Skip to main content

কল্যাণী মেডিক্যাল কলেজে যখন রুগীকে নিয়ে যাওয়া হল, তখন তিনি অচৈতন্য। সেরিব্রাল অ্যাটাক। বয়েস ৪৬। প্রাথমিক কিছু পরীক্ষার পর চিকিৎসক বললেন, “এখানে কোনো নিউরোর ডাক্তার নেই, আপনারা কলকাতায় নিয়ে যান, নইলে ওনার যা অবস্থা উনি বাঁচবেন না।" বাঁচলেনও না। কলকাতায় যাওয়ার যাত্রা শুরু হতে না হতেই জীবনযাত্রার অন্তিম অধ্যায় অ্যাম্বুলেন্সেই সমাধা হল।
        ক্ষোভ, শোক, যন্ত্রণা যাই থাক, মফঃস্বলে এ খুব ব্যতিক্রমী ঘটনা না। কাঁচরাপাড়ায় রেলের যে হাস্পাতাল তারও একই অবস্থা। ব্যবস্থা আছে, বাইরে সুপারস্পেশালিটি লেখাও আছে, কিন্তু বিন্দুমাত্র জটিলতা আসলেই বি আর সিং ছুটতে হবেই। আমার এক কনিষ্ঠ বন্ধু, সে একটা জেলার মেডিক্যাল কলেজে দীর্ঘদিন কাজ করার কি সব অভিজ্ঞতার ইস্তাহার শুনিয়েছে। একজন মানুষের কাছে অতিমানবিক দাবীর নামান্তর এক কথায়। সব দায় কি তবে সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকা যায়? পরিবর্তন হয় তাতে?
        হয় না। যে কোনো তন্ত্রের মূলে যে কথাটা থাকে তা হল - মানুষ আর তার পরের শব্দ - মানসিকতা। যে মানসিকতা যুগের সাথে সাথে চরিত্র অভিধা পায়। জাতীয় চরিত্র। তার স্থবিরতার দিক আছে আবার গতিময়তার দিকও আছে। প্রথমটায় নিজের চেষ্টা আর পরেরটা ভাগ্যের হাতে ছেড়ে রাখলে যা হয় - আমাদের ইতিহাস তার জ্বলন্ত সাক্ষ্য। আমরা আমাদের ধর্ম-সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে আর্যরক্তের শুদ্ধতা বজায় রাখার প্রাণপণে চেষ্টা করব, কারণ মহাপুরুষ বলিয়াছেন - 'যেদিন ভারতবর্ষ ধ্বংস হইবে, সেদিন সারা পৃথিবীর শুদ্ধভাবগুলি ধ্বংস হইয়া যাইবে'। অগত্যা জগতের এতবড় স্থবিরতার সাধনের ডাককে আমরা উপেক্ষা কেমন করে করব? আমরা নিজেরা নড়ব না, ভাগ্যের কল আমাদের যেদিকে নিয়ে যায় সেদিকেই যাব। দায় তবে ভাগ্যের হবে। তাই হয়েও আসছে। অর্জন করার চাইতে ভিক্ষার উপর টানটা আমাদের বেশি। উদাহরণ?
