শ্রীরামকৃষ্ণ ছবি আঁকতেন। শ্রী নন্দলাল বসু ওঁর আঁকা দুটো ছবির প্রতিলিপি করেছেন, যে দুটো ছবি দেওয়া এখানে, একটা জাহাজ, একটা আতা গাছে তোতা পাখি।
যে মানুষটা জন্মাবধি ঈশ্বর পাগল, সে মানুষটা ছবি আঁকছেন জাহাজের, আতাগাছে তোতাপাখির। ঠাকুর দেবতা এঁকে দেওয়াল, খাতা ভরিয়ে দিচ্ছেন না। যাঁর প্রতিটা শ্বাসে, প্রতিটা কথায় দিব্য চৈতন্যের স্ফুরণ, তাঁর পোশাকে-আশাকে, গলায়-কপালে কোথাও কোনো চিহ্ন নেই। চিহ্ন একটাই, তাঁর আচরণ। করুণার প্রলেপ। রসিক মেথর থেকে শুরু করে মুখে বুট ঘঁষে দেওয়া, পিঠে উত্তপ্ত চারকোল ঠেসে ধরা খাজাঞ্চি ইত্যাদিরা, অবাধ্য উগ্র হৃদে --- সবার জন্যেই করুণা। করুণাই ধর্মের বোধের একমাত্র লক্ষণ, পৃথিবীর সব মহাপুরুষ, সাধু, শাস্ত্র বলেন। করুণার বোধে মানুষ শান্ত হয়, তৃপ্ত হয়, স্তব্ধ হয়।
আজ এ সব কথা চর্চিত হওয়ার দিন নয়। অবকাশ নয়। আজ ধর্মকে অনুভবের আগ্রহের থেকে বেশি ধর্মের স্বার্থানুগত ব্যবহারের তাগিদ। আমি মিছিল বার করব, আমি মন্দিরের পর মন্দির গড়ব, উৎসব করব। প্রত্যেকটাকেই বলব 'ধর্ম'। মানুষের মিছিল দেখে বলব, মানুষ ধর্মপ্রাণ হচ্ছে। আদৌ যা সত্যি না, আমি তুমি সবাই জানি, তবু চুপ থাকি।
=======
মানুষ তার চিত্তবৃত্তির সব ক'টা তারে সুর তুঙ্গে বাজিয়ে দেখেছে, কোনো সুরেই তার চরম সার্থকতা বোধ নেই, যতক্ষণ না তার চিত্তে করুণা জন্মাচ্ছে, ততক্ষণ সে নিজের বুদ্ধি-বিচার, নিজের আবেগ, প্রবৃত্তি সবার দাস, প্রতি মুহূর্তে নিজের হাতে নিজে শিকার হচ্ছে, ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। অশান্ত হচ্ছে। বিকারগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষুব্ধ হচ্ছে। সর্বোপরি দু:খ পাচ্ছে।
এ সবের হাত থেকে রক্ষা পায় একমাত্র করুণার বোধে। করুণার অর্থ নিজের অহমিকাকে সরিয়ে, অন্যকে গুরুত্ব দেওয়া। একটা বিশাল হলঘরে যদি অসীম জানলার অবকাশ থাকে, তবে শুধু নিজের জানলায় মুখ বাড়িয়ে না বসে, অন্যের জানলা দিয়েও একবার জগতটাকে দেখার ইচ্ছাকে বলে উদারতা। যা বৌদ্ধিক করুণা। আমি তখন সব সময় আমার ইচ্ছা-রুচিকেই প্রাধান্য দিচ্ছি না, তুমি কি বলতে চাইছ সেটাও শুনতে চাইছি, তোমার মতো করে জিনিসটা দেখতে চাইছি, আলোচনা করতে চাইছি, তোমার আর আমার দেখার মধ্যে একটা সমন্বয় ঘটাতে চাইছি। আর এ সবের মূল কারণ হল কি? আমি তোমায় ভয় পাই না। তোমায় ভয় পাই না মানে হল তোমার রুচি, ইচ্ছা, পছন্দ, যুক্তিকে, দৃষ্টিভঙ্গিকে আমি থ্রেট মনে করি না।
শ্রীরামকৃষ্ণ এই বৌদ্ধিক করুণার মূর্ত প্রতীক। একজন রঙের গামলা নিয়ে বসে আছে। যে যে রঙ চায়, তাকে সেই রঙেই ছুপিয়ে দিচ্ছে। একজন এসে বলল, তুমি নিজে যে রঙে ছুপেছ আমায় সেই রঙে ছুপিয়ে দাও।
