পার্থ দে আর কঙ্কাল। আলাদা করে কিছু বলার নেই। রোমহর্ষক, ভয়ংকর, রহস্যজনক সন্দেহ নেই।
যে বিষয়ে কিছু কথা মাথার মধ্যে ঘোঁট পাকাচ্ছে সেই কথাগুলো বলে ফেলতে চাই।
পুরো ঘটনাটায় দুটো শব্দ খুব ঘুরে ফিরে আসছে- এক, আধ্যাত্মিকতা; দুই, যৌনতা, বা আরো স্পষ্ট করে বললে ভালো - বিকৃত যৌনতা।
ইতিহাস ও বর্তমান দুই-ই সাক্ষী, এই দুটো শব্দ, অর্থাৎ যৌনতা ও আধ্যাত্মিকতা খুব কাছাকাছি অবস্থান করে। আপাত দৃষ্টিতে যেন এ দুটো একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। যেখানে যৌনতা সেখানে আধ্যাত্মিকতা থাকবে না আর যেখানে আধ্যাত্মিকতা, সেখানে যৌনতা নিষিদ্ধ। এটা একটা লিখিত-অলিখিত প্রথা। তাই চিরকালই, সাধুর যৌন কেলেঙ্কারীর ঘটনা যতটা জনরোচক, গৃহীর ততটা না।
এই আধ্যাত্মবিদ্যায় দুটো স্পষ্ট ধারা দেখেছি। এক, যেখানে মানুষ নিজের মধ্যে একটা WHOLENESS বা সর্বময়তা বা সার্বজনীনতা খুঁজছে। যাকে আত্মোপলব্ধি বা মুক্তি বলা যাচ্ছে। আরেকটা বাস্তব জগৎ থেকে সরে গিয়ে কিছু অলৌকিক শক্তি, অতিপ্রাকৃতিক উপলব্ধির ইচ্ছায় (লোভে?) জীবনকে বিপন্ন করে তোলা।
ধরা যাক, প্রথমটার নাম দিলাম 'আত্মিক আধ্যাত্মিকতা'; দ্বিতীয়টার নাম দিলাম 'ছদ্ম-আধ্যাত্মিকতা', এর আরেকটা নামও অবশ্য আছে, 'গুপ্তবিদ্যা' বা OCCULT SPIRITULALITY.
আত্মিক আধ্যাত্মবিদ্যায় কোনো গুপ্ততত্ত্বের স্থান নেই। সেখানে নির্জনতার গুরুত্ব আছে কিছু ক্ষেত্রে। সেখানে মানসিক বিশ্লেষণের গুরুত্ব আছে। মানবিক সদ্-গুণগুলোর চর্চা সেখানে প্রধান। আদিকালের বুদ্ধ, সক্রেটিস, যীশু, কনফুসিয়াস থেকে মধ্যযুগের চৈতন্যদেব, মীরা, নানক হয়ে আধুনিক কালের বিবেকানন্দ, অরবিন্দ, টেরেসা, গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, জে কৃষ্ণমূর্তি - সব এই আলোকিত পথের যাত্রী। বাইবেল, অরেলিয়াসের মেডিটেশান, প্লেটোর ডায়ালগ, গীতা-উপনিষদ থেকে শুরু করে চৈতন্যচরিতামৃত, কথামৃত, শান্তিনিকেতন, গীতবিতান - সব এই আলোর দিশারী।
এ পথের মুল কথা হল, নিজেকে প্রেমে, জ্ঞানে, সত্যে বিস্তার করো। ভালো হও। নিজের মধ্যের পাশবিক প্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ আনো। এখানে ঈশ্বর অলৌকিক নন, এখানে তিনি সমষ্টির প্রতীক। আমার মধ্যের বিবেকের চালক। আমার প্রাপ্ত আলোর, শুদ্ধতার প্রেরণা। এর একমাত্র উদ্দেশ্য - চিত্তশুদ্ধি।
অন্যদিকে আসে ছদ্ম-আধ্যাত্মিকতা। এখানে কিছু একটা 'পাওয়াটা'ই আসল কথা। অতি-প্রাকৃতিক অনুভুতি, অলৌকিক শক্তির মোহ - মানুষের সাধারণ বুদ্ধি, বিবেক, ইত্যাদি সব নাশ করতে থাকে। তার স্বভাবকে বিকৃত করে। আর যেখানে পুরো স্বভাবটাই বিকৃতির পথে চালিত, সেখানে আর যৌনতাটা সুস্থ থাকে কি করে? তার সাথে আমাদের মত সমাজে, যেখানে যৌন আলোচনাও কয়েক দশক আগে নিষিদ্ধ ছিল (আজও কতটা স্বাভাবিক সন্দেহ, শুনেছি এখনো স্কুলের শিক্ষকেরা ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে এহেন 'বড়দের কথা' বলতে ভীষণ সঙ্কুচিত হয়ে যান) সেখানে সদ্য বয়ঃপ্রাপ্ত কিশোরের মত আমাদের সমাজও অতি আগ্রহ, কখনো অশালীন আগ্রহও দেখিয়ে ফেলছে।
