Skip to main content
 
 
      জিজ্ঞাসা করলাম, গলায় কণ্ঠিমালাটা আগে দেখেছি?
      চুল কাটতে কাটতে হেসে বলল, না। এই নিলাম। গুরুদেব বললেন, গলাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে রে, একটা কন্ঠি নে। তা নিলাম। আজ বাদে কাল তো নিতেই হত, বয়েস হচ্ছে।
      শাঁখ বাজল এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে। সন্ধ্যে নেমে এসেছে। গুমোট গরম। আষাঢ় মাস। সদ্য উলটোরথ হয়ে গেছে। জিজ্ঞাসা করলাম, মাছ-মাংস খাওয়া নিষেধ করেছেন?
      নাপিত বলল, না না। বলেছেন মন যদ্দিন চাইবে খাবি।
      পাখা ঘুরছে ফুলস্পিডে। সেলুনের বেঞ্চির উপর রাখা খবরের কাগজের পাতা পতপত করে উড়ছে। সদ্য হার্টের একটা বড়সড় অপারেশান হয়েছে মানুষটার। দক্ষিণের সাঁইবাবার আশ্রম থেকে একরকম নিখরচায়। শরীর ভেঙেছে। সেলুনের আশেপাশে অনেক বাড়ি। বড় বাড়ি। ডাক্তার, উকিল, শিক্ষক ইত্যাদি ইত্যাদি। উপার্জনের বৈষম্য। ভীষণ বৈষম্য। নীতি আছে, ভাবনা আছে, চিন্তা আছে, তবু কি যেন নেই।
      ঝাঁট দিচ্ছে কাজের দিদি। জিজ্ঞাসা করলাম, দেশের বাড়ি কেমন ঘুরলে?
বলল, আর বোলো না দাদা, অটোর ভাড়া বাড়িয়ে তিরিশ টাকা করেছে। আমি তোমার দাদা আর আমার ভাই ভাইয়ের বউ। বললাম, কমাও, এতগুলো লোক যাচ্ছি..কে কার কথা শোনে। আর কমাবেও বা কেন, ওরও তো পেট চলার আছে।
 
      মন আবার সেলুনে ফিরল। উপার্জনের বৈষম্য। এ নিয়ে ভাবার কিছু নেই। এ স্বাভাবিক। অনেক জটিল অর্থনীতি। বললাম, গুরুদেব কোথায় থাকেন? সংসারী?
নবদ্বীপ। হ্যাঁ।
      মানুষে মানু্ষে আলাপ কিসে হয়? শ্রেণীতে হয়, গোষ্ঠীতে হয়, আবার কখনও কখনো শ্রেণী ছাপিয়ে উন্মুক্ত খোলা হাওয়াতেও হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় মানু্ষের নামের সাথে মানুষের কর্মক্ষেত্রের, শিক্ষাগত যোগ্যতার উল্লেখ থাকে। বোঝা যায় সে কি যোগ্যতার মানুষ। কখনও মান বাড়ে, কখনও তাচ্ছিল্য জমে, কখনও উদাসীনতা আসে। কথার ওজন বাড়ে কমে। বিচার সুক্ষ্ম হয়। মনে মনে হিসাব হয় "ব্যাতন কত"? ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা, অহংজ্ঞাপন, অহংপীড়ন ইত্যাদির সুক্ষ্ম জোয়ারভাটা এদিক ওদিক ঘোরে বন্ধুত্বের ছদ্মবেশে, চোখে পড়ে। "আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে"..সত্যিই কবি? বিশ্বাস করতে? কাঁসর বাজছে কারোর বাড়িতে। জিজ্ঞাসা করলাম, আবার কবে চেক-আপ?
