একজন নাইনের ছাত্রী। বাবা খুব টানাটানির মধ্যে সংসার চালান, তাও চান মেয়েটা পড়ুক। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াচ্ছেন মেয়েকে। ক'দিন আগে ব্যাচে পড়তে এসেছে। মাস্কটা নাকের নীচে পরা। স্যার তাকে দু-একবার বললেন, মাস্কটা হয় নাকের উপরে তুলে নাও, নয় খুলে বোসো। ছাত্রী গা করল না। আরেকবার স্যার বলাতে, এক ব্যাচ ছেলেমেয়ের মধ্যে স্যারকে বলল, আপনি আমার মুখটা দেখতে চান... নিন দেখুন... সেটা বললেই পারেন..., এই বলে সে মাস্কটা খুলে ব্যাগে ঢোকালো।
স্যার অপ্রস্তুত। লজ্জায় সংকোচে নিজেকে সামলে নিতে তার কয়েকটা দিন লেগেছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তারপর? সে মলিন হেসে বলেছিল, দিনকাল ভীষণ পালটে যাচ্ছে রে। আমি কিছু বলতে পারিনি, আমার মেয়ের বয়েসী সে।
সব কিছুই ভীষণ দ্রুত গতিতে বদলে যাচ্ছে। মূল্যবোধ বদলাচ্ছে। এটাই বড় কথা। মূল্যবোধ মানে কি? সেকি শেখানো যায়? জানি না পণ্ডিতদের কি মত, সামনে কি সত্যিই এক মহাশূন্যতা? মানুষ মাত্রেই ভুল করে। ছাত্রীটাও হয় তো শুধরে যাবে একদিন। কিন্তু সে তো আশার কথা। আদৌ কি সত্যিই উজ্জ্বল কিছু দেখতে পাচ্ছি সামনে? এ প্রশ্ন নিজেকে করতে হবে। যে মানুষ নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে চার দেওয়ালের মধ্যে দিন কাটায়, তার উত্তর তারা ইচ্ছাগামী হবে, অভিজ্ঞতাগামী না। কিন্তু যারা রাতদিন কাজের মধ্যে আছেন, তাদের কি মত?
মানুষের সব মূল্যবোধের জনক - দরদ। দরদশূন্য প্রজন্মের প্রজন্ম জন্মে যাবে? মানুষ তারায় তারায় রকেট পাঠাবে, আশ্চর্য কুশলী সব যন্ত্র বানাবে, দ্রুত থেকে দ্রুততর জীবনযাত্রা হবে… সুখ, বিলাসিতার সরঞ্জামে ভরে যাবে চারদিক... চিকিৎসাশাস্ত্র এমন উন্নতি করবে যে মারা যাওয়া কঠিন হয়ে উঠবে। সব হবে। কিন্তু যদি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে দরদ হারিয়ে যেতে শুরু করে?
মানুষ অন্যের যন্ত্রণা, অসহায়তা, ভিন্নতা যাবতীয় যা কিছু অনুভব করে দরদে। স্বীকার করে অন্যকে দরদে। আত্মীয় হয় দরদী হয়ে। চারপাশ যদি দরদশূন্যই হল তবে মানুষ কি শুধু সোশ্যালমিডিয়ার ভার্চুয়াল জগতে আর নানাবিধ পার্থিব উন্নতির সুখে বাঁচবে? জীবনে সুখ, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা সব দরকার আছে। কিন্তু নিজের আত্মা বিষিয়ে গেলে এ সবের আর কি দরকার? এর কি কোনোটাই কাজে লাগবে?
মানুষ দরদশূন্য হলে কঠিন, অপ্রিয় কথাকেও.. 'সত্য'... 'ফ্যাক্ট'... 'বাস্তব'... ইত্যাদির নামে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। আমরা কানাকে কানা বলে ডাকি না, সেটা সত্যের পরোয়া করি না বলে না, সেটা বস্তুজগতের বাস্তবের চাইতে মনুষ্যত্বের বাস্তবতাকে বেশি গুরুত্ব দিই বলেই তো! আর মনুষ্যত্বের বাস্তবতাই হল দরদী হওয়া। মানুষের যা কিছু মঙ্গলময় সে সব কিছুর জননী এই একটা শব্দ - দরদ। একটা অবিনশ্বর সনাতন অনুভব।
উচ্চাকাঙ্খা, ক্ষমতার আকাঙ্খা মানুষের দরদকে ব্যঙ্গ করে, নইলে তাকে শূন্য করে। ধর্ষকের দরদ থাকে না, ঘাতকের থাকে না। কিন্তু শাসকের দরদ না থাকলে সে আঘাত আরো বেশি। যে অত্যাচারিত সে ন্যায়মহলের কাছে ন্যায় চায়, আত্মীয়ের কাছে চায় দরদ। শাসক আত্মীয়, পালকের মত হবে, এই বিশ্বাসে আঘাত লাগলে ক্ষোভ আরো বেশি হয়। যা আজ হচ্ছে। সে আরো মর্মান্তিক!
সবাই পড়লাম ইউক্রেনে শিশুদের ধর্ষণ করে পুড়িয়ে গায়ে স্বস্তিক চিহ্ন এঁকে দিচ্ছে রাশিয়ার সেনারা। ক্ষমতার লোভ, উচ্চাকাঙ্খা মানুষকে এমনই পাষাণ বানায়, বর্বর বানায়। গোটা বিশ্ব ধিক্কার দিল। আজ আবার রাশিয়ার রাজা ঘোষণা করল, এ যুদ্ধ ইউক্রেন তথা বিশ্বের মঙ্গলের জন্যেই। মানুষ কতটা স্বার্থান্ধ হলে এমন বিশ্বাস রাখতে পারে যে, এ কথাও বিশ্বাস করবে জগত।
আমি আধুনিক প্রজন্মকে অত্যন্ত স্মার্ট দেখছি, অত্যন্ত কুশলী দেখছি। এ সবই এই দ্রুতগামী জগতে দরকার। তবে কোথাও একটা আশঙ্কার মেঘও দেখছি। আমাদের জীবন মূল্যবোধের শেষ সীমানায় এসে ঠেকছে প্রায়। এ ধরিত্রী জলশূন্য, অক্সিজেন শূন্য, জঙ্গলশূন্য হতে চলেছে, এ অবশ্যই দুশ্চিন্তার কথা। কিন্তু মানুষ যে মূল্যবোধ শূন্য হয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে, এই দীনতা ঠেকাবে কোন শিক্ষা? বাইরে থেকে কিছু কাজের অনুকরণে দরদ জন্মায় না, অভ্যাস জন্মায়। অভ্যাস অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। অনুষ্ঠান ভণিতায়। দরদ জন্মায় অন্তর থেকে, আশেপাশে ক্ষেত্র পেলে। যেমন উপযুক্ত পরিবেশে অঙ্কুরিত হয় বীজ কোমল সবুজ পাতা মেলে। দরদই দরদকে জাগায়।
বস্তুজগতের বুক চিরে মানুষের বিশ্লেষণী ক্ষমতা অভিনব কাজ করে চলেছে। মানুষের সব অনুভবের ব্যাখ্যাও হয় তো করে ফেলবে কদিন পর মস্তিষ্কের রাসায়নিক গঠনের ব্যাখ্যায়। কিন্তু দরদের ব্যাখ্যা আর দরদকে উজ্জীবিত করার ক্ষমতা কি এক? আমি রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার ব্যাখ্যা করতে পারি পূঙ্খানুপুঙ্খ, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কি বানাতে পারি একটা? হয় না। মানুষ কি অবশেষে নিজের কাছে নিজেই হেরে যাবে?
সম্পদ ভাগ করলে কমে, অনুভব ভাগ করে নিলে বাড়ে। বাঁচতে দুই-ই চাই। কিন্তু যদি জেদ ধরে বসি যে সম্পদেই জীবন চালিয়ে নেব, আমার চাই না অনুভবের সজীবতা! তবে? সে মূর্খামির হাত থেকে কে বাঁচাবে আমাদের?
জগতের কেন্দ্রে এক শক্তি আছে। বিবর্তনের শক্তি। আমরা প্রতিনিয়ত তারই ইচ্ছাধীন। সে শক্তি আমাদের কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে এই মুহূর্তে বলা শক্ত। তবে সে শক্তি যদি মনুষ্যজাতির সুহৃদ হয়, তবে নিশ্চই মানুষের জন্মলব্ধ যে ধন - তার দরদী মন, তাকে সুরক্ষিত করবে সে। কারণ মানুষের সামনে শান্তি আর সুরক্ষার একটাই পথ, তার অর্থ, সম্পদ, শক্তিকে মানবিক অনুভবের অধীনে সমাজকে গড়ে তোলা। যে লেখক বেশ কিছুকাল আগে ভীষণ বিখ্যাত হয়েছিলেন মানুষের ইতিহাস লিখে, যিনি ক্ষণে ক্ষণে মানুষের জীবনের সব কিছুকে তথ্যে আর বিশ্লেষণে এমন ব্যাখ্যায় এনেছিলেন যেন তিনিই আধুনিক জগতের ঈশ্বরের দূত (এমন প্রশ্ন একটি সাক্ষাৎকারে জনতা তাকে করেছিল। তিনি খুব হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, না না।), তিনিও এই যুদ্ধ আর প্যাণ্ডেমিকের পরে কিছুটা কনফিউজড যেন। তথ্যে না, আত্মবিশ্বাসে। অপ্রাসঙ্গিকও যেন কিছুটা। কারণ মানুষের হেঁটে আসা পথেই শুধু মানুষের আগামীদিনের কথা লেখা থাকে না, মানুষ মাঝে মাঝে নিজের ইতিহাসের উপরও বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। 'দ্য রিবেল' -এর লেখক এ কথা লিখেছেন তো।
মানুষ কি সত্যিই বিদ্রোহী হয়ে উঠবে? যে দরদকে নিয়ে সে জন্মায় তাকে নিয়ে রুখে দাঁড়াতে পারবে কি, সব কিছুকে আবার প্রাণিত করে তোলার জন্যে? সে ছাড়া তো পথ নেই আর! আগামী প্রজন্ম যদি দরদী বিজ্ঞানীনুগামী না হয়ে ওঠে, তবে আমাদের দিন শেষের কাছাকাছি। যদি পথ বাইরে খুঁজি, তবে পথের হিসাব মিলবে, গতি মিলবে না। যদি অন্তর দিয়ে খুঁজি, তবে গতিই পথ বানিয়ে নেবে।