এই ছদ্ম-আধ্যত্মিকতা ও আত্ম-আধ্যাত্মিকতার মধ্যে বিভেদটি খুব স্থুল নয়। সাধারণ বুদ্ধিতে দুইয়ে মিশে একাকার - জগাখিচুড়ি আধ্যাত্মিকতা। সেখানে মঠ, মন্দির, জ্যোতিষী, মারণ-উচাটন সব মিলেমিশে একপাত্রে। এরমধ্যে থেকে বিশুদ্ধ আত্মোন্নতির পথটা খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। গুলিয়ে যাওয়ার প্রভূত সম্ভবনা। আর তার উপর দুর্বল চিত্ত হলে তো সোনায় সোহাগা। কারণ দুর্বলের ক্ষেত্রে আকর্ষণের বেগটাই প্রধান, দিকটা না।
দেবযানী একটা মঠে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। সেখান থেকে ডাকযোগে যোগ সাধনার শিক্ষা নিতেন, যা সম্পূর্ণ গুপ্ত। কিন্তু তা কতটা বৈজ্ঞানিক, কতটা নিরাপদ কে তা বিচার করবে? আমার ভয় হয় এরকম কত দেবযানী এখনো এরকম বহু আশ্রমে যাচ্ছেন, ঈশ্বর দর্শনের কোর্স করছেন আর কল্পসাগরে ভেসে জীবন বিপন্ন করছেন। আরো কত পার্থ দে এ ধরণের মানসিক বিকারের পথে নিজের অজ্ঞাতসারে এগিয়ে চলেছেন কে জানে? অথচ এঁরা কেউই অশিক্ষিত বা সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর নন। তা হলে সমস্যাটা কোথায়?
খেয়াল করে দেখবেন, আমাদের সমাজে মুখচোরা, অস্বাভাবিক শান্ত ইত্যাদি ছেলেমেয়েকে বেশ প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখা হয়। "আমার ছেলে একদম অন্যরকম, সাত চড়ে রা কাড়ে না, মেয়েদের দিকে তাকায় না মোটেই"। তিনি ভাবেন না, তাঁর ছেলে বা মেয়ে সমকামী কিনা, বা অন্য কোনো মানসিক সমস্যা আছে কি না। এরকম অজস্র উদাহরণ আপনার আমার জানা আছে। "মানসিক চিকিৎসা তো পাগলের জন্য, যা ব্বাবা, আমি পাগল নাকি!" - এ সংলাপও চিরপরিচিত।
আজ ডায়াবেটিস, AIDS, পোলিও, ক্যানসারের মত মানসিক রোগ নিয়ে আলোচনাও যথেষ্ট জরুরী। বরং বেশি জরুরী। কারণ একটা রোগগ্রস্থ মন পুরো পরিবেশটাই রোগগ্রস্থ করে তোলে।
যে নিজের কাছে নিজে নিরাপদ, সুস্থ না, সে সমাজের কাছে কোনোদিন নিরাপদ ও সুস্থ নাগরিকত্বের দায়িত্ব বহন করতে পারে না। আমাদের আরো সচেতন হওয়াটা খুব জরুরী তাই।
যাকেই দেখা যাচ্ছে সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন বা যার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, দায়িত্ব নিয়ে তার পাশে দাঁড়ানো দরকার। আজ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের উপস্থিতি ও পরামর্শ স্কুল, কর্মক্ষেত্রে অত্যাবশ্যক হওয়া উচিৎ।
ভবিষ্যতে আরো এরকম ভয়ঙ্কর ঘটনা থেকে সমাজকে মুক্ত রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার।