Skip to main content

 

যে দুঃখ, যে সমস্যা আমার হাতে নেই, আমার নিয়ন্ত্রণে নেই সে নিয়ে ভেবে আমি কী করব?

পৃথিবীর দুই প্রান্তে, প্রাচ্যে আর পাশ্চাত্যে দুইজন আলোকিত পুরুষ জন্মালেন। বুদ্ধ ও সক্রেটিস। দু'জনেই প্রায় কাছাকাছি। বুদ্ধের যখন যাওয়ার সময় হচ্ছে প্রায় তখন সক্রেটিস জন্মাচ্ছেন। সক্রেটিস আর বুদ্ধের জীবনশৈলীতে সাম্য একটা কেন্দ্রীয় ভাবনা। আগে বুদ্ধের কথা বলে নিই।

প্রাচীন বৌদ্ধ দর্শন তিনটে স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে - এক, সব অনিত্য; দুই, সব কিছুই অনাত্মা; তিন, সব কিছুই দুঃখময়।

বুদ্ধ কোনো করুণাময় স্রষ্টার কথা বলেননি। এ জগৎ দুঃখময়, অনিত্য আর আত্মাহীন এ কথাটা বুঝে নাও। অনেক দুঃখ শোক আছে যা তোমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে তাদের সঙ্গে একটা সমঝোতা করে নাও। অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের 'বোঝাপড়া' কবিতা প্রাসঙ্গিক এখানে --- “ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে”।

বুদ্ধ শুধু মৈত্রীবোধের জনক নন, এ সাম্যের বোধেরও জনক। এবারে সক্রেটিসের কথায় আসি। সক্রেটিস সরাসরি এ কথা না বললেও তাঁর জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘জেনো’ নামক এক দার্শনিক স্টোইক দর্শনের সূত্রপাত ঘটান। যে দর্শন এই কথাটিই আরো বিস্তারিতভাবে বলে। সেনেকা, এপিকটেটাস, অরেলিয়াস প্রমুখ যে দর্শনের মহীরুহ এক-একজন। প্রসঙ্গত এই এপিকটেটাসের আলোতেই আজকের মনোবিজ্ঞানের cognitive behavioral therapy এর জন্ম।

আবারও আগের কথাতে আসি। যে সমস্যা, যে দুঃখ আমার হাতের বাইরে তাকে আমার সহ্য করে নেওয়া ছাড়া কি আর কোনো উপায় আছে? নেই। দোঁহাতে আছে, দুঃখ সবাইকেই সহ্য করতে হয়, জ্ঞানী সহ্য করে জ্ঞানের আলোতে, মূর্খ ভোগ করে কেঁদে।

বুদ্ধ অনীশ্বরবাদী ছিলেন। স্টোয়িকরা কিছুটা আমাদের নির্গুণ ব্রহ্মের মত সর্বব্যাপী এক অস্তিত্বে বিশ্বাস রাখত। কিন্তু সে সত্তার আমার ব্যক্তিগত সুখদুঃখে কোনো দায় নেই। তুমি তোমার ব্যষ্টিসত্তাকে ছাপিয়ে সাম্যে মনকে স্থির করে নাও। এই হল কথা।

গীতার প্রায় প্রতিটা অধ্যায়ে এই সাম্যতে মন স্থির করার কথা বলা হচ্ছে। সুখদুঃখ, লাভক্ষতি, জয়পরাজয়, শীতগ্রীষ্ম, বন্ধুশত্রু ইত্যাদি সব কিছুতেই মনকে সাম্যে স্থির রাখার উপদেশ দেওয়া হচ্ছে।

কিন্তু এখানেই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। গীতা ঈশ্বরবাদী। তিনি সবার সুহৃদ। তিনি স্রষ্টা। তিনি অন্তর্যামী। তিনি সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্ম আবার বৃহৎ থেকে বৃহৎ। অর্থাৎ তিনি আছেন। আমাকে ঘিরে বাইরে ভিতরে তিনিই শুধু আছেন।

কিন্তু প্রশ্ন হল তিনি থাকতেও আমার জীবনে এত সমস্যা, এত দুঃখ কেন? গোটা বিশ্বজুড়ে এত নৃশংসতা, অমানবিকতা কেন? যদি ঈশ্বর নেই মানি বুদ্ধের মত, বা থাকলেও ওই নির্গুণ নির্বিকার মানি স্টোয়িকদের মত, তবে একটা কথা হয়। ভাই এতটা আমার হাতে আছে, এতটাতেই "আহা উহু" করব। এরপরে আমার হাতে নেই, সেটা বুঝে নিয়ে যাই ঘটুক চুপ করেই থাকব। সহ্য করে নেব।

