Skip to main content

        আয়না কথা বলে না। সময় কথা বলে না। সকালের আলো, রাতের অন্ধকার কথা বলে না। আশেপাশের পশুপাখিরা শব্দ করে, কিন্তু কথা বলে না। মানুষের সব কথা মানুষকে নিয়ে। কত কথা। নিজেকে নিয়ে কথা, প্রতিবেশীকে নিয়ে কথা। মানুষের আত্মীয় - প্রতিবেশী থেকে ঈশ্বর সবাই, এমনকি মাঝে মাঝে সে নিজেও নিজের প্রতিবেশী, সে নিজেই দূরের আত্মীয়। কথা অনুভবের নদীতে, আবগের ঢেউয়ে ডোবে, ভাসে। কথার ফলা যুক্তির ধারে তীক্ষ্ম হয় - নিজেকে কাটে, পরকে কাটে। কথা আর ফুরায় না। নিজের কথার রসে নিজে ডুবে থাকে মানুষ। মাঝে মাঝে সে রস যখন ওঠে গেঁজিয়ে, ফেলে দেয়। আবার নতুন কথার সাজা আনে, পাতে, ডোবে। মানুষ চায় তার কথার রসে শুধু সে না, অন্যেও ডুবুক। কথা আত্মীয়তা বোনে। মানুষের খোঁজ শুধু শরীরের না, অন্যের মধ্যে নিজেকে খোঁজ, এ এক আজব খোঁজ। নিজের মধ্যে সে অন্যকে খুঁজবে, আবার অন্যের মধ্যে নিজেকে খুঁজবে। কথায় খুঁজবে। যেখানে কথারা অনুভব হয়ে যায় সেখানে খুঁজবে। এ লেখা যখন তুমি পড়ছ, তখন জেনো আসলে আমি আমার কথা দিয়ে তোমার মধ্যে ঢুকতে চাইছি, তোমার মধ্যে নিজেকে দেখতে চাইছি, নিজের মধ্যে তোমায় দেখতে চাইছি। কথা নদী। কথা সুতো। কথা সাঁকো। কথা আকাশ। কথা সমুদ্র। কথা গরল। কথা অমৃত। 
        আমি অমৃত চাই শুধু কে বলল, আমি গরলও চাই। আমার প্রেম আমার গরলামৃত। আমার সারা শরীর মন পুড়িয়ে, ঝাঁঝরা করে যে চলে গেল সে প্রেম। আমার শরীরে সে কেন্নোর মত হাঁটে না, বাজের মত পড়ে, সে কুসুমের মত আদর করে। আমি প্রেমের দোলনা চাই না শুধু, আমি প্রেমের গুহা চাই, প্রেমের জঙ্গল চাই, প্রেমের এভারেস্টের চূড়া চাই, প্রেমের নায়েগ্রা চাই, প্রেমের ভিস্যুভিয়াস চাই। প্রেম আমায় শুদ্ধ করে না, প্রেম আমায় অশুদ্ধ করে না, প্রেম আমায় যাযাবর করে। আমার গায়ে ঘাস হয়ে ওঠে, আমার ছোটো ছোটো পতঙ্গের মত ইচ্ছাকে লালন করে নিজের গর্তে প্রেম। আমার কথা প্রেমে জন্মায়, প্রেমের আঘাতে জন্মায়, প্রেমহীনতায় জন্মায়। কথা আমার হতাশার প্রলেপ, কথা আমার উপবন, কথা আমার বার্ধক্যের যষ্টি। কথা মহাকাল চুঁইয়ে চুঁইয়ে বিন্দু বিন্দু নামে ক্ষণকালের পাত্রে। সরের মত ভাসে। রামধনুর মত ওঠে। ঝরা ফুলের মত ঘাসে শুয়ে থাকে। 
        কিছু কথা বাঁধের ওদিকে থাকে। শক্তি সঞ্চয় করে। তারা বর্ষার অপেক্ষা করে। কিছু কথা মেঘভাঙা বৃষ্টির মত ভাসিয়ে নিয়ে যায়। হঠাৎ বাঁধ ভেঙে যায়। যুদ্ধ বেধে যায়। কথার আঘাতে কথারা শুয়ে, আহতের আর্তনাদে দেওয়ালের টিকটিকিকে চমকে দেয়। কিছু কথা নিহত হয়ে কবরে যায়। যুদ্ধ থামে। নতুন কথা অহিংস হয়। ক্ষমা হয়। বট গাছের মত দাঁড়ায়। শান্তি আসে। আবার কিছু কথা কপট নটিনীর মত হয়। রঙচঙ মেখে আড়লে অল্প আলোয় মোহিনী হয়ে দাঁড়ায়, রাস্তা আটকে দেয়। ভুলভুলাইয়ার পর্ব শুরু হয়। তারা আবর্তের মধ্যে নিঃস্ব হয়। 
        কিছু কথা বীজের মত নিঃশব্দ হয়। মৌমাছির চাকের মত সঞ্চয়ী হয়। ঝিনুকের বুকের মত মুক্তোস্নেহী হয়। শূন্য কলসীর অন্ধকার মুখের মত রহস্যপূর্ণ হয়। চিলের ডাকের মত অলীক হয়। সপ্তর্ষিমণ্ডলের মত অতিপরিচিত দূরের হয়। সে কথার বুকে রাখা থাকে আগামী প্রজন্মের কথার ভার। সে কথা বলা যায় না। সে কথা অজন্মা। সে কথার দিকে ধীর পায়ে এগোতে এগোতে মৃত্যু কোলে তুলে নেয়। তারপর আর কথা থাকে? জানি না। নাকি সব কথা সেদিন সেই আদিম ধ্বনিতে লীন হয়, যে ধ্বনির আরেক নাম, ইচ্ছা-অমৃত।