      বলল, ছ মাস পর।
      টাকা মিটিয়ে বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরলাম। বাজার বসে গেছে। মানুষের প্রয়োজনের চাইতে আয়োজন বেশি লাগে। প্রয়োজনের চাইতে আরো প্রয়োজনের ডাক। বিলাস। স্বাচ্ছন্দ্য। শখ। নেশা। জ্বলজ্বলে আলোয় দোকান সাজানো। ফেল কড়ি মাখো তেল। বৈষম্যের কথা ভেবো না। ওসব ভাবতে নেই। চায়ের দোকানে থিকথিকে ভিড়।
      জিন্স পরা। খালি গা। সারামুখ দাড়ি। চোখগুলো পেণ্ডুলামের মত অস্থির। দোকানিকে বিস্কুট চাইল। দোকানি দিল। তাচ্ছিল্যের সাথেই দিল। "শ্রদ্ধেয়া দেয়ম, অশ্রদ্ধেয়া অদেয়ম - শ্রদ্ধার সাথে দাও, অশ্রদ্ধার সাথে দিও না।" সাথে এক ভাঁড় চা। পাগল বসল হাত পা ছড়িয়ে, ট্রেন লাইনের থেকে নিরাপদ দূরত্ব রেখে। চায়ে চুমুক দিল। বিস্কুটে একটা কামড় দিয়ে ঢোকালো জিন্সের পকেটে। নিশ্চয় ভেঙে চুরমার হবে। কাঁধ অবধি ঝাকড়া ঝাকড়া চুল। যৌবন পেরোচ্ছে শরীর, নির্বিকার।
জিজ্ঞাসা করলাম, কে? কেউ চেনে না।
      খালি পা বাচ্চা মেয়েটা এসে দাঁড়াল। হাতে খালি গ্লাস। চা ভরে নিয়ে যাবে, বাড়িতে অসুস্থ মা। আশেপাশে রেল কারখানার নানা পদে চাকরি করা মানুষ। উদাসীন মানুষ। আত্মগত মানুষ। বৈষম্যের কথা বলতে নেই। করুণার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ার ভাবোদ্দীপক পোস্ট। দিতে হয়। করুণা জাগে। অচেতন মনের বৈষম্যের পাপবোধে আরাম লাগে। চোখ গড়িয়ে জল নামে। লাইক দিতে দিতে, শেয়ার করতে করতে, পাপবোধ কেন্নোর মত গুটিয়ে যায়। কিছুক্ষণ তো গুটিয়ে থাক। আরাম লাগবে। সংসার মানে পদ। সংসার মানে উপার্জনের মই। সংসার মানে অ্যাচিভমেন্ট। নামের পাশে ডিগ্রী। ডিগ্রীর পাশে টিকটিকির মত অহং। বাড়ির দেওয়ালে, সোশ্যাল মিডিয়ায়, আত্মপরিচয়ের খোদাই। আমার মেধার অর্জিত অধিকার। সাম্য? কিসের সাম্য? উদয় অস্ত খেটে আধপেটা খাওয়া নগরীর মধ্যে বজরা চলেছে উচ্চমেধার। উচ্চমেধা - অধিক উপার্জন। সরল হিসাব। জটিল নীতি। মেধার পাশে ওকে? চাতুরী। অন্যদিকে তাকাও।
      গুরুদেব বসে। এসি অন। চারটে এসি। ভক্তের দল পদ্ম হাতে। কাঙাল গুরু, দরিদ্র-বঞ্চিত মানুষের জন্য প্রাণকাঁদা করুণামূর্তিগুরু এখন ধনীভক্তের পুঁজি। গুরুমূর্তি পাথর হয়ে কাঁচের মধ্যে। ভক্ত আসছে দলে দলে। আজ গুরুপূর্ণিমা। ধনী মঠ। ধনী ভক্ত। উচ্চমেধা। উচ্চবিত্ত। পাগল প্রেমিক স্তব্ধবাক। সেই পাগলটা? যার পকেট ভর্তি বিস্কুটগুঁড়ো। কই সে, কই সে? লাইনে দাঁড়িয়ে ভক্তের দল। "ঈশ্বর দর্শন জীবনের উদ্দেশ্য... কামকাঞ্চন ত্যাগ না হলে হবে না"... গুরুর কথা পাতায় পাতায়। ঠাণ্ডা ঘরে ঘুমন্ত পাতা। নানা মতের ভক্তের দল। নানা মত নানা গুরু। মতের বৈষম্য। কিন্তু একখেনে মানু্ষ এক। কোথায় এক?
      মানুষ কি চায়? সুখ। মানুষ কি চায় না, দুঃখ। কে দেবে সুখ? গুরু অর্থ মেধা শ্রম চতুরতা উদাসীনতা স্বার্থপরতা।
      মানুষ চায় দেহের সুখ, নিরাপত্তার সুখ, মানের সুখ, নামের সুখ। মানুষ চায় না দুঃখ। দেহের দুঃখ, অপমানের আশঙ্কার দুঃখ, নিজের নামের অনাবিষ্কৃত থেকে যাওয়ার ক্ষোভ। ঈর্ষা জমছে কেঁচোর মত। ভিজে ভিজে গা। "সচ্চিদানন্দ বই গুরু কই? মানুষ কখনোও গুরু হতে পারে না" বললেন দক্ষিণেশ্বরের পাগল বামুন। তবু গুরু হলেন নিজে, কারণ "সবাই কি অনন্তকে ধরতে পারে?" বললেন।
      মানুষ অনন্তকে সান্তে পেল। সান্তে সান্তে বিরোধ বাধল। সীমায় সীমানায় স্পর্ধা! জটিল অঙ্ক। সত্য অনন্ত। জ্ঞান অনন্ত। তবু হিসাবী জ্ঞান হল পাথর। ভাবনা আটকালো। স্রোত স্তব্ধ হল। উড়ন্ত সাদা চিল সেদিন থেকে গুরু না, কবিকে খুঁজে ফিরল। কবি বলবে সত্য কথা। পাথর গলবে। স্রোত বইবে। আজ হোক গুরুপূর্ণিমা। আমি খুঁজছি কবিতা। আমি খুঁজছি মানুষ। গলিত মেধা মানুষ। বাউলের একতারা। স্রোতে গড়ানো পাথর। বৃষ্টিধরা মেঘ। লোভহীন অর্থহীন হাসি। একটা আরামদায়ক চিত্তজাত মৃত্যু। বাঁচার জন্য।