Skip to main content

দূরদর্শনের বিভিন্ন চ্যানেলের বহু মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমে বাড়ির টিভির পর্দায় ভেসে আসছে পুরীর রথযাত্রার দৃশ্যাবলী। অজস্র মানুষের অসীম উৎসাহ, নৃত্য-গীত-কীর্তনে মুখরিত মন্দিরের সম্মুখস্থ বড়দাণ্ড বা মহৎপথ। ধারাবিবরণকারীদের বিভিন্ন ভাষায় ভক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যান।
     বারবার একটা শব্দ কানে এসে মনকে আপ্লুত করে যাচ্ছে – মহাপ্রভু। জগন্নাথজীর অপর নাম। প্রেমের ডাক। আস্থার ডাক। আশ্বাসের ডাক।
     বেলুড় মঠে একবার এক সাধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, 'আপনারা মঠে স্নানযাত্রা পালন করেন কেন? সে তো জগন্নাথজীর উৎসব।'
     সাধু প্রসন্ন হেসে বললেন, 'শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকে আমরা জগন্নাথ হিসাবে দেখি, তাই।'
     আজ রথযাত্রা দেখতে দেখতে সেই কথাটা মনে আসল। সাথে সাথেই ঠাকুরের একটা কথা মনে পড়ল, ‘এখানকার ভাব একঘেয়ে নয়।’
     ঠিক তাই। ভক্ত বলছেন, ‘আমি নাস্তিক মত পড়ছি’। ঠাকুর হেসে বললেন, 'সেও এক বিশ্বাস, এক মত।'
     সত্যিই তাই। যাঁর অস্তিত্ব স্বীকার করে মানুষ আস্তিক, যাঁর অস্তিত্ব অস্বীকার করে মানুষ নাস্তিক, তাঁকে প্রণাম জানাই।
     সংসারের মূল সুরই হল বৈচিত্র। কতরকম মত, কতরকম বিশ্বাস, কতরকম জীবনশৈলী। সেই বৈচিত্রতাকে নাশ করে সব কিছুকে একঘেয়ে করে তোলার কি মানে আছে? আমি তুমি রাম শ্যাম যদু মধু সব একরকম, তাও কি কখনো হয়। সব্বাইকে একমতে আনার মত বিধ্বংসী ইচ্ছা আর সংসারে দুটি নাই। রামকৃষ্ণদেবের তাই সাবধান বাণী, 'কারো ভাব নষ্ট করবিনি'। সানাইয়ের শুধু পোঁ ধরে থাকা তাঁর পোষায় না, তাই তিনি 'সা রে মা তে' আছেন, অর্থাৎ কি না বৈচিত্রে আছেন। সে তো না হয় হল, তা বলে অমন জটিল লোক তোমার সাথে কেন? ঠাকুরের উত্তর, আরে জটিলে-কুটিলে না থাকলে যে মায়ের খেলা পোষ্টাই হয় না। অর্থাৎ কিনা জমে না! নাও, সেই বৈচিত্রের কথা। বহুরূপী গিরগিটির কথা, ধোপার রঙের গামলার কথা ...ইত্যাদি ইত্যাদি। মোদ্দা কথা তাঁর ওই একঘেয়ে ভাব সয় না।
     তুমি কে, কোথা থেকে আসছ বড় কথা নয়। একটাই কথা, তুমি অকপট তো? তোমার যা খামতি সে আমার দায়িত্ব পূর্ণ করে নেওয়ার। তুমি শুধু দেখো, তোমাতে আমাতে যেন কোনো আড়াল না থাকে। সংশয় আছে? থাকবেই তো। তোমার সংশয় যত গভীর, আমার খেলা তত মধুর। তুমি শাক্ত, বৈষ্ণব, শৈব, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, মুসলমান যেই হও। তুমি মানুষ, তোমার অসীম ক্ষমতা। কেন জানো? ‘মানুষ কি কম গা? মানুষ অনন্তকে চিন্তা করতে পারে’।
