"আসিবে ফাল্গুন পুন, তখন আবার শুনো
নব পথিকেরই গানে নূতনের বাণী।।"
আমার বসতি কলকাতা নয়, শহরতলী। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে দেখলাম দারুণ আলোকসজ্জা। মনে মনে ভাবলাম, কি পূজো সামনে? প্যাণ্ডেল যে? ভাবলাম বিশ্বকর্মা হবে বুঝি, না, গণেশ পূজো। ইদানীং গণেশ পূজোর চল বাংলায় বাড়ছে সে নতুন একটা কোনো কথা না। সাথে গণপতিবাবার মারাঠী গানও বাজছে। আবার "লক্ষ্মীটি দোহাই তোমায় আঁচল টেনে ধোরো না"-ও বাজছে। আমি মানশ্চক্ষে দেখলাম, ভবিষ্যৎ বাঙালীর সংস্কৃতি হিন্দী ও হিন্দীর কাছাকাছি ভাষাগুলোর ঘরে দাসীবৃত্তি করছে। বিশেষ করে বাংলার গান।
আমাদের আগে নানা রকম গান ছিল। কীর্তন, বাউল, কবিগান ইত্যাদি তো ছিলই, তারপর এলেন নিধুবাবু, রবিবাবু, অতুল-দ্বিজেন-কান্ত, নজরুল, হেমেন, সলিল, পুলক, গৌরীপ্রসন্ন ইত্যাদি। বাঙালীর মধ্যবিত্তের মনের কথা এরা বলতে পেরেছিলেন। এখন বাঙালীর মূলধারার গানের খাত নিতান্তই মন্দা। কেন?
গানের দুটো দিক থাকে। এক প্রাণের দিক, আর দুই মনের দিক। প্রাণ সাড়া দেয় সুর আর তালের মেলবন্ধনে, আর মন সাড়া দেয় ভাষার দ্যোতনায়। আমরা জীবনমুখী গানের যে ঢল দেখেছিলাম, তাতে স্বাদ বদলিয়েছে, খানিক প্রতিবাদ জন্মিয়েছে, বুদ্ধি আর মনের ঘরে কিঞ্চিৎ দোলাও লেগেছে, কিন্তু সে গান প্রাণের গান হয়ে উঠতে পারেনি। সে গান নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সে গান শুনে জাতে ওঠা গেছে, সে গান একটা শ্রেণী তৈরি করেছে, কিন্তু এ সবই বৌদ্ধিক আর মানসিক স্তরের, এর কোনোটাই তার প্রাণের সম্পদ হয়ে উঠতে পারেনি। অনুপম কিছুটা সে অর্থে সফল হলেও সেও সেই একটা বৌদ্ধিক স্তর আর কিছুটা মানসিক স্তরের বেশি ভেতরে ঢুকতে পারেনি। যা পারছে হিন্দী সিনেমার গান, বাংলা সিনেমার গান নয় কিন্তু। তার কারণ সে গানে তার মন-বুদ্ধি সাড়া দেওয়ার আগে প্রাণ সাড়া দিচ্ছে। প্রাণের গতি চিরকালই এক। তার প্রেম আছে, তার যন্ত্রণা আছে, তার কিছু অস্পষ্ট কথা আছে, যা সুর বোঝে। প্রাণ, বুদ্ধি বা মনের মত অতটা obvious নয়, তাই তার আকুতি সুরের কাছে। যে সুর একদিন তাকে বাংলার নানা সুরস্রষ্টাই দিয়েছে, কিন্তু আজ অনেকটা মাথা খাটিয়ে সে সুরের নদীর এক আঁজলা জল হয়ত পাওয়া যায়।
আরেকটা কারণ, ভাষার জড়তা। আমাদের ভাষার আড়ষ্ঠতা অনেক বেশি। জীবনের গতির সাথে আমরা ঠিক যুত করে উঠতে পারিনি আমাদের ভাষা নিয়ে। একটা খবরে পড়লাম, আমাজন তাদের ওয়েবসাইটটাকে এবার হিন্দীতেও আনবে, কারণ এত বেশি সংখ্যক মানুষ হিন্দীতে লিখে সার্চ করছে বলে। যে কোনো জনপ্রিয় হলিউডের সিনেমা তামিল, তেলেগু আর হিন্দীতে ডাব হয়ে আমাদের দেশে চলে। বাংলায় চলে না। তার কারণ, আমাদের ভাষার আড়ষ্ঠতা আর ছুঁৎমার্গীতা। 'বিড়ি জালাইলে জিগার সে পিয়া', বাংলায় অনুবাদ করা যায় না। জোর করে করলে হয় রসহানি হয়, নয় কানে লাগে।
