অত্যাচার দু'রকম হতে পারে। প্রমাণ সাপেক্ষ আর প্রমাণ সাপেক্ষ নয়। যা প্রমাণ সাপেক্ষ তার পরিমাপ নেওয়ার একটা পদ্ধতি আছে। আর যা প্রমাণ সাপেক্ষ নয়, তার স্বাভাবিকভাবেই পরিমাপ করবার কোনো উপায় নেই। প্রমাণ সাপেক্ষ আর প্রমাণ সাপেক্ষ নয়, দুর্নীতির ক্ষেত্রেও একই কথা।
কেউ যখন অপমানিত বোধ করেন অথবা দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন বুঝতে পারেন, তখন তা সবসময় কি তথ্যপ্রমাণ যোগাড় করে প্রমাণ করতে পারেন? না। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
ধরুন আপনি ব্যাঙ্কে গেছেন। একটা কাগজের কাজ, যা ইচ্ছা করলেই ভারপ্রাপ্ত মানুষটি দুটো সই করে আপনার কাজ সেরে দিতে পারেন, তিনি আপনাকে দু'মাস ঘোরালেন। এটা আপনি কোন আইনে ফেলে সেই ভারপ্রাপ্ত মানুষটাকে দোষী সাব্যস্ত করবেন? কোনো আইনেই নয়।
ধরুন আপনি ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের ঘরে ঢুকেছেন। আপনার বয়েস হয়েছে, হাঁটুতে ব্যাথা, দাঁড়াতে পারেন না বেশিক্ষণ। তিনি আপনাকে বসতে বলছেন না। এটাকে আপনি কোন ধারায় ফেলবেন? কোনো ধারাতেই না। এটা বারবার কেন হয়? একটু প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে ব্যাপারটাকে বোঝার চেষ্টা করি।
ক্ষমতার একটা নিজস্ব 'ভার' আছে। সাথে 'দায়' আছে। ভারের দিকটা অহংকারের। দায়ের দিকটা কর্তব্যের। আমি যখন সমাজে কোনো একটা শিক্ষায় (সেটা ওকালতি, শিক্ষকতা, চিকিৎসকতা - যা কিছুই হোক না কেন) একটা স্থান অধিকার করেছি, তখন এই দুটোই আমার উপর এসে বর্তায়। এখন কথা হল কোনটার ব্যাপারে আমি অধিক সচেতন, আমার পদমর্যাদা নিয়ে, না আমার কর্তব্য নিয়ে? এইখানে আসে একজন ব্যক্তির শিক্ষার, বিবেকের, বোধের প্রশ্ন। কেউ যখন বলেন, "আমি ভীষণ চেষ্টা করি...", তখন বুঝতে হবে তার চেষ্টায় যতখানি না আন্তরিকতা তার থেকে শতগুণ বেশি তার চেষ্টা করার দম্ভ। কারণ চেষ্টা কখনোই প্রচণ্ড হয় না, চেষ্টা একজন ঠিক মানুষের কাছে চিরটাকাল অতৃপ্তির অনুভূতি... ইস্... আরেকটু যদি পারতাম। অবশ্যই এটা তখনই সম্ভব যখন সে সেই কাজটাকে ভালোবেসেছে, সেই কাজের মধ্যে নিজের মানবিক উৎকর্ষতাগুলোর বিকাশ হওয়ার সম্ভাবনা দেখেছেন। নইলে একই কর্মক্ষেত্রে একজনের ভীষণ জনপ্রিয়, নির্ভরতার স্থান অন্যজনের থেকে হয়ে ওঠেন কি করে? মজার কথা তিনি নিজের এই ভাবমূর্তিটা সম্বন্ধেও অচেতন থাকেন। কারণ জনপ্রিয় হওয়ারও তো অনেক কৌশল থাকে, যা শুধু জনপ্রিয় হওয়ার উদ্দেশ্যেই পালিত। জনপ্রিয়তা সেখানে বাই-প্রোডাক্ট না। সেটাই মূল উদ্দেশ্য। সুতরাং ঘনীভূত প্রচ্ছন্ন অহং।
যে গাছ যতটা উঁচুতে ওঠে তার ছায়া ততটা দীর্ঘক্ষেত্র জুড়ে প্রসারিত হয় (তবে নারকেলগাছও সংসারে অনেক আছে, এও সত্য)। একটা উক্তি মনে পড়ল। জীবনে নিজের চোখে একজন মহাপুরুষকে দেখেছি – স্বামী রঙ্গনাথানন্দজী। বেলুড় মঠের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি যুবক সন্ন্যাসীদের বলতেন, "দেখো তোমাকে যখন লোকে প্রণাম করেন, তখন তোমায় প্রণাম করেন না এটা মনে রেখো। তাঁরা নব্বই শতাংশ প্রণাম করেন শ্রীরামকৃষ্ণদেব-মা সারদা-স্বামীজিকে, আর দশ শতাংশ প্রণাম করেন তোমার গেরুয়াটাকে। তবেই আর অহংকার আসবার জায়গা পাবে না।" এটা শুধু তো যুবক সন্ন্যাসীর ক্ষেত্রে না, সবক্ষেত্রেই সত্য। সবক্ষেত্রেই তো মানুষ মান দেন হয় আমার পদকে, নয়তো আমার অধীত বিদ্যাকে, অমুক নামধারী ব্যক্তি বিশেষকে তো নয়!
আমার ছোটমাসির কাছে একটা ঘটনা শুনলাম। আমার দাদু ডাক্তার ছিলেন। মাসি একদিন সকালে দাদুকে জলখাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে গিয়ে দেখেন, দাদু বারান্দায় পায়চারি করছেন। সকাল থেকে অনেক রুগী দেখেছেন দাদু। বেলা এগারোটা হয়ে গেছে। দাদুকে বারবার খেতে বলায়, দাদু কিছুটা রেগে গিয়ে বলেন, "আরে বেটা অমুকের আজ ইঞ্জেকশান নিতে আসার কথা, এখনো আসছে না, ও তো মারা পড়বে!”
আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দাদু তাঁর লুনা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। যে রুগীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন, তিনি চাষী। তাঁকে মাঠে গিয়ে ধরেন। উত্তাল গালাগাল করেন, সেই মাঠেই ইঞ্জেকশান দেন, তার বাড়ির লোককে বুঝিয়ে আসেন রোগটা কতটা ভয়ংকর হতে পারে চিকিৎসায় গাফিলতি করলে... তারপর ফিরে এসে জলখাবার খান।
তবে কি এটা সার্বজনীন মনোভাব হতে পারে? কিছুটা তো হয়ই। প্রত্যেক জাতের একটা নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তো থাকেই। না হলে একটা জাত আরেকটা জাতের থেকে এগিয়ে যায় কি করে? আমাদের দেশের উত্তর আর দক্ষিণ ভাগের মধ্যে এতটা আকাশ পাতাল ভেদ হয় কি করে? কোথাও ভালোর ভাগ বেশি খারাপের ভাগ কম, তো কোথাও উল্টোটা।
এ কি অপরিবর্তনীয় তবে? না। এরজন্য আত্মসমালোচনা প্রয়োজন। কি ব্যষ্টিতে, কি সমষ্টিতে আত্মসমালোচনা ব্যতীত উন্নতি অসম্ভব। আমরা যখন ছোট, তখন বাংলা সিনেমার হাল নিয়ে চূড়ান্ত অভিযোগ আসত। ধীরে ধীরে হাল বদলালো। আরেকটা মজার কথা, আমাদের ছোটবেলায় হিন্দী সিনেমা দেখলে তাদের কিছুটা বখাটেদের দলে ধরা হত। আজ সেই হিন্দী সিনেমার হাল দেখুন, 'পিঙ্ক' দেখতে দেখতে সেইটাই ভাবছিলাম, বাংলায় শেষ কবে এরকম একটা সিনেমা দেখেছি?
সন্ত কবীর বলতেন, নিন্দুককে মাথার কাছে নিয়ে শোও। কারণ সেই তোমার উন্নতির পথটা দেখতে সাহায্য করবে। তবে ব্যষ্টিতে যেমন আত্মসমালোচনা মানে শুধু নিজেকে বোঝায়, সমষ্টিতে একটা গোষ্ঠীকে বোঝায়। কোনো একটা বিশেষ রাজনৈতিক দল, অত্যন্ত স্বচ্ছতার দাবী/প্রতিশ্রুতি নিয়ে দল গড়ল। কিছুদিনের মধ্যেই আস্থা হারাতে বসল। তখন কেউ কেউ আত্মপক্ষ সমর্থনে বলল, আরে দেখুন ও ভালো কাজ করছে, সে ভালো কাজ করছে... কিন্তু অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কিছু বলা-কওয়াতে ঢিলেমি আসতে লাগল। কেউ কিছু বললেই পাল্টা তীব্র আক্রমণ আসতে লাগল...জনক্ষোভ রাগে পরিণত হতে থাকল... ক্রমশ নেতা বনাম নাগরিক হতে শুরু করল। এই ‘বনাম’ শব্দটা খুব বিপজ্জনক। জনসাধারণ বনাম যখন কোনো প্রতিষ্ঠান হয়, বুঝতে হবে সেই প্রতিষ্ঠানে বহুদিন ধরেই আগাছা পরিষ্কার করা হয়নি।
সমাজটা ‘বনাম’-এর না, সহযোগিতার। তাই ‘বনাম’ এর উৎসটা যত ক্ষীণ হয়, যত স্বচ্ছ ও মানবিক হয় তত মঙ্গল। তত উন্নতির। কিছু বদলোক সবসময় থাকবে... খারাপ শিক্ষক, খারাপ ডাক্তার, খারাপ উকিল, খারাপ নেতা, খারাপ অফিসার, খারাপ সাধু... থাকবেই... দেখতে হবে তারা যেন পুষ্টি না পায়... আর সে দায় আমাতেই বর্তায়... যতক্ষণ না তাতে সফল হচ্ছি ততক্ষণ কাজলের ঘরে থাকলে কালি তো লাগবেই... যদি পরিবর্তন করতে না পারি, তবে মাথা নীচু করে স্বীকার করে নেব... নিজের বাড়ির ময়লা ফেলতে নিজে যাব, অন্যকে চ্যালেঞ্জ করার আগে... গলাবাজি করে তা ঢাকব না... কারণ একটা ভুল সব অহংকারী লোকই চিরটাকাল করে এসেছে... 'সাধারণ মানুষকে বোকা বানানো যায়।'
যায়, তবে বেশিদিন না। এটা মাথায় রাখতে হবে। আমার প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা রক্ষার দায় আমার, যদি আমি তার কর্মচারী হই। অন্যায়টা যখন হবে তখন চুপ করে বসে থাকব, নানান অজুহাত দেব, আর যখন তার জন-প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে তখন সোচ্চার হয়ে উঠব সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে, এ নিতান্তই ভণ্ডামী। এ দিয়ে সত্যকে ঢাকা সম্ভব না। যখন যুক্তিতে পারব না, তখন ব্যক্তিগত আক্রমণ করব, কিন্তু এ কদ্দিন? জল যে অনেক দূর গড়ালো..