Skip to main content

নারদীয় ভক্তিসূত্র, গীতবিতান আর কথামৃত। কি মিল? সেখানে সব "তুমি" অথবা "তিনি"। রবীন্দ্রনাথ না হয় কবি। সাধক কবি। মরমীয়া কবি। কিন্তু রামকৃষ্ণদেব বললেই তো আপাতভাবে জানা যায় তিনি কালীর সাধক। তবে কই, কথামৃতের পাতায় পাতায় তো "কালী কালী" শব্দ নেই। একেবারে নেই তা নয়, তবে যা আছে তা অতি নগণ্য। আছে শুধু - 'তুমি, তিনি, তাঁকে'।

'তুমি' মানে অস্তিত্ব না, সম্পর্ক। কেমন করে হবে? হয় তো। মানুষের সব কিছুর সঙ্গে সম্পর্ক হয়। সাবান কেস, টুথব্রাশ, বালিশ, বিছানা, দেওয়ালের রঙ, ঘরের গন্ধ, ছাদের কার্ণিশ, ল্যাপটপ, মোবাইল, চিরুনি, জুতো-চটি সবের সঙ্গে একটা আত্মবোধ থাকে। আমার বোধ থাকে। টবের গাছ, বাগানের গাছ, পোষা বেড়াল, কুকুর এদের তো কথাই নেই। মানুষ সম্পর্ক ছাড়া বাঁচে না। পাড়া, জেলা, দেশ, ভাষা এসবের সঙ্গেও তো নিবিড়ভাবে আমার 'আমি' যুক্ত হয়। সেও সম্পর্ক।

তেমনই কথামৃতের 'তিনি', গীতবিতানের 'তুমি', নারদীয় ভক্তিসূত্রের 'তুমি' ও সম্পর্ক।

একি তত্ত্ব? না, অনুভব। অনুভবের পরিধি হয় না। সীমা হয় না। আকার হয় না। রূপ হয় না। অনুভবের শুধু অনুভব হয়। এ 'তুমি' সেই অনুভবের 'তুমি'। এ 'তুমি' আমার 'আমি'-র থেকে বড়। এও অনুভব। আমার আমি-কে তুমি-র নীচে রাখি না উপরে? সংসার বলবে, উপরে রাখো। অহংকার বলবে, সবার উপর আমি সত্য তাহার উপর নাই। কিন্তু সম্পর্কের টান বলবে, আমি নীচুতে বসি। তুমি উপরে বোসো। কেন? কারণ ওতেই আমার সুখ।

"তব পদতললীনা আমি বাজাব স্বর্ণবীণা / বরণ করিয়া লব তোমারে মম মানসসাথী"। তুমি-র নীচে আমি-র বাস। তুমি মাধুর্যময়। তোমার মাধুরী চুঁইয়ে চুঁইয়ে আমায় ঘিরে থাকছে। আমায় স্নিগ্ধ করছে। আমার আমি জুড়ে যত ক্ষোভ, তাপ সব শান্ত হচ্ছে। শান্ত হবে কখন? যখন তুমি থাকবে আমার আমি-র উপরে।

তুমি জন্মায় কোথায়? আকাশে? ওই উপরে? না। তুমি জন্মায় আমি-র বুকে। সেই তুমি বীজ। ক্রমে সে তুমি অঙ্কুরিত হয়। সবুজ দুটো পাতা জন্মায়। সে মাধুর্য আর আনন্দ। অচেনা গন্ধ। অচেনা সুখ। অচেনা স্বস্তি। ক্রমে সে ডালপালা মেলে আমি-কে আড়াল করে দাঁড়ায়। এখানে উপনিষদের সেই গল্প জন্মায়। এক গাছে দুই পাখি। এক পাখি উপরের ডালে বসে। স্থির, শান্ত। আরেক পাখি নীচের ডালে বসে। চঞ্চল। সে এক-একবার মিঠে ফল খায়। নেচে ওঠে। উপরে তাকায়। আবার টক ফল খায়, যন্ত্রণা পায়। উপরে তাকায়। সে উপরের পাখি স্থির বসে। স্নিগ্ধ, সৌম্য, প্রসন্ন। ক্রমে নীচের পাখি ধীরে ধীরে উপরের পাখির কাছে আসে। শান্ত হয়। তৃপ্ত হয়।

এও আমি আর তুমি-র গল্প। দুই পাখি। আমি আর তুমি। 'তুমি' পাখিটাই তো গীতবিতান, কথামৃত। তত্ত্ব কে চায়? মানুষ চায় অনুভব। অনুভবের গভীরে জাগা এক অনির্বচনীয় অনুভব আছে, যাকে বলে 'চেতনা'। যে সব অনুভবকে ধারণ করে। তাই অনুভব হঠাৎ নিজেকে যখন জিজ্ঞাসা করে, কে আমি? তখন পুবাকাশ লাল হয়। তার গভীরে বেজে ওঠে সুর। 'আমি'র বুকে বীজ বপন 'তুমি'র। তত্ত্ব না, সংজ্ঞা না। অনুভব। অনুভবের প্রশ্নে জাগা চেতনা। অনুভবের আত্মানুসন্ধানকে বলে অভিসার। বাঁশি বাজে। নূপুরে কান্না জাগে। কে বলে, আসছি? কে বলে ওঠে? এসো.. আমি তো তোমার জন্যেই জেগে আছি।

গোটা সংসার এই আমি-তে তুমি-তে জড়িয়ে। আমি-র বুকে ঘুমানো তুমি-তে জাগে ছোটো সংসার। তুমি-র বুকে খেলে বেড়ানো আমি-তে জাগে বিশ্বসংসার। দুই সত্য। একটা অখণ্ড সত্য, একটা খণ্ড। শান্তি চাও, তো বুকে তুমি-কে জাগাও। গীতবিতান বলল। আনন্দ চাও তো আমি-র প্রদীপে তুমি-র শিখা জ্বালো। কথামৃত বলল। প্রেম চাও? তো নিজের সুখে ছাই দিয়ে তুমির সুখের সুখী হও। ভক্তিসূত্র বলল।

আসলে সবাই সম্পর্কের কথা বলল। পুবাকাশের সঙ্গে সূর্যের যে সম্পর্ক, সেই সম্পর্কের কথা বলল। মনে করালো, অন্ধকারের পারে আলোতে যাওয়ার কথা, নিরানন্দের পারে আনন্দে যাওয়ার কথা। মন্ত্র দিল একটাই - তুমি বা তিনি। তাকে জাগাও।