Skip to main content

 

যা জানলাম, না জানলে কী হত?

যা দেখলাম, না দেখলে কী হত?

জানার আগে বেশি শান্তিতে ছিলাম? না জানার পর শান্তিটা বিঘ্নিত হল?

দেখার আগে মানসিক অবস্থা যা ছিল, এখন তার চাইতে খারাপ, না ভালো?

এ প্রশ্নগুলো বারবার করতে হবে। যতবার হাতে মোবাইল নিচ্ছি - রিল, শর্টস, নানা পোস্ট, ছবি, তথ্য ইত্যাদি ইত্যাদি যা কিছুই দেখি না কেন…..এ প্রশ্নটা বারবার করতেই হবে।

হাতে মোবাইল তুলে নেওয়াটা অভ্যাস। বুড়ো আঙুলের চলনটা অভ্যাস। চোখ আর কানের “অন মোড” এ থাকাটা অভ্যাস। কোনোটাই এগুলো এখন আর সিদ্ধান্ত নয়। হাতে তুলে নিলেই অভ্যাস “অন মোড” এ চলে এলো। চারপাশ ঝাপসা। আসলে চোখেরও তো মনের মত একটা উপযোজন বা অ্যাকোমোডেশান ক্ষমতা আছে। চোখের সামনে রাখা তর্জনীর দিকে দৃষ্টি নিবেশ করলে যেমন চার পা দূরের জিনিস ঝাপসা, আবার দশ পা দূরের জিনিসের দিকে তাকালে যেমন কোলের উপর রাখা বইয়ের মলাট ঝাপসা, মনের বেলাতেও তো তেমন। কাকে কাছে রাখি, কাকে দূরে…. এ একটা সিদ্ধান্ত। আমার সিদ্ধান্ত।

কিন্তু মোবাইলটা হাতে তুলে নেওয়া থেকে শুরু করে বাকিটা আমার সিদ্ধান্ত নয় আর, বাকিটা অভ্যাস।

খারাপ সিদ্ধান্ত আর ভালো সিদ্ধান্তের একটা হিসাবনিকাশ আছে। পরিশোধন, পরিমার্জনের একটা ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু অচেতন অভ্যাসের কোনোটাই সুবিধার না। কেউ কথা বললেই যদি অজান্তেই শাস্ত্রের শ্লোক আওড়ায় সে যেমন সুবিধার না, তেমনই কেউ মুখ খুললেই যে গালিগালাজ শুরু করে, সেও সুবিধার না। আসলে কোনো কিছুর উপর অগোছালো চৈতন্যটাই ভয়ানক খারাপ। “আপনিই হয়ে যায়” - এমন জিনিস ক্ষতিই বেশি করে।

সমস্যা হল আরো চাট্টি নানা অভ্যাসের একটা দেশ-কাল-পাত্র সাক্ষীসাবুদ আছে। কিন্তু মোবাইল আর আমার মধ্যে আমার আঙুলের নখ আর চামড়ার মধ্যে যে ফাঁক তেমনই তো ফাঁক। বলা যায় মোবাইলের স্ক্রিন মনেরই একটা এক্সটেন্ডেড অঙ্গ। আমি মনে মনে কী চিন্তা করছি যেমন কেউ টের পায় না, ঠিক তেমন এই মুহূর্তে আমার মোবাইল স্ক্রিনে মনের কোন রস দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কেউ জানে না। কেউ এলেই টুক করে সরিয়ে দেওয়া যায়। আড়ালের এমন প্রবল সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়ে আমাদের খুব একটা সুবিধা হচ্ছে কী না এটা দেখতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এ আড়ালের নেশা এত এত প্রবল দেখছি যে রীতিমতো আতঙ্ক লাগে। তাদের সব “লক” করা। হোয়াটসঅ্যাপ থেকে গ্যালারি ইত্যাদি যা কিছু। আমি এগুলোকে ‘'প্রাইভেসি’’ র অজুহাতে চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু মজার কথাটা হল মানুষ কখনও গোটাটা ‘'প্রাইভেট’’ সত্তা না। সেদিকে ভার বেশি জমলে অন্যদিকে সাম্যের সমস্যা হবে। সে হচ্ছেও। আড়ালের পর আড়াল জমে মনের থেকে স্বাভাবিক আর অস্বাভাবিকের, স্বাস্থ্যকর আর অস্বাস্থ্যকরের সীমারেখা পাতলা করে দিচ্ছে। এ বড় ভাবনার।

আমি আছি। আমার দায়িত্ব আছে। আমার এই একটা হালে আমদানি ‘মোবাইল অভ্যাস’ আছে। বেশি গোলমাল দেখলেই আমার এই মোবাইল অভ্যাসকে একটা ইশারা দিলেই হবে। মুহূর্তে ‘আমি’ নেই। সে ডুবে গেছে। ব্যস, আমি নেই, তাই আমার সমস্যাও আর নেই।

এমন প্রকাণ্ড তথ্যনুৎপাতের আয়োজন জগতের ইতিহাসে আগে ছিল না। এক মিনিটে দর্শন থেকে রান্না, ভক্তিরস থেকে আদিরস, জ্ঞানগর্ভ আলোচনা থেকে কলতলার ঝগড়াঝাঁটি, নিষিদ্ধপল্লীর স্বাদ থেকে মহাকাশের বিস্ময়…. সব এক কয়েক মুহূর্তে। বিস্ময়…বিস্ময়…. বিস্ময়…. .বিষাদ…. বিষাদ…. বিষাদ…।

একটা বিরাম দরকার। ব্যস। আর কিচ্ছু না। শুধু একটা বিরাম। ব্যস। কিচ্ছু ছাড়াছাড়ির দরকার নেই। বিরাম। সেই বিরামে আমি আমার চারপাশের দিকে তাকাই। মনের উপযোজন বা অ্যাকোমোডেশান ক্ষমতাটা ঠিক করি আবার। কাছের জিনিস আর দূরের জিনিস, নাগালের জিনিস আর না-নাগালের জিনিসের মধ্যে পার্থক্যটা স্বচ্ছ করে নিই আবার।

তার জন্য, ওই একটাই জিনিস একটু দরকার। বিরাম। আর বিরামের আগে ওই দুটো প্রশ্ন….

মোবাইলটা অভ্যাসগতভাবে দেখার আগে ভালো ছিলাম, না দেখার পর ভালো আছি।

তথ্যনুৎপাতের সামনে দাঁড়ানোর আগে সাড় বেশি ছিল, না এখন?

কারণ সমস্যা-ঝুটঝামেলার বোধ আছে মানে এখনও মনে সাড় আছে। দীর্ঘক্ষণ তথ্যনুৎপাতের সামনে দাঁড়ালে গোটা সত্তা অবশ হয়ে যায়। কোনো সাড় থাকে না। সেটা স্বাস্থ্যকর কিছু নয়।

একটু শান্ত হই। ততটাই খাই যতটা সহজে হজম করতে পারি। এত এত জানার দরকার কী?