নানককে নিয়ে অনেক গল্প। একটা গল্প আছে বাচ্চা নানক ঘরে বসে দেখছেন অনেক লোক, অনেক উপাচার নিয়ে চলেছে রাস্তা দিয়ে। নানক দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কোথায় যাচ্ছ গো?
তারা বলল, বৃষ্টি হচ্ছে না তো অনেকদিন। আমরা চাষ করতে পারছি না। তাই আমরা ঈশ্বরের আরাধনায় যাচ্ছি বৃষ্টির জন্য।
নানক শুনে বললেন, বেশ, তোমরা দাঁড়াও, আমিও যাব।
এই বলে নানক দৌড়ে বাড়ি গেলেন। একটা ছাতা নিলেন। তারপর তাদের দলের সঙ্গে হাঁটা লাগালেন। কেউ ভাবল ছোঁড়া তাদের সঙ্গে ব্যঙ্গ করছে, এই ভেবে সে ধমক লাগালো। কেউ মজা পেয়ে নানকের সঙ্গে একটু ফাজলামি করল। কিন্তু নানক তার নিজের মনে ছাতা হাতে পরামাত্মার নামগান করতে করতে চলতে লাগলেন।
গল্পে আছে ফেরার সময় নাকি তুমুল বৃষ্টি হয়েছিল। নানক পরমানন্দে ছাতা মাথায় ফিরেছিলেন।
নানক ঈশ্বরকে সত্য বলে বিশ্বাস করেছিলেন। ঈশ্বরকে পরম দাতা বলে বিশ্বাস করেছিলেন।
দুটো কথা আছে, ঈশ্বরকে সত্য বলে জানা, আর ঈশ্বরকে নিজের নানা সুবিধার উপকরণ বলে জানা। দ্বিতীয় জনের বিশ্বাস একটু এদিক ওদিক হলেই টলে যায়। "এরকম হল আমার সঙ্গে, ঈশ্বর তবে নেই!"। জগতের সব ঘটনার ব্যাখ্যা তার বোধ অনুযায়ী পারম্পর্য ও তাৎপর্য মেনে চললেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব সত্য তার কাছে।
আমাদের ঈশ্বর বায়বীয়। আমাদের ঈশ্বর সম্প্রদায়ের। আমাদের ঈশ্বর আলো আঁধারিতে।
নানকের ঈশ্বর স্থির আলোকময়। নানকের ঈশ্বর আনন্দময়। নানকের ঈশ্বর সর্ব জগতের দাতা। নানকের ঈশ্বরের নাম সত্য। নানকের ঈশ্বরের নাম জগত গুরু। নানকের ঈশ্বর মানুষে মানুষে ভেদ মানে না।
আমাদের ঈশ্বর হিংসুটে। আমাদের ঈশ্বর লোভী। আমাদের ঈশ্বর ধোঁয়াশায়। আমাদের ঈশ্বর স্বার্থপর, একচোখা।
নানক আমাদেরকে আমাদের ক্ষুদ্র ঈশ্বরের হাত থেকে মুক্তি দিতে চাইলেন। আমাদের নানা কাল্পনিক প্রথা থেকে মুক্তি দিতে চাইলেন। আমাদের তর্পণ ইত্যাদি নানা ব্রাহ্মণ্যবাদের ক্রিয়া প্রক্রিয়া থেকে মুক্তি দিতে চাইলেন। তাদের বানানো হাজার একটা থিওলজিকাল অমানুষী অত্যাচারকে বললেন, মূল থেকে উপড়ে ফেলো। এমনকি মেয়েদের শরীর নিয়ে যে অসম্ভব ছুঁৎমার্গীতা, তাকেও ছুঁড়ে ফেলে বললেন, প্রাকৃতিক যা তাকে শুদ্ধ অশুদ্ধ বলার অধিকার কে দিল তোমাদের? কল্পনা যখন যুক্তির অনুগামী হয় তখন হাইপোথিসিস হতে পারে। কিন্তু যুক্তি যখন কল্পনার অনুগামী হয় তখন ময়ূরের চোখের জলে শুক্রাণু জন্মায়, গোবরে ক্যান্সার সারে, গোমূত্রে প্রসব বেদনা হ্রাস হয়। এ যুগেও হয়।
