Skip to main content
 
 
        আমার কিছু অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে ইচ্ছা করে। তেমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু কথাগুলো ভীষণ সত্যি। অনুভবে সত্যি। অভিজ্ঞতায় সত্যি। শাস্ত্রকারের মতে যাই হোক না কেন। তারা কোনো বাণী নয় যদিও, তবু তারা সত্যি। রেললাইনের ধারে জন্মানো ছোট্টো গাছটার মত সত্যি। তারা খেদও নয়, অতৃপ্ত বাসনাও নয়। তারা উপপত্রের মত একটু জায়গা করে নেওয়া নিতান্তই এলেবেলে। তবু অস্তিত্বের মত শরীরী। অদৃশ্য হলেও বাতাসের মত, ব্যস্ত মনে চাপা পড়ে থাকা কান্নার মত। তাদের কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই। বাইরের কোনোকিছুর সাথে তাদের কোনো লেনাদেনা নেই। তারা নিজেরাও জানে না তারা কেন আছে। কিন্তু তবু তারা আছে।
        আমার মামু (দিদির মেয়ে) কাশ্মীর থেকে বেড়িয়ে এলো। খুব ছোটো তখন সে। এসেই বড় বড় চোখ করে বলল, "জানো মামু একদিন বেড়িয়ে এসে হোটেলে ঢুকে দেখি এত্ত এত্ত হনুমান আমাদের হোটেলের ঘরজুড়ে। সারা ঘর এক্কেবারে লণ্ডভণ্ড করে রেখেছে।" আমি বললাম, তারপর? তাদের তাড়ালি কি করে? সে খানিক ভাবল। তারপর বলল, "ওরা নিজেরাই চলে গেল যে!"
        আমি জানি তার এই হনুমানঘটিত কাণ্ডের একটি সাক্ষীও সে পাবে না এই কঠিন বাস্তব আবদ্ধজীবীদের মধ্যে। কিন্তু সে যে চোখে হনুমানগুলোকে দেখেছিল, তাদের যে দুরন্তপনা আর বাধ্যতার ছবি মনের মধ্যে এঁকেছিল, সে কি শুধুই মিথ্যা? দলিল দস্তাবেজ বলবে মিথ্যা। কাজের জগতে, নীতিশিক্ষায় সে বড় অপরাধী নিশ্চই। কিন্তু মানুষের কল্পনাটা এতটাই শূন্যের উপর দাঁড়িয়ে? কল্পনার কি কোনো হৃদয় নেই, সাধ নেই, আশা-হতাশা নেই। সব আছে। শুধু তার বাস্তব জগতে হাজিরা দেওয়ার মত সামর্থ্য নেই। তবু কল্পনার কাছে কল্পনা বাস্তব। বাস্তবের চোখে সে যতই অনস্তিত্ববান হোক না কেন। আমি সেই অবাস্তব, অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে চাই। কারা শুনবে? কেউ শুনতে চায় না। বলে, এইখানে কেমন গরমিল হল যে? জানি তো হল। তুমিও জানো আমি জানি। তবু তুমি বলবে, কারণ তোমার অহংকারে বেজেছে। তোমার জানা জগতের বাইরে আমার কল্পলোক, তুমি তা মানবে না। না মানো, তোমার বাগানের টগরফুল আমার চোখে যদি আমার প্রেমিকার কানের ঝুমকোর মত দেখায়, তবে সে দায় তোমায় আর তোমার বাগানের টগর - দুজনের কাউকেই নিতে হবে না। সে দায় আমারই। তুমি বলবে মিথ্যা। আমি বলব, অন্ধ তুমি। সংসারে এমন অনেক সত্যি আছে যা সত্যের চোখে পড়ে না, মিথ্যার চোখেই পড়ে। সেই সত্যগুলোকে নিয়েই মানুষ খেলাঘর সাজায়। সব মানুষের খেলাঘর থাকে। তুমিও একদিন বুঝবে। 
        একদিন হল কি আকাশ জুড়ে কালো মেঘ করে এলো। আমি তখন অনেক ছোটো। জানলা দিয়ে দেখছি মাঠের সীমানা বেয়ে একটা বিরাট ঢেউয়ের মত কালো মেঘ রাজকীয় ভঙ্গিতে এক পা এক পা করে আকাশের মাঝখানে এগিয়ে আসছে। আর তার সেই কালো রঙের বুকে মাথাটা রেখে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছটা। তার লালফুলগুলো যে কি অপরূপ হয়ে উঠেছে কালোর রঙের পটে, আমি হাঁ করে চেয়ে রইলাম। আমার সামনে খোলা অঙ্কের খাতাটা আসন্ন ঝড়ের হাওয়ার পতপত করে উড়ে গেল। দেখতে দেখতে ঝড় উঠল। এতক্ষণের শান্ত, নিরীহ প্রকৃতি কি ভীষণ হয়ে উঠল। জানলার পাল্লা পড়তে লাগল ধমাস ধমাস করে। মা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মায়ের সাথে ছুটলাম খোলা বারান্দায়। শাড়ি, জামাগুলো দড়ি ছিঁড়ে উড়ে যাওয়ার জন্য যেন ছটফট করছে। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা বিঁধতে লাগল আমার পিঠে, মাথায়। আমি আনন্দে আত্মহারা হই আরকি। এরা কারা যারা আমায় ছুঁচ্ছে? ওই আকাশ থেকে নামছে? বাহ্ রে, লাগুক পিঠে। মা হিড়হিড় করে টানতে টানতে ঘরে আনলেন। যতটা ভেজার কথা ছিল, ভিজলাম তার চেয়ে অনেক। কারেন্ট গেছে। ঘরের মধ্যে ভর দুপুরে সন্ধ্যের অন্ধকার। বাইরে আওয়াজ বৃষ্টির আর বাজের। এদের আওয়াজ তো রোজ শুনি না। এরা তো রোজ রোজ এমন সরব হয়ে আমার চারপাশটা এমন স্বপ্নের মত অন্য জগত বানিয়ে দেয় না। ব্যাঙের ডাক শুরু হল। কৃষ্ণচূড়া গাছটাকে দেখছি মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে পাগলের মত নাচছে। তাকে বলতে গেলাম, ওরে তোর সব ফুল মাটিতে পড়ল যে রে! কে শোনে কার কথা। সে তো পাগল তখন। ঝড়ের সাথে যেন তার কত কথা! বৃষ্টির সাথে যেন তার কত জন্মান্তরের মিতালি। বৃষ্টি যেন তার সখী।
        আমি ছুটে এসে মায়ের কাছে দাঁড়ালাম। মায়ের মুখটা দেখলাম। আমার যে কোনো অনুভূতি হলেই আমি মাকে ছুটে দেখতে আসতাম। প্রতিবার মুগ্ধ হয়ে যেতাম। মনে হত আকাশ, বাতাস, মাটি, জল, সূর্য, চাঁদের মত আমার একটা মা আছে। সে শুধুই আমার। সংসারে তার অন্য কোনো কাজ নেই। থাকতেই পারে না। আর আমারও সংসারে আপন বলতে যেন ওই একজনই - আমার মা। একটা গন্ধ, একটা মুখ, একটা হাসি, একটা দৃষ্টি, একটা স্পর্শ। বাইরে তখন প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি। আমি মায়ের পাশেপাশে ঘুরঘুর করছি। আমি জানি বৃষ্টি থামবে। মেঘ তার সব সাজসরঞ্জাম নিয়ে আবার চলে যাবে। আবার কারেন্ট আসবে। আমায় আবার পড়তে বসতে হবে। কিন্তু আমার একটা আনন্দ থাকবেই - মাকে দেখার। ঘুরতে ফিরতে একটু ছুঁয়ে নেওয়ার। মনে হত যেন ঈশ্বরী।
        আমি কত সহজেই আস্তিক হয়ে গিয়েছিলাম। মায়ের চোখ বন্ধ করে ঠাকুরঘরে বসা। মায়ের তুলসীতলায় গলায় আঁচল দিয়ে প্রদীপ জ্বালা। শাঁখে ফুঁ দিত গালদুটো ফুলে ওঠা, উপোস করে থাকলে ফর্সা মুখটায় কালি পড়ে যাওয়া - এরাই আমার ঈশ্বরের অস্তিত্বের সব চাইতে বড় প্রমাণ ছিল।
        আজ মা ছাড়া সব কিছু আছে। সেই শাঁখ, সেই আসন, সেই শাঁখা-পলা, সেই ঘট, সেই দেবদেবীরা সিংহাসন জুড়ে, সেই প্রদীপ, ধুপদানি, সেই মেঘ, সেই কৃষ্ণচূড়া, সেই বৃষ্টি, এমনকি আমার সেই কাঙালপনা মায়ের মুখটার জন্য, - কিন্তু এরা সব অপ্রাসঙ্গিক আজ। এত ব্যস্ত জীবনে এরা মালার সুতো ছিঁড়ে যাওয়া পুঁথির মত আজ। আদরযত্ন পায় না। এমনকি ন্যূনতম সম্মানটুকুও পায় না। তবু থেকে যায়। এরকম অজস্র অপ্রাসঙ্গিকতা লক্ষ লক্ষ প্রাসঙ্গিতার সাথে পাশাপাশি হেঁটে যায় সারাটা জীবন। না তারা ছেড়ে যায়, না আমি তাদের ছাড়তে পারি। যদিও ভাণ করি এমন, যেন সেসব আমি ভুলেও ভাবি না। তাদের যে আমি সম্পূর্ণ ভুলে গেছি এই কথাটাই রাতদিন মনে রাখি।
        শিশুদের মধ্যে যতটা না প্রাসঙ্গিকতা তার বহুলাংশে বেশি তাদের অপ্রাসঙ্গিকতা। আমরা রাতদিন তাদের বাধ্য করছি আমাদের ভাষা শেখার। প্রাসঙ্গিক করার। কিন্তু তারাও একটা প্রকৃতিদত্ত ভাষা নিয়েই জন্মায়। আমাদেরও কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে সে ভাষা শেখার চেষ্টা করার। তাদের ইচ্ছা-বায়নাগুলোকে অপ্রাসঙ্গিক আখ্যা না দিয়ে তাদের সেই অপ্রাসঙ্গিক জীবনটাতেই একটু না হয় নিজের ছুটি খুঁজে নেওয়া যাক। আমি কথা দিচ্ছি, বিফলকাম হওয়ার অভিজ্ঞতা হবে না। অনেক কিছু তাদের দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ হবে। নতুন করে এই বোকাসোকা পৃথিবীটাকে আবার ভালোবাসতে ইচ্ছা করবে। আর এতগুলো আজগুবি ধর্মীয় গল্প যদি হজম করে ফেলছি, যাদের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন করলেও জীবনসংশয়, তখন এই কতকগুলো নিরীহ অপ্রাসঙ্গিক উপাখ্যান মেনে নিই নাহয়। বাঁচাটা আরেকটু সহজ হবে। অন্তত আমার তো তাই মনে হয়।