যদি সুহৃদ ঈশ্বর থাকেন তবে আমাকে সব সহ্য করে সাম্যে মন রাখতে হবে কেন? এইখানে উত্তর আসলেই নেই। জ্ঞানী বলছেন, আসলে তুমি বলে কিছু নেই, সব আঘাত, দুঃখ তিনিই পাচ্ছেন তুমি হয়ে। তোমার 'আমি' গেলেই সব তুমি - "নাহং নাহং তুঁহু তুঁহু"। ভাবের রাজ্যে এই কথাটা সত্য না করে নিলে উপায় নেই। আমি বলে কিছু নেই। কিন্তু ভক্তির রাস্তায় ভক্ত বলে তুমি প্রভু, আমি দাস। তুমি আমার সঙ্গে যা-ই করো না কেন, আমি রাজী। কিন্তু এই এতখানি ভক্তি ভালোবাসা কতজনের চিত্তে জন্মায়? আমাদের তো জন্মায় না। আমাদের তাই অভিযোগ, অভিমান, ক্ষোভ ইত্যাদির পাহাড় জমতে থাকে বুকে। সঙ্গে অসীম অসহায়তা।

বৌদ্ধ আর স্টোয়িকেরা এ দ্বন্দ্বে নেই। তারা বলবে তোমার ও কান্নাকাটি কেউ শোনার নেই ভায়া, যতটা পারছ নিরাময়ের চেষ্টা করো, বাকিটা বিনা দ্বন্দ্বে সহ্য করো, শেষে হার মানতেই হবে। আত্মা বলে কিছু নেই। নিত্য বলে কিছু নেই। সুখ বলে কিছু নেই।

কিন্তু সুহৃদ ঈশ্বরকে স্বীকার করে নিলে কি বিনা দ্বন্দ্বে সব কিছু সহ্য করতে মন রাজী হয়? অভিযোগ আসাই তো স্বাভাবিক। একজন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে এ প্রশ্ন করতে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, এ সব লীলা। সে তখন আমাদের মতই বলেছিল, কিন্তু লীলায় তো আমাদের প্রাণ যায়। ঠাকুর বলেছিলেন, খোঁজ নিয়ে দেখো তুমি কোথায়, সবই তো তিনি। রমণ মহর্ষি যেমন বলতেন, জিজ্ঞাসা করে দেখো, কে তুমি? জিজ্ঞাসা করে দেখো, কে তোমার মধ্যে সুখদুঃখ ভোগ করছে?

জিজ্ঞাসা করে কী উত্তর পাওয়া যায় জানি না। কিন্তু দরদী ভগবান আর এ যন্ত্রণাময়, দুঃখময় সংসারের যে কোনো বোধগম্য ব্যাখ্যা হয় না এ আমরা বুঝি। যে অন্তর্যামী, সে পূর্ণ না শূন্য জানি না। কিন্তু নিজের ভিতর যত দ্বন্দ্বমুক্ত হয়, তত একটা প্রশান্তি আসে। বুদ্ধের সাম্যের শিক্ষাই অবশেষে জয়ী হয়। ঈশ্বরকে অস্বীকার করলেই যদি সে রাস্তা সহজ হয় তবে তাই। আর ঈশ্বরকে স্বীকার করে নিয়ে, তাঁর প্রতি আনুগত্য রেখে সব সহ্য করে নেওয়া, স্বর্গে বা দেহাতীত হলে এ সবের মূল্য চুকিয়ে দেবেন এ আশায়, এ প্রতিশ্রুতিতে…সেও অনেক মানুষের জীবনপুঁজি। আর রইল মধ্যের আরেক রাস্তা, ঈশ্বর চান, আমি তাঁর ভরসায় না থেকে মনকে বুঝ দিয়ে সব সহ্য করে নিই। কেন চান? জানি না। এতে দ্বন্দ্ব বাড়ে না কমে? বুদ্ধই কি তবে বুঝেছিলেন? তাই কি বিবেকানন্দ নির্গুণ ব্রহ্মের কথা বলতে এত উদগ্রীব থাকতেন? তাই কি রবীন্দ্রনাথ 'শেষ প্রশ্ন' কবিতাতে এর উত্তর পেলেন না? আসলেই কি এই দুই বিরোধী তত্ত্বের মীমাংসা হয় না স্বর্গের রূপকথা ছাড়া?