তাঁরই বলা গল্প।
=======
সত্য অস্তিত্ববান অস্তিত্বের সত্যতাতেই। আর মিথ্যা অস্তিত্ববান প্রচারের জোরে। সত্যের প্রচারকের দরকার হয় না। সত্যের শিক্ষার দরকার হয়। আপাত মিথ্যাকে সরিয়ে সত্যকে দেখার শিক্ষা নিয়েই সভ্যতা এগিয়েছে। সূর্যকে স্থির জেনেছি, আপাত জড় পদার্থের কেন্দ্রে মহাশক্তিমান পরমাণুর সত্যতাকে জেনেছি। সেভাবেই নিজের চিত্তের দিকে তাকিয়ে আপাত নঞর্থক ভাবাবেগগুলোকে সরিয়ে সত্য শিব সুন্দরকে দেখার শিক্ষাকে বলে 'তপস্যা'। আপাতভাবে হিংসা, ক্রোধ, ক্রুরতা, নিষ্ঠুরতা সত্য হলেও, তাকে অতিক্রম করে আরো গভীরের সাংগঠনিক সত্যের দিকে মানুষ যেতে পারে, এ বিশ্বাস জন্মানোই অধ্যাত্ম বিশ্বাস। তা যদি সমগ্র মানবজাতির বিশ্বাস না হত তবে কোনোদিনই সভ্যতার অগ্রসর বলে কোনো কথা আমরা বিশ্বাসই করতে পারতাম না। সামগ্রিকভাবে, সম্মিলিতভাবে সে রাস্তা অনেক বাকি, কিন্তু মাঝে মাঝে কয়েকজন মহাত্মা এসে আমাদের দেখিয়ে দিয়ে যান, নিজের ক্ষুদ্রতাকে জয় করে সঠিক মনুষ্যত্বে আসীন হওয়া মানুষের পক্ষেই সম্ভব। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের প্রার্থনা, মা আমার পশুভাব কমিয়ে দাও। এখানে পশুভাব অর্থ অবশ্যই 'অবিবেচনাবশ্যতা'।
করুণার বৌদ্ধিক দিক যেমন উদারতা, তেমনই তার প্রয়োগের দিক বিবেচনাশীল হওয়া। বিবেচনা নিজের আলোতে। নিজের বোধের করুণার আলোতে। যে বোধ স্বার্থসর্বস্ব নয়। সে-ই করুণাময় বোধ। সেই বিবেচনাজাত ব্যবহারকেই আমরা বন্ধুসুলভ ব্যবহার বলি। যার উপর আস্থা রাখি ভবিষ্যতের।
======
শ্রীরামকৃষ্ণর যে ছবি নিয়ে বলা শুরু করেছিলাম। যিনি ঘর দেওয়াল সব দেবদেবীর ছবিতে ভরিয়ে তো দেননি। তিনি তো সাকারে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি তো তা করতেই পারতেন। জীবনের শেষ লগ্নে যখন শ্যামপুকুরবাটি, কি কাশীপুর উদ্যানবাটীতে আছেন তখনও তো ভক্তদের বলতে পারতেন আমার জন্য একটা কালীমূর্তি বানিয়ে নিয়ে এসে এখানে একটা মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দাও। বলেননি।
অপপ্রচার, ব্যঙ্গ, মিম, ক্যারেক্টর অ্যাসাসিনেসান, ট্রোল…. সবের মূল বৃত্তি তো একটাই, দ্বেষ। হিংসা। অসহিষ্ণুতা। একটা শত সহস্র ছিদ্রের জলাধারকে হয় মেরামত করতে হয়, নয় সে জলাধারকে পরিত্যাগ করতে হয়। দ্বিতীয়টা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রথমটা নিয়ে কাজ করতে গেলে আগে খোঁজা দরকার এত ছিদ্র বাড়ছে কেন? মধ্যমেধার মিস্ত্রি প্রতিটা ছিদ্রকে রোধ করার জন্য আলাদা আলাদা ব্যবস্থা করবে। বলাইবাহুল্য তার কাজ কোনোদিন শেষ হবে না। যে উন্নত মেধার মিস্ত্রি, সে খুঁজবে কারণটা কি?