        বেশ কয়েক বছর ধরে কলকাতা আর শহরতলী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে বছরের এই নির্দিষ্ট সময়টাতে। সবাই জানি এ রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা প্রাণঘাতীও বটে। আমরা আতঙ্ক ছড়াচ্ছি, ভয় পাচ্ছি, ভয় দেখাচ্ছি, তবু নিজে থেকে কোনো বছরই নড়েচড়ে বসছি না, নিজের বাড়ির আশপাশ পরিস্কার রাখার দায়িত্ব নিজে নিচ্ছি না। মশা তাড়াবার কয়েল, ক্রিম - সব কিনছি, কিন্তু মশা জন্মাবার পথটা বাঁধবার ব্যবস্থা করছি না। কারণ প্রথমটার প্রেরণা আসে ভয় থেকে, আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে, পরেরটার ডাক আসে বিবেক থেকে জনস্বার্থে, যে জনের মধ্যে 'আমিও' পড়ি। সেখানে আমি সরকারের মুখাপেক্ষী। পঞ্চায়েত থেকে, কি মিউনিস্যাপলিটি থেকে লোক এসে কবে ব্লিচিং ছড়াবে, ততদিন মশারা ধৈর্যসহকারে সংযম পালন করবে, তারপর দয়াপরবশিত হয়ে সেই সরকারি ব্লিচিং-এ প্রাণত্যাগ করবে, আর আমি বিপদমুক্ত হব। অন্যথা হলে ভাঙচুর করার নাগরিক অধিকার তো আমার আছেই।
        আত্মতুষ্টি আর আত্মক্ষোভ - এই দুটোই বড় সাংঘাতিক মারণ আবেগ। আশ্চর্যের কথা আমাদের দুটোই আছে। নিজেদের দায়িত্বে আমরা সন্তুষ্ট। নিজেদের অধিকারে আমরা ক্ষুব্ধ। যতটা পাওয়ার ছিল পেলাম কই? আর যতটা করার বা দেওয়ার ছিল? সপাটে উত্তর, করেছি তো!
        কথাটা হল, আমাদের সভ্যতা আসলে তো পাশ্চাত্য সভ্যতার আদলে তৈরি হতে চাওয়া একটা অনুকরণ সভ্যতা। তাদের মত হাস্পাতাল, পথঘাট, আইন আদালত, ভোটাভুটি সবই চাই। এর কোনোটার উৎসই আমাদের প্রাচীন ভারত তো নয়। তার অপরিণত আভাস যদিও দেশপ্রেমীদের দ্বারা আবিস্কৃত এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে, তবু আমাদের বেশির ভাগ শব্দই 'প্রতিশব্দ' আধুনিক সভ্যতায়। এমনকি এই 'সংস্কৃতি' শব্দটাও, যা culture-কে অনুদিত করে। অনুকরণের সমস্যা হচ্ছে, তার তাগিদটা বাইরে হওয়ার মত হয়েই ফুরিয়ে যায়। ভিতর থেকে হয়ে ওঠার মত শক্তি তাতে থাকে না। তাই যেখানে সেখানে এত অসামঞ্জস্য। বাইরের চাকচিক্যে যদি সব কিছুর শেষ পরিমাপক হয় তবে মুশকিল।
        এ কথাটা আমাদের দেশের বেশ কিছু মনীষী অনুভব করেছিলেন। আচার-অনুষ্ঠান আর অতীন্দ্রীয় জীবনদর্শন - এই দুই খাদ এড়িয়ে শুধু মানবিক নৈতিকতার উপর ভারতকে দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছিলেন মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ। রামমোহন - বিদ্যাসাগর - রবীন্দ্রনাথ, ই ভি রামস্বামী (যাকে এশিয়ার সক্রেটিসও অনেকে বলেন), গান্ধী ইত্যাদিরা।
