তিনি কোনো ভারতীয় পুরষ্কার পাননি। তাঁকে বহু শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত ভারতীয় চিনতেন না। সে বড় কথা নয়, কৈলাস সত্যার্থীকেও সিংহভাগ ভারতীয় চিনতেন না, তিনি নোবেল পাওয়ার আগে অবধি। আমাদের পত্রপত্রিকাতেও বড় করে কোনো প্রতিবেদন আমি অন্তত পড়িনি। সেও বড় কথা নয়, ওসব নিয়ে লিখলে পড়বে কে?
এখন বাঙালি হিসাবে লজ্জার এত কিছু আছে যে এটা আলাদা করে ভাবার কিছু নেই। আমাদের একটা একটা শব্দ ইংরাজি শব্দের স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে। যেমন করে ভাঙনে বাড়ি নদীর স্রোতে তলিয়ে যায়, আজকাল প্রচুর ভিডিও দেখা যায়, তেমনই। ইংরাজি ভাষাকে ভালোবেসেছি বলে যে হয়েছে তা ঠিক নয়। ইংরেজি ভাষার মার্কেট অনেক বড়, তাই। কাল যদি হিন্দি ভাষাও কোনো ক্রমে এরকম মার্কেট ধরে ফেলে, যা ধীরে ধীরে ঘটছেও, আমাদের হিন্দির জলে ভেসে যেতেও অসুবিধা হবে না। ধীরে ধীরে তা যে হচ্ছেও আইটি ইত্যাদি ফিল্ডের ছেলেমেয়েরা বুঝতে পারছে। যেমন কোনো এক রাজ্যে হিন্দিতে ডাক্তারি পড়ানো নিয়ে আমরা যতই ব্যঙ্গ করি না কেন, এটা তো সত্য তারা অতটা ভাবতেও পেরেছে। আমরা তো ভাবতেও পারি না। বাংলায় ডাক্তারি!! হয় না, হয় না, হয় না। যেমন অভিজিতবাবু নোবেল পাওয়ার পর বললেন, তিনি যে বিষয়ে বই লেখেন সেই বিষয়ে বাংলায় বই লেখা যায় না।
দুদিন আগে কলেজস্ট্রিট গিয়েছিলাম। কিভাবে বাংলা বইগুলো ইংরাজি বই আর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার বইয়ের তলায় হারিয়ে যাচ্ছে, তাই দেখলাম। যেভাবে আমাদের ভাষায় গান, ওয়েবসিরিজ আমাদের আর টানছে না, হয় তো আমাদের ভাষার লেখাও টানছে না। অবশ্য আর কয়েক দশক পরে বাংলা মিডিয়ায় পড়া ছেলেমেয়ে ছাত্র খুঁজতে আতসকাঁচ লাগবে।
সেদিন একজন অত্যন্ত গুণী, শ্রদ্ধেয় মানুষের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম খুশবন্ত সিং যেমন অসামান্য একটা বই লিখেছেন শিখেদের ইতিহাস নিয়ে, তেমন মহাপ্রভু ও তারপর বাংলা সমাজের উপর প্রভাবের ধারাবাহিকতা নিয়ে কোনো প্রামাণ্য বই আছে কিনা। কিছু পড়েছি যা আমার খুব ভালো লাগেনি।
তিনি অত্যন্ত ক্ষোভ আর দুঃখের সঙ্গে জানালেন, লেখা হয়নি। তিনি বাংলা সাহিত্য ও সমাজ নিয়ে পড়াশোনা করা এমন একজন মানুষ যে তাঁকে বিশ্বাস করা ছাড়া আমার উপায় রইল না। আর নিজের অভিজ্ঞতাতেও দেখেছি খুব তথ্যসমৃদ্ধ বই সত্যিই নেই। অথচ সেই সময়ে ভাষা ও সমাজে কি দারুণ জোয়ার এসেছিল। অনেকের মতে বাংলার নবজাগরণ বলতে যা বোঝায় সেদিনই তা ঘটেছিল। কিন্তু নিত্যানন্দের বাংলায় অবদানের উপর বই, কি গবেষণা সে অর্থে কই? মহাপ্রভু কিভাবে মারা গেলেন সে নিয়ে কত রোমাঞ্চকর বই। কিন্তু বাংলায় ধারাবাহিক প্রভাব নিয়ে? সে অর্থে সত্যিই কিছু নেই।
শ্রদ্ধেয় দিলীপ মহলানবীশের চিকিৎসকেরাও নাকি জানতেন না, তিনি কে ছিলেন। পেপারে এমনই পড়লাম। যদিও আমি সৌভাগ্যবান যে আমার এক চিকিৎসক বন্ধুর কাছেই আমি ওঁর অবদানের গল্প শুনেছিলাম।
