা বুঝতে হবে। তাই ঈশ্বর নিজের নির্ভুল ঈশ্বরত্বকে আড়ালে রেখে দোষেগুণে ভরা মানুষকেই পাশে রেখেছেন। রাস্তাটা ওর মধ্যে দিয়েই খুঁজে নিতে বলেছেন। নিখুঁত হওয়ার চেষ্টায় নয়, বরং সমস্ত খুঁতকে ভালোবাসায় ঢেকে নেওয়ার সাধনায়। একটা গান দিয়ে শেষ করি…..

 

নিবিড় ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রুবতারা।

মন রে মোর, পাথারে হোস নে দিশেহারা ॥

 

বিষাদে হয়ে ম্রিয়মাণ বন্ধ না করিয়ো গান,

সফল করি তোলো প্রাণ টুটিয়া মোহকারা।।

 

রাখিয়ো বল জীবনে, রাখিয়ো চির-আশা,

শোভন এই ভুবনে রাখিয়ো ভালোবাসা।

 

সংসারের সুখে দুখে চলিয়া যেয়ো হাসিমুখে,

ভরিয়া সদা রেখো বুকে তাঁহারি সুধাধারা ॥