     হ্যাঁ তুমি অনন্তকে চিন্তা করতে পারো। তুমি ঈশ্বরের ধারণাকে অস্বীকার করতে পারো। তাঁকে ব্যক্তিসত্ত্বা হিসাবে ভাবতে তোমার নাও ইচ্ছা করতে পারে, বিশ্বাস নাও হতে পারে। কিন্তু তুমি অনন্তকে অস্বীকার করতে পারো? পারো না। এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের সাপেক্ষে তোমার অস্তিত্বটাকে একবার খুঁজতে যাও... কি দেখলে? কিছু পেলে না। জানো সংসারে দেখেছি, ‘মা আর মেয়ে আলাদা করে জয়মঙ্গলবার করে, যেন মা আর মেয়ের মঙ্গল আলাদা।‘ মানুষের মঙ্গল আলাদা কিছুতে নয়। সে একে। মিলনে। দ্বেষহীনতায়। তাই বলেছি, ‘প্রার্থনা করো, পোকাটারও যেন নিন্দা না করি’।
      হীনবুদ্ধি হবে বলে কি জন্মেছ এত বড় বিশ্বে? না তো! বুদ্ধি - যাতে খাওয়া থাকার ব্যবস্থা হয়, তাই কি শুধু বুদ্ধি? এই যে সূর্য তারার কক্ষপথ মাপছ, জোয়ার ভাঁটার হিসব কষছ, এই কি তবে বুদ্ধির শ্রেষ্ঠ প্রকাশ? না গো। বুদ্ধির শ্রেষ্ঠ প্রকাশ প্রেম সাগরে ডুবে। যে বুদ্ধি প্রেমের দিকে না নিয়ে যায় সে তো শুষ্কপথ, শুষ্কবুদ্ধি। শুষ্ক হয়ো না। ‘একভাঁড় জল পুকুরে চুবিয়ে রাখলে ভিজে থাকে, বাইরে এনে ফেলে রাখলে শুকিয়ে যায়’। চুবিয়ে রাখো। মানুষের সাথে থাকো। ঘরে দোর দিয়ে আটকিয়ে কাকে ডাকবে? যে তিনি তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে গলদঘর্ম হয়ে মোট বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে তাঁকে না দেখতে পেলে কিসের যাগযজ্ঞ? ফেলে দে ওসব!

     ঠাকুরের কাছে সবচাইতে বড় আশ্বাস এই, তাঁর বাড়ির সামনে যে পথ সে বড়দাণ্ড। মহৎপথ। সে পথে যাওয়ার শর্ত একটাই, অকপট হও। রীতিনীতি'র তিনি খুব একটা ধার কোনোদিন ধারতেন না। ভাবগ্রাহী জনার্দন। কথাটা হল তোমার মনটা কোথায়? স্বার্থে? না পরমার্থে? তাঁর ঈশ্বরের প্রতিশব্দ - গড, আল্লাহ্‌, কালী, দূর্গা নন। প্রতিশব্দ হল, ‘চেতনা’। আশীর্বাদ, ‘তোমাদের চৈতন্য হোক’। কিসের চৈতন্য? নিজেকে অশ্রদ্ধা না করার। ‘যে শালা নিজেকে পাপী পাপী রাতদিন বলে, সে পাপীই হয়ে যায়।‘
     মানুষ ভুল করতেই পারে। করবেই। করেও। তাঁর তাতে আপত্তি নেই। ভুলকেই আঁকড়ে বাঁচাকে, ক্ষুদ্রতাকেই চরমার্থ বলে ধরলেই তিনি গর্জে উঠছেন ‘একি হীনবুদ্ধি গা!’
     হ্যাঁ তাই তাঁকে জগন্নাথের প্রতিভূ বলতেই পারি। কারণ তিনি তাঁর কাছে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান নি, অধিকারটা মনে করিয়ে দিয়েছেন। ‘ঈশ্বর কি তোমার পর?’
     তিনি অনন্তভাবময়। কথাও শেষ হওয়ার নয়, অগত্যা বিরাম নিই। জয় প্রভু।