আমি যেহেতু শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িয়ে তাই প্রতিদিন সাক্ষী থাকি কি নিদারুণভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম নিজের শিকড় থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সরিয়ে দেওয়া হচ্ছেও বলা যায়। "আপনি বাংলা গান শোনেন?", " আপনি বাংলা সিনেমা দেখেন?", "আপনি বাংলা বই পড়েন!"। এ তো শুনতেই হয়।
একদিন হয় তো আর কেউ বাংলায় লিখবে না, গাইবে না। কথা হয় তো বলবে। বাঙালি আন্তর্জাতিক হবে না, বাঙালি জগাখিচুড়ি হবে। আজ যেমন বিজয়ার প্রণাম, চিঠি, বাড়ি যাওয়া সব উঠে গেছে, এত তাড়াতাড়ি, এত নিঃশব্দে, এত বিনা বিপ্লবে…এভাবেই একটা একটা করে ইট খসে যাবে।
এতে ভয়ের কিছু নেই। মানুষ যদ্দিন থাকবে আমরাও নিশ্চয়ই থাকব। অন্য ভাষায়, অন্য পরিচয়ে। তাকে উন্নতি না বৈচিত্র্য বলা হবে সে নিয়ে হয় তো তর্কও হবে, হিন্দি বা ইংরাজি নয় তো তামিলে। আমাদের অসুবিধা হবে না। আমাদের আন্তর্জাতিক সত্তাটুকু শুধু বাঁচিয়ে রাখতে হবে যে করেই হোক। জগত যাকে নোবেল দেয়নি, জগত যাকে গ্র্যামি দেয়নি, অস্কার দেয়নি তাকে নিয়ে বাঙালি মাথা ঘামায় না, যদি না সে আবার বিশেষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকে। তসলিমা তো বিদেশে গিয়ে নির্বাসিত। শম্ভু মিত্রকে তো আমরা এই মাটিতেই নির্বাসিত হতে বাধ্য করেছিলাম। আর বিদ্যাসাগরের কথা আর কি বলব! রবীন্দ্রনাথও চিঠিতে লিখেছিলেন তিনি আর এ দেশে বাঙালি হয়ে জন্মাতে চান না!
যা হোক স্বীকৃতি শেষ কথা নয়। যারা এসব কাজে নিয়োজিত থাকেন তারা বসার ঘরে সার্টিফিকেট আর পুরষ্কার সাজাবেন বলে তো আর করেন না। ভালো কাজের প্রসন্নতা চিত্তে আপনিই জন্মায়। অবহেলায় সেখানে খেদ বা ক্ষোভ জন্মায় না। অভিমান জন্মাতেই পারে। কিন্তু কাজটুকুকেও সঠিকভাবে করতে না দিয়ে টেস্ট টিউব সন্তানের ভারতের জনক শ্রদ্ধেয় সুভাষবাবুর মত মানুষকে আত্মহত্যার রাস্তাতেও তো আমরা ঠেলেছি। ভুলেছিও। তাও আজকাল কিছু কিছু বইয়ে ওনার নাম দেখি।
শেওলা স্রোতবাসী। তার মূল নেই, ঘর নেই। আমরা ক্রমশ সেই অর্থেই মূল হারাচ্ছি। স্রোতে ভাসছি। বাংলা প্রাবন্ধিক হারাচ্ছি। এইটা আমাকে ভীষণ পীড়া দেয়। আমরা রাতদিন প্রাসঙ্গিক নিবন্ধ পড়ে যাচ্ছি খবরের কাগজে, পত্রিকাতে। কিন্তু এত প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকাও তো একটা সীমাবদ্ধতা। আমরা আমাদের তাৎক্ষণিক বর্তমানের বাইরে গিয়ে কেন প্রবন্ধ লিখতে পারছি না আজকাল! অশীন দাশগুপ্ত, অম্লান দত্ত, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, শিবনারায়ণ রায়, হোসেনুর রহমন, আবু সৈয়দ আইয়ুব, দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় প্রমুখদের মত প্রাবন্ধিকেরা কোথায়? আমাদের ভাষায় মনন যেন আর ভাষা পায় না। সব শক্তি যেন শুধু খবর আর তাৎক্ষণিকতাতেই ক্ষমতা নিঃশেষ করে নিজেকে শেষ করে ফেলছে।
ইতিহাস ভুললে ভার কমে। দায় কমে। ক্ষুদ্র হতে বাধা থাকে না। কোনো সঙ্কোচ থাকে না। কিন্তু সমস্যা হল ঝড় উঠলে ছিন্নমূলেরাই আগে উড়ে যায়। শেষ হয়ে যায়। আমাদের শারীরিক বৈশিষ্টবহনকারী জিন হয় তো থেকে যাবে কোনো না কোনোভাবে প্রকৃতিতে, কিন্তু আমাদের চিন্তাভাবনারা যাদুঘরের ধুলোয় ঢাকতে ঢাকতে একদিন এত নীচে তলিয়ে যাবে ইতিহাসও হয় তো মনে রাখবে না।