আমাদের জাতের একটা প্রাণের বিচ্ছেদ ঘটছে। আমাদের বুদ্ধি আছে, বিচার আছে, রুচিবোধ আছে, কিন্তু কিছুতেই প্রাণের আদিম টানের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। আমাদের কবিতা, সাহিত্য, সিনেমা কোনোটাই যেন সে অর্থে সে প্রাণের কথাটা অকপটে বলে উঠতে পারছে না। কেন? আমরা কি আমাদের বুদ্ধিকে এতটা কৃত্রিম অনুশাসনে বেঁধে ফেলেছি যে নিজের কাছে নিজে সহজ হয়ে উঠতে পারছি না? বাঙালিরা যেমন বরাবরই নাচতে আড়ষ্ঠ। আমি বিসর্জনের নাচ বলছি না, বা রবীন্দ্র-কত্থক ইত্যাদিও বলছি না। আমি বলছি যে কোনো উৎসবে অবাঙালি আর বাঙালির নাচের মধ্যে একটা পার্থক্য থাকে, আমরা প্রাণোচ্ছ্বল হয়ে উঠতে পারি না। আমাদের সামনে যেন সব সময় একটা অদৃশ্য সেনসার বোর্ড। এতটা না, এর বেশি না, এরকম না - ইত্যাদি নানা ঘেরাটোপে আমাদের প্রাণের শক্তিটা যেন কোথায় হারাতে বসেছে। আমাদের আড্ডা আছে, আমাদের সুক্ষ্ম-অতিসুক্ষ্ম যুক্তি-তক্কো বাদানুবাদ আছে, কিন্তু আমাদের যেন প্রাণের ডাকটা নেই।
অথচ বাঙালির আগের রূপ এমনটা ছিল না। বাঙালি প্রাণের উৎসবের অভাব ছিল না। গানের অভাব ছিল না। কিন্তু আজকের মত এমন একটা মেরুকরণ গানে ছিল না। আজ সারা ভারতজুড়ে যে প্রাণশক্তির জোয়ার এসেছে, গানে-সিনেমায়-নাচে, আমরা তার সাথে পেরে উঠছি না। তাই সে অভাব তাদের থেকে আমদানি করেই পুরণ করে নিচ্ছি। প্রাণের স্রোতে জাতবিচার থাকে না। তার বেগটা একটা ছন্দে চলে, কিছু সরল আবেগকে খুব স্পর্শকাতরভাবে ছুঁয়ে যেতে চায়। কোনটা সেন্টিমেন্টালিজম, কোনটা ইমোশনাল লুজ মোশান, কোনটা ততটা ইন্টেলেকচ্যুয়াল নয় - এসবের সুক্ষ্ম তর্কে সে জড়ায় না।
জীবনের প্রথম কথাই প্রাণ, তার সাথে যোগাযোগ ছিন্ন হলে যতই সুক্ষ্মতা থাকুক, আদতে মূল স্বাস্থ্যটা ভেঙেই পড়ে। আমাদের ছুঁৎমার্গতা কাটানোর সময় এসেছে, আমাদের সুক্ষ্মবিচার ভুলে গতিটাকে বলবান করে নেওয়ার সময় এসেছে, মনে রাখতে হবে সব কিছুর মূলেই মানুষ। তার ভাষা, তার কবিতা, তার গান, তার আঁকা, তার সিনেমা ইত্যাদি যাই সে করুক, মূলে সে মানুষের হৃদয়ে জায়গা না করে নিলে শেষে সব ফাঁকি। কি কবিতা হল আর কি কবিতা হল না, কি গান হল আর কি গান হল না, এ সব বিচার অনেক হল। কি মানুষকে ছুঁলো আর কি ছুঁলো না, এই শেষ কথা না হলেও প্রধান একটা কথা তো অবশ্যই। আর যা কিছু সাধারণ মানুষকে ছোঁয় অবশেষে সে-ই কালজয়ী হয়ে থাকে। তবে সে কালজয়ী হোক চাই না হোক, কোথাও সাধারণ মানুষকে অবজ্ঞা করার মধ্যে যে উন্নাসিকতা আমরা দেখিয়েছি, তার খেসারত আজ আমরা এক প্রকার পঙ্গু হয়ে দিচ্ছি। বৌদ্ধিক সুক্ষ্ম সাধনার মোহে, মূলস্রোতকে অপুষ্ট রেখে আজ শূন্যতায় গর্বের তোরণ তুলে নিজেদের পিঠ চুলকাচুলকি করে যে অস্বাস্থ্যকর, রুগ্ন পরিবেশ সৃষ্টি করেছি, তাতে অন্য ভাষা এসে স্থান দখল করবে এই স্বাভাবিক, খিদে যখন আছে খাদ্যের জোগান তো দিতেই হবে, সে চাষ যদি না হয়, তবে আমদানিই সই।