রামায়ণ থেকে যদি বারো বছরের বনবাসের অধ্যায়টি বাদ দেওয়া যায় তবে তাতে যত তত্ত্বকথাই থাকুক না কেন, সেটা মহাকাব্য হয়ে ওঠে না। মহাভারতের বেলাতেও তাই। পঞ্চপাণ্ডব যদি পায়ের উপর পা তুলে রাজত্ব করেই কাটিয়ে দিতেন, তবে যতই তাতে গীতার কালজয়ী উপদেশ থাকুক, তা-ও মহাকাব্য হত না। জীবনের স্বাভাবিক গতিপথের সাথে মিলত না। হত রূপকথা। এমনিই সমস্ত মহাপুরুষের জীবন।
বুদ্ধ এই কথাটাই বললেন, দুঃখ আছে। এটাই প্রথম সত্য। একে স্বীকার করো যদি তবেই বাকি কথাগুলো শোনার যোগ্যতা তোমার আছে। একে অস্বীকার করো যদি, তবে পরে এসো। আরো একটু পরিণত হয়ে এসো।
দুঃখকে বরণ তোমায় করতেই হবে। না হলে ভীরু হয়ে সংসারে থাকতে হবে আড়ালে আড়াল খুঁজে। নানান দেবতা উপদেবতার পায়ে ফুল দিতে দিতে নিজেকে জাগাবার সময়টুকু আর পাবে না। কখনোই নিজেকে চেনা হয়ে উঠবে না আর। তাই বলছি, তুমি এসো, আমার প্রথম সত্যিটা স্বীকার করো, দুঃখ আছে।
বুদ্ধ এই বলে আমাদের ফাঁকি দেওয়ার পথটা বন্ধ করলেন। "আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন" - রবীন্দ্রনাথের একদম জীবন সায়াহ্নে লেখা কবিতায়, সারা জীবনের উপলব্ধি। শুধু সায়াহ্নে না, সারাটা জীবন দুঃখকে স্বীকার করার, বরণ করার দর্শন ওঁর সারা জীবনের লেখায়। নিজের জীবন যাপনেও।
এ কি পেসিমিজম তবে? না। একদমই না। এ আত্মশক্তির উদ্বোধনের কথা। এ কান্নার কথা না। হতাশার কথা না। অন্ধকারের কথা না। এ চলার পথের জয়গান। আমি যে দুঃখের থেকে বড়, সেটা দুঃখকে স্বীকার করে জানাব। তার থেকে এড়িয়ে গিয়ে নয়।
বুদ্ধ যখন কপিলাবস্তুতে রাজপুত্র ছিলেন, সেই বৈভবে, কৃত্রিম সুখ বিলাসময় জীবন যাপনে সত্যকে পাননি।
তিনি পথে নামলেন। মুখোমুখি হলেন দুঃখের। আলোড়িত হল মনপ্রাণ।
উপলব্ধি করলেন, নিজেকে দুঃখের থেকে দূরে রেখে সত্যের সাধন হয় না। ত্যাগ করলেন, পারিবারিক সুখ, রাজ ঐশ্বর্যের সুখ, মানের সুখ, দেহের সুখ।
দুঃখকে বরণ করলেন। বসলেন তপস্যায়। আলো দেখতে পেলেন। তা দুঃখকে এড়িয়ে গিয়ে নয়, দুঃখকে বরণ করেই। মৈত্রীতে, কল্যাণে সে পথ। মৈত্রী, সুখে দুখে। কল্যাণ - সুখে দুখে। উপদেশ দিলেন, অষ্টাঙ্গিক মার্গের। আটটা সত্য নিবন্ধ। যার অনুশাসনে আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কথা। যা দুঃখকে বরণ করেই, তাকে এড়িয়ে গিয়ে নয়।
আজ যে চূড়ান্ত সুখবাদী যুগে আমরা বাস করছি, তাই এটা এত ঠুনকো। এর দর্শন তাই এত ভীরু। তাই এত আস্ফালন তার। এত আত্মহত্যা, এত অবসাদ, এত মানসিক বিকার। যে স্নায়ু আমার সুখ নিয়ে যায়, সেই আমার দুঃখকেও বহন করে। একটার পথ খুলে রেখে আরেকটার পথ কি করে বন্ধ রাখা যায়? যায় না। এটা মানতেই হবে। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, শুধু ন্যায্য দুঃখ বলে কিছু হয় না। ঠিক যেমন বরাদ্দের চাইতে অনেক বেশি সুখ পেলে আমরা হিসাবের খাতা খুলে বসি না, ঠিক সেই রকম।
তাই তথাগত আমাদের একটা সহজ, সরল পথ দিয়ে বললেন, হয় চলো, না হয় স্বপ্নের জাল বুনে বসে থাকো। বললেন, একজন মানুষ সারাটা জীবনে মাত্র দুটো ভুলই করতে পারে - এক, চলা না শুরু করা, দুই, মাঝপথে থেমে যাওয়া।
(ছবিঃ সুমন)