যখন রেলকলোনীতে থাকতাম তখন প্রায় প্রতি বছর বর্ষাকালে ছাদ ফেটে জল পড়ত। যতবার খবর দেওয়া হত, ততবার কর্মচারীরা এসে পিচচট লাগিয়ে চলে যেত। পরের বছর আবার পিচচট, তার পরের বছর আবার। এই করে করে ছাদে পিচচটের আস্তরণের পর আস্তরণ পড়ে যেত, কিন্তু সমস্যার কোনো দীর্ঘস্থায়ী সমাধান হত না।
আমাদেরও তেমন নীতিশিক্ষার, উপদেশের শেষ নেই। পিচচটের মত। হিংসা কোরো না, নেশা কোরো না ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কোন মনকে বলা হচ্ছে? যাকে বলা হচ্ছে সেকি এসব শোনার অবস্থায় আছে? এই প্রশ্নের উত্তরে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নীরব। যেন যেভাবে মানুষকে দুয়ে দুয়ে চার শেখানো যায়, তেমনভাবেই মানুষকে হিংসা, দ্বেষের মূল ধরে উৎপাটনের পদ্ধতি সেখানো যায়। এতে করে মানুষকে আরো চালাক, আরো ভণ্ডই বানানো যায় শুধু। এ না তো মানসিক বিশ্লেষণে সাধ্য, না নীতিমালা পড়িয়ে। এ শুধুমাত্র সম্ভব এক দরদী শিক্ষাদানের রীতিতে। যে আসক্তিকে স্বীকার করবে, কিন্তু আসক্তিই যে চরমাবস্থা নয় তাও অস্বীকার করবে না। যে চূড়ান্তভাবে নিন্মবৃত্তিতে আসক্ত, তার চিত্তেও শ্রেয়ের প্রতি বোধ, শ্রদ্ধা থাকে। দুর্বলভাবে থাকে। তাকে শক্তিশালী করে তুলতে যে পথ লাগে, সে দরদী পর্যবেক্ষণ, ধৈর্যের পথ। একজন জেগে থাকলে সে আধাঘুমে থাকা মানুষের হাত ধরতে পারে। কিন্তু ঘুমন্ত, কি আধাঘুমন্ত মানুষের হাতে ম্যাপ ধরিয়ে যদি বলা হয় চলে যাও এই পথ ধরে, কিম্বা মাঝে মাঝেই তার পিঠে চাবুক মেরে বলা হয়, কই গেলে না যে? তবে একদিন সে বিকারগ্রস্থ, উদ্ধত হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু সত্যাগ্রহী হতে পারে না।
======
শ্রীরামকৃষ্ণ বলে গেলেন, তোমাদের চৈতন্য হোক। একটা জীবন রেখে গেলেন। আরো কয়েকজন শিষ্য ও মা সারদা রয়ে গেলেন সে-ই পথের আলোকস্তম্ভ হয়ে। "ভাঙতে সবাই পারে, গড়তে পারে ক'জন?" মা বললেন। গড়লেনও। ধৈর্যে, ভালোবাসায়।
আজ শুধু 'অন্ধকার, অন্ধকার', বলে এই যে চেঁচামেচি করা পণ্ডিতদের দেখি, আশ্চর্য হই। রাতের অন্ধকারে আলো জ্বালতে আগে সলতে পাকাতে হত, তেলের ব্যবস্থা করতে হত, চিমনির কাঁচ মুছতে হত। আজ রাতদিন এক করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কারখানায় কাজ করতে হয়। তবেই হয়। এও কি এমনি এমনিই হবে?
আবারও বলি। সত্যের জ্ঞানের জন্য শিক্ষার প্রসার লাগে। আর মিথ্যার বাড়বাড়ন্তের জন্য প্রচার লাগে। প্রচারের পথ বন্ধ করা যাক না যাক, শিক্ষার রাস্তাটা প্রশস্ত করা চাই-ই চাই। মানুষ সত্যকে জানলে তাকে নেবেই। এ চিরকালীন সত্য। বড় সত্যকে পাওয়ার জন্য ক্ষুদ্র-আপাত সত্যকে ত্যাগ করা মানুষের ধর্ম। মনুষ্যত্বের গৌরব। একে অপমান করে কোনো মানুষ, সমাজ, সভ্যতা আজ অবধি টেকেনি। টিকবেও না। ভ্রান্তি আবরণ, ক্ষণস্থায়ী। চিরকালীন নয়।