নানক আমাদের কুসংস্কার আর আধ্যাত্মিকতার মধ্যে পার্থক্য শেখালেন। জগতের মালিক যিনি তাঁকে চাইতে বললেন সহজে, মন্ত্রতন্ত্র কৌশলে না। মানুষের সেবায়, সৎ জীবিকায় আর নামগানে। এখানে ফাঁকি কিছু নেই। নানক বললেন, অল্প অল্প অভ্যাস করো, হয়ে যাবে। মনে শান্তি আসবে। মনে শান্তি এলে মাধুর্য জাগবে। মাধুর্য জাগলে জীবন ডালপালা মেলে অন্যের ছায়া হবে। নিজের হৃদয় নিজের তীর্থ হবে।
নানক বললেন, যা কিচ্ছু পাচ্ছ, মনে রেখো দাতা এক। দেবার মালিক এক। এ সংসার যার থেকে প্রতি মুহূর্তে হচ্ছে, সেই তিনিই দিচ্ছেন যা কিছু। যা পাচ্ছ তাঁর হাত থেকেই পাচ্ছ। এটুকু মনে রাখলে, যা দেবে সবটুকু তাঁর হাতেই পৌঁছাবে।
গলাবাজি, তর্কবাজি, ক্ষমতাবাজি - এসবের মধ্যে শান্ত থেকে নিজের কাজটুকু করে যাওয়া সাধনা। নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়ার খেয়োখেয়ি লড়াই থেকে বেরিয়ে এসে নিজের অনুভূত, স্বার্থগন্ধহীন মহৎ সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই অনেক কঠিন। নানক মর্দানাকে নিয়ে হাজার হাজার মাইল হেঁটে ফেললেন শুধু এই কাজটার জন্য। কোনো লড়াই না। কোনো রক্তক্ষরণ না। কোনো কূটকৌশল না। কোনো সুক্ষ্ম তর্ক না। একটি শক্তিতেই তিনি জগতকে জয় করলেন, নিজের চরিত্রবলে। সংসারে তাঁর আগে যারা এসেছিলেন, এবং পরেও যাঁরা মানুষের চিত্তজয় করেছেন, জগত গুরুর আসনে আসীন করেছে যাকে মানুষ, তাঁদের শক্তি বলতে এই একটাই, চরিত্রবল।
আবার দিন যায়, তর্ক ফেনিল হয়, স্বার্থবোধ সুক্ষ্ম হয়। অনেক কপটাচারী আবার গুরুর আসনে বসতে জগতে এসে দাঁড়ায়। অন্ধকে অন্ধ পথ দেখানোর মত। তারা ভাবে নানা কৌশলে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবে। বিনা চরিত্রবলে যে তা সম্ভব নয়, সে বিশ্বাসই করে না। ভাবে মানুষকে মুগ্ধ করতে পারলেই তার কাজ সমাধা হয়। সাময়িকভাবে হয় বটে। মানুষ মুগ্ধ হয়। সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিতও করে কিছুকালের জন্য। কিন্তু মহাকাল এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
নানকেরা থেকে যান। সুক্ষ্ম তর্কে না, কূট যুক্তিতে না। অসীম ভালোবাসা আর আত্মত্যাগের চরিত্রবলে। যে আলো চায় সে পায়। যে রঙমশাল খোঁজে, সে বাজারে এ দোকান সে দোকান ঘুরে মরে। সবই আছে সংসারে। আমার চাওয়ার আন্তরিকতার উপর নির্ভর করে সবটুকু। নানকের মত জগত শিক্ষকেরা এইটুকু বিশ্বাসের কথাই বলে যান কানে কানে বারবার।