আজ পঁচিশে বৈশাখ। কলেজের ছাত্র ছিলাম যখন তখন ভোরবেলায় উঠে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ী দৌড়াতাম। সুচিত্রা মিত্র, অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, ঋতু গুহ, বনানী ঘোষ, পূর্বা দাম প্রমুখ দিকপাল সব শিল্পীর কণ্ঠে চিত্ত স্নাত হত (কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্বচক্ষে দেখতে পাইনি কোনোদিন, এ ক্ষোভ আমার মরে গেলেও যাবে না)। আচ্ছন্ন হয়ে বাড়ি ফিরতাম। ওঁনারা তো শুধু কণ্ঠ দিয়েই গাইতেন না, গাইতেন সারাটা জীবন দিয়ে। ফলে গানও কানের ভিতর দিয়া মরমে পশতে বাধ্যই হত। আজও হয়।
তবে সেই স্মৃতিচারণের জন্য এ লেখা নয়। কিছু কথা মাথার মধ্যে ঘোরাফেরা করে। তাই বলতে চাই। রবীন্দ্রনাথ মানে কি শুধুই গীতবিতান? শুধুই সঞ্চয়িতা? বয়স যত বাড়ছে ক্ষোভও তত জমছে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ তাঁর ‘WHY TAGORE’ প্রবন্ধে লিখছেন, এক আন্তর্জাতিক মানের ব্যক্তিত্বকে, মননকে, চিন্তনকে আমরা আঞ্চলিক 'হিরো' বানিয়ে রেখে দিলাম। সত্যিই এ বড় আফসোসের কথা।
‘কালান্তর’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘শিক্ষা’, ‘স্বদেশ’, ‘আত্মশক্তি’ ইত্যাদি প্রবন্ধ, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, বৈজ্ঞানিক প্রমুখ চিন্তাবিদদের সাথে আলাপ আলোচনার পত্রাবলীসমূহ, বিভিন্ন বিষয়ে দেশে বিদেশে দেওয়া ভাষণ – এর কোনোটাই কি আজ প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে? না, হারায় নি।
তাঁর অর্থনীতি, সমাজনীতি, কৃষি, শিক্ষা, ধর্ম, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ক প্রবন্ধগুলো আজও জ্বলজ্বল করে জ্বলছে স্বমহিমায়, সপ্রাসঙ্গিকতায়। দুর্ভাগ্য তা দুই মলাটের মধ্যেই আটকে থাকছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ কেউ হয়তো উচ্চশিক্ষায় ডিগ্রী লাভ করতে তার একমাত্র উপযোগীতা বুঝছেন।
আমার বরাবর মনে হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে বিশ্বের অন্য স্বাধীনতা সংগ্রামগুলোর একটা বড় ফারাক আছে। আমরা শুধু বিদেশী শাসনের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য লড়াই করিনি, আমরা লড়াই করেছিলাম যুগ যুগ ধরে জমে থাকা অন্ধকার, কুসংস্কারগুলোর থেকে সমগ্র জাতটাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। না হলে মহাত্মাজীর কি দায় পড়েছিল বিহারে কোন গ্রামে লোকে কি অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় শৌচকার্য্য করে তার সংস্কারের জন্য, চেতনা আনার জন্য উঠে পড়ে লাগা? এরকম উদাহরণ অজস্র আছে, সেটা অন্য প্রসঙ্গ। মহাত্মাজীর সেই আত্মবিকাশের কাজেও গুরুদেব ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘গুরুদেব’ কথাটা ওনার সৌজন্যতামূলক পোশাকী সম্বোধন ছিল না। যদিও মতবিরোধও কম হত না। সেই দেশ গড়ার কাজের সংক্ষিপ্ত বিবরণ পূর্বে উল্লিখিত ঐতিহাসিকের বিখ্যাত গ্রন্থ, ‘THE MAKERS OF MODERN INDIA’-তে অনবদ্যভাবে লেখা আছে।
এসব কি হারিয়ে যাবে? কটা গান, আর কবিতায় মানুষটাকে বেঁধে দেব? আরো বিপজ্জনক কাণ্ড দেখছি ইদানীং আমাদের বিদ্বদগণদের মধ্যে। তাঁরা ইদানীং অতিমানবিক গবেষণায় মেতে উঠেছেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। তাঁর সাথে তাঁর বৌদির ঠিক কি ধরণের সম্পর্ক ছিল, কার কার স্তনে পিঠে কিভাবে কখন ঠিক কোন সময়ে হাত রেখেছেন, এমনকি কাল্পনিক সুইসাইড নোটও লেখা হয়ে যাচ্ছে। হলঘর ভাড়া করে চিত্রনাট্য লিখে অনুষ্ঠান, চলচ্চিত্রও হয়ে যাচ্ছে। হায় রে পোকায় খাওয়া পঙ্গু মস্তিস্ক সব! গু-ঘাঁটা স্বভাব আর যাবে কোথায়! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব এহেন পণ্ডিতদের শকুনের সাথে তুলনা করতেন। বলতেন, শকুন যতই উঁচুতে উড়ুক, দৃষ্টি থাকবে সেই ভাগাড়েই। দাদা, রবীন্দ্রনাথকে দেবতা বা অপদেবতা - কোনোটা বানাবারই খুব দরকার কি??
ছোট মুখে বড় কথা বলে ফেললাম অনেক। মার্জনা করবেন। কি করব বলুন, সোনার খনি ছেড়ে আর কতদিন আস্তাকুড় ঘেঁটে দিন কাটাব বলতে পারেন?
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, না হয় শঙ্খ ঘোষ আমার সঠিক মনে নেই, একবার পঁচিশে বৈশাখ দূরদর্শনের একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'রবীন্দ্রনাথ আমাদের কুয়ো থেকে তুলে দূরে ছুঁড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন, মানুষ করতে চেয়েছিলেন। আমরা প্রত্যেক পঁচিশে বৈশাখ সেই গর্তটা থেকে বেরোই, আবার সারাটা বছর সেই গর্তে এক পা এক পা করে এসে সেঁধোই।'
শেষে দু’হাত জোড় করে বলি...
“অন্ধজনে দেহ আলো, মৃতজনে দেহ প্রাণ”
(ছবিঃ সুমন দাস)
[ অধিক বিবরণঃ
Why Tagore - Ramchandra Guha
http://indiatogether.org/tagore-op-ed ]