        স্বাধীনতার পর নানান আদর্শের সংঘর্ষ, বিশেষত নানান রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে ক্রমশঃ আদর্শহীন ক্ষমতাসর্বস্ব আস্ফালন ভারতীয় আত্মমগ্ন, শান্তরূপটাকে ক্ষত-বিক্ষত করে তুলল। দীর্ঘদিন পরের শাসনে থেকে, সব অনিষ্টের দায়ভার পরের ঘাড়ে ফেলে নিজেদের ঋষির সন্তান ভেবে আত্মতুষ্টিতে বাঁচতে কোনো অসুবিধা হয়নি। যারা সে তুষ্টিতে সুড়সুড়ি দিয়েছেন, কিম্বা সে আত্মমদের যজ্ঞে আহুতি দিয়ে এসেছেন, তাদের ছবি দেওয়ালে, মন্দিরের বেদীতে রেখে পূজোতেও দ্বিধা হয়নি। যারা এর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন তাদের দেশদ্রোহী, অভারতীয়, বিদেশী পা-চাটা বলে তিরস্কার করতে বাধেনি। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর, পঞ্চাশটা বছর ঘুরতে না ঘুরতেই যখন 'অমৃতের পুত্রদের' স্বরূপ উদঘাটিত হতে শুরু হল, যখন আমরা বুঝতে শুরু করলাম আমরাও পৃথিবীর আর সকল দেশের মতই বেশির ভাগ স্বার্থদুষ্ট আর কিছু স্বার্থহীন আদর্শপ্রাণ মানুষের মিলিত সভ্যতা, আমরাও আদতে মানুষ। আমাদের প্রাচীন দর্শন মানবাত্মার যতই মহিমাজ্ঞাপন করে থাকুক অবশেষে - 'অন্নগত প্রাণ', তখন বড় একটা ঝটকা খেলাম। যদিও এ মোহভঙ্গ স্বাধীনতার প্রাক্কালেই শুরু হয়েছিল। বামধারার রাজনীতিতে বিশ্বাসী একদল তরুণ-তরুণী গড়ে উঠছিল, যার পূর্ণবিকাশ ও অধঃপতনের সাক্ষী আমাদের নিজেদের রাজ্যই। অবশেষে বেদও টিকল না, দাস-ক্যাপিটালও ব্যর্থ হল। উপায়?
        ভারতের মনসায় এখন তুমুল দ্বন্দ্ব - প্রাচীন ভারত বনাম আধুনিক নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জড়িত বিশ্ব সংসার। যেখানে কেউ কারোর চূড়ান্ত ঊর্ধে নয়। কেউ কোনো কোনো অংশে খানিক এগিয়ে, খানিক অংশে পিছিয়ে। মিলিয়ে সে সবার মাঝে সবার মত। তবে সে গর্ব করবে কি নিয়ে? ঠিক। আমরা শেষ কিছু দশক ধরে একটা গর্বের উপর দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। ধর্মে দর্শনে আমাদের একাধিপত্যের গর্ব। আজ বিশেষ একটা রাজনীতির আদর্শ আমাদের আশ্বাস দিচ্ছে সে হৃতগৌরব আমাদের ফিরিয়ে দেবে। সেই গৌরবের ধ্বজাধারী মহাপুরুষদের ছবিও তাদের দলের রঙের সাথে মিশে যাচ্ছে। ভারতের চিত্ত সংশায়কুল। কারণ, যুক্তি, আস্ফালন তখনই বাড়ে যখন বিশ্বাস তলানীতে এসে ঠেকে। আমাদের নিজেদের সে প্রাচীন সংস্কারে কি সে বিশ্বাস আর ফেরা সম্ভব? কখনও না। তাই এত ভয়। আর ভয় থেকে এত নিরাপত্তাবোধের অভাব। এত বিচ্ছিন্নতাবাদী হিংসার সূত্রপাত। এও যাবে।
        এ যুগ সিদ্ধান্তের যুগ না। এ যুগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার যুগ। ক্রিটিকাল থিংকিং-এর যুগ। সার্বিক আলোচনার যুগ। আদর্শ-বিশ্বাসের থেকে বড় কথা বিশ্লেষণ আর সংশ্লেষণ। সেই পরীক্ষার থেকে জন্মাবে দিশা। যার হাল ধরবে মানুষের জন্মলব্ধ দায়িত্ববোধ। ভারতকে এটা বুঝতে হবে। যা গেছে তা চিরকালের জন্যই গেছে। তার মমি পূজো করে আর বেঁচে থাকার দিন নেই। ভারতচেতনা থেকে বিশ্বচেতনায় যত শীঘ্র জাগি ততই মঙ্গল। তবেই বিশ্ব সংসারে নিজের দায়িত্ব মিলবে। নইলে সারা বিশ্বে ঐতিহাসিক পর্যটক স্থান হিসাবেই বাঁচতে হবে।