Skip to main content

চেতনা মানে ড্যাবডেবিয়ে খবরের কাগজ গেলা বা ব্রেকিং নিউজে হাবুডুবু খাওয়াই শুধু নয়। চেতনা মানে গুচ্ছের তথ্য মুখস্থ করে পরীক্ষা পাশ দেওয়াও নয়। চেতনা মানে জেগে থাকা, তাকিয়ে দেখা, কানে শোনা, চেখে দেখা, ছুঁয়ে বোঝাও শুধু নয়। চেতনা মানে অনুকম্পাও। চেতনা মানে সহমর্মিতাও।

আমার মর্ম যখন তোমার মর্মকে বুঝতে চায়, যে আলো গিয়ে তা সম্ভব করে সেও চেতনা। কার খিদে পেল, কে ব্যথা পেল, পাশের মানুষটার সুবিধা অসুবিধা বোঝাও চেতনা। সে চেতনা জাগার অনেক বাধা আছে। তার মধ্যে অহংকার যেমন, তেমনই আরেকটা হল হীনমন্যতা।

যে মানুষ সব সময় লো সেল্ফ এস্টিমে কষ্ট পায়, সে আর চারপাশে তাকাবে কি করে? সে শুধু 'আমি ঠিক আছি' এইটাই বোঝাতে চায়। এই 'বোঝাতে চায়', 'দেখাতে চায়' এইখানেই যত গোলমাল। মানে সে নিজে তা নয়, সবটাই ওই চাওয়াচাওয়ি।

লো সেল্ফ-এস্টিম তৈরি করতে পরিবেশ আর বাবা-মায়ের ভূমিকা অসামান্য। বিশেষ করে যে সব বাবা-মায়েরা নিজেদের অপরাজেয় পার্ফেক্ট মানুষ বিবেচনা করেন তাদের সন্তানদের এ দুর্গতি হয় সবচাইতে বেশি। যখন বাবা বা মা সবসময় সবকিছুতে নিজেকে প্রশ্নাতীতভাবে নির্ভুল ভাবতে শুরু করেছেন, তখন একই ছাদের তলায় বড় হওয়া আরেকটা প্রাণী ভিন্নমত পোষণ করলেই নিশ্চয়ই সে ভুল হবে। তাকে সেটা বুঝিয়েও দিতে হবে যে সে ভুল। কেন ভুল? যুক্তি একটাই, কারণ 'আমি' কখনও ভুল হতেই পারি না! এটা সবসময় মনে রাখবে, বাবা কখনও ভুল হন না। মা কখনও ভুল হন না।

আমি এমন বাবাও দেখেছি যিনি নিজেকে ঈশ্বরের অবতার দাবী করেন। বাবা ঈশ্বর হলে বাড়ির বাকিরা তো অনীশ্বর হতে বাধ্য। এক বাড়িতে ক'টা ঈশ্বর থাকবে! অতএব তিনি যা বলেন তাই ধ্রুবসত্য জেনে বাড়ির সবাই শিরোধার্য করেন। এই পরিবেশে সন্তান বড় হতে হতে অনুভব করে তার বিচার, যুক্তি, ইচ্ছা, অনুভব, বিশ্বাস সব ভুল। বাবা-ই ঠিক। অতএব অন্ধভাবে বাবা যা বলে চলেছেন তা-ই চালিয়ে যাও। বাবাও চালাক মানুষ। ছেলের দুর্বলতার খোঁজ রাখেন। ছেলের দুর্বলতাকেগুলোকে প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে নিজের অবতারত্ব কায়েমি রাখেন। পাড়াপ্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বারবার বলেন, ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে একি ছেলেখেলা করছেন! বাবা নিশ্চিন্ত মনে বলেন, ও সব ঠিক হয়ে যাবে। কিছুই ঠিক হয় না। ছেলে মেরুদণ্ডহীন নেশাখোর তৈরি হয়। বাবা টাকা জুগিয়ে যান। ছেলের বাবার প্রতি অন্ধভক্তি। ছেলের সংসার হয়। ভেঙে যায়। একদিন ছেলেও কালের অন্ধকারে হারিয়ে যায়।

এই সব বাবাদের কোনো শাস্তি হয় না। যারা দিনের পর দিন নিজের সন্তানদের উপর এইরকম অস্বাভাবিক এক্সপেরিমেন্ট করেন, নিজের অস্বাস্থ্যকর মানসিকতার শিকার তৈরি করেন, তাদের নিতান্তই দুর্ভাগা ছাড়া আর কি-ই বা বলা যায়!

এই লো সেল্ফ-এস্টিম তৈরির আরো কারণ থাকতে পারে। বারবার টিজ করা শিক্ষক, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনেরাও হতে পারে। সবার মানসিক গঠন সমান হয় না। কেউ কেউ অতিরিক্ত সংবেদনশীল হয়। ক্ষতিটা তাদের উপর হয় দীর্ঘস্থায়ী।

এখন এই লো সেল্ফ-এস্টিমকে দূর করার উপায় কি?

প্রথম কথা, অন্যায্য, অযৌক্তিক, অবাস্তব অপরাধবোধ থেকে মুক্ত করা।

এর জন্যে একজন বন্ধুস্থানীয় মানুষের সাহচর্য খুব কাজের। সে বিচার করবে না, তিরস্কার করবে না। সে শুনবে। যে কোনো অবাস্তব, অযৌক্তিক, অন্যায্য অপরাধবোধের সঙ্গে একটা ধোঁয়াশা ভাব থাকেই। কনফিউশান থাকেই। সেই কনফিউশানটাই তার মনোজগতে প্রবেশের পথ। তার কাছে আসার উপায়। তাকে বিশ্বাস করাতে হবে সে এমন কিছু করেনি যা অস্বাভাবিক। যদিও তাকে তা বিশ্বাস করতে শেখানো হয়েছে ভীষণ চতুরতার সঙ্গে।

দ্বিতীয়ত, তার পজিটিভ দিকগুলো খুঁজে বার করা। এ ক্ষেত্রেও একজন সহানুভূতিশীল মানুষের বন্ধুত্ব বিশেষ কার্যকরী। মানুষের সদগুণ খুঁজে বার করতে চাওয়া আর চোখে পড়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। অন্যের দোষ যত সহজে চোখে পড়ে, না চাইলেও দেখা যায়, অন্যের গুণ অত সহজে চোখে পড়তেই চায় না। নিজের গুণাবলীর প্রতি এমন মোহ আমাদের।

তাই এমন মানুষের সঙ্গ দরকার, যার চোখে সহজেই তার গুণগুলো চোখে পড়ে। যে তার গুণ আতসকাঁচ লাগিয়ে খুঁজে বেড়ায় না। আর সহজে চোখ পড়ে বলেই সে মানুষটার বিশ্বাসও জন্মায় সহজেই। সে জানে এ বানানো নয়, এ স্বাভাবিকভাবেই তার মধ্যের ভালো দিকগুলোকে জানে। একজন কবির কথা মনে পড়ল, তিনি বলতেন, তুমি ভালো বলে তোমার কাছে আসতে ইচ্ছা করে তা নয়, তোমার কাছে এলে আমার নিজেকে ভালো মনে হয় বলেই আসি। এ বন্ধুত্ব মহার্ঘ্য।

তৃতীয়ত, তাকে অবাস্তব, অযৌক্তিক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, ধ্যানধারণা থেকে মুক্ত করা। অন্যভাবে বলতে গেলে তাকে নানা কুসংস্কার বা মিথ থেকে বাঁচানো। যেমন ভালো হতে গেলে এরকম চাকরি করতে হয়, ঈশ্বরে ভক্তিপরায়ণ হতে হয়, বাবা-মায়ের প্রতি অন্ধ শ্রদ্ধালু হতে হয়, এই এই জিনিসে রুচি থাকতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা নিজেদের যারা খুব বিবেকবান, দায়িত্ববান, পড়াশোনা জানা শিক্ষিত নাগরিক মনে করি আমাদের নিজেদের দিকে তাকালেও দেখব আমাদের মধ্যে নানা মিথে ভরপুর। এগুলোতে নাকি আমাদের ভালো হয়। এ মোহ। এ মিথের মোহ। মিথ আর কুসংস্কারের মধ্যে পার্থক্য হল, মিথের পিছনে একটা দীর্ঘদিন লালিত সামাজিক অপযুক্তির গল্প থাকে। কুসংস্কারে সেটা প্রবল নয়। ভয়টাই প্রবল।

সে মানুষটা যাই হোক না কেন, আস্তিক, নাস্তিক, বামপন্থী, ডানপন্থী, সমকামী, অসমকামী, উভকামী, আবেগপ্রবণ, যুক্তিবাদী যাই হোক না কেন, তাকে নিজেকে স্বীকার করে নেওয়ার উৎসাহটা বন্ধু হয়েই তাকে যোগাতে হবে। তাকে এইভাবেই তার কল্পনার, তার মনগড়া জগতের হাত থেকে সরিয়ে বাস্তবে আনতে হবে। অজ্ঞান থেকে বিজ্ঞানে আনতে হবে।

এইভাবে তার লো সেল্ফ-এস্টিম দূর হবে ধীরে ধীরে। নিজের বোধে নিজে স্বাভাবিক, স্বাধীন গতিমান হবে। তখন তাকে আর বলতে হবে না তুমি চেতনাস্থ হও। সে আপনিই হবে। তার অন্তরাত্মাই তাকে সহমর্মিতার বোধের শিক্ষা দেবে। তার চেতনা আপনিই তখন নানা প্রশ্নে কৌতুহলে নিজেকে বিকশিত করবে। সে সম্পূর্ণ হয়ে উঠবে ধীরে ধীরে।