স্নেহ অতি বিষম বস্তু। স্নেহবস্তু যত সুক্ষ্ম তাকে নিয়ে সমস্যাও তত গুরুতর। যেমন ধরুন LDL এর কথা, যেই না রক্ত পরীক্ষায় এল যে সেই সুক্ষ্ম স্নেহ আপনার রক্তে ঘোরাফেরা করে বেড়াচ্ছে তখন আর নিশ্চিন্তে থাকার জো রইল না। যখন তখন যেখানে সেখানে জমে এক বিদিকিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটিয়ে বসাবে। চিকিৎসকের স্নেহদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হবেন। ঘরের লোকের দ্বারা রন্ধিত স্নেহমিশ্রিত খাদ্যতালিকা ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসবে। যখন তখন আপনাকে বাইপাসের ভয় দেখানো হবে। আর এখন তো আবার দাদার নামটা জুড়লই – ওরই যখন এই অবস্থা, এত জিম করে এত ব্যাটবল খেলে, তখন...
যাক, সে স্নেহের তবু একটা মাপকাঠি আছে। কতটা বরদাস্ত করা ঠিক হবে কতটা হবে না, সেও একটা হিসাব করে বলা যায়। কিন্তু ভাবুন যে স্নেহ হৃদয়ে ধমনীতে জমে না, হৃদয়ে উৎপত্তি লাভ করে ক্রমে মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করে ফেলে, বিভ্রান্ত করে তোলে, সেই স্নেহের কথা? এই সেই স্নেহ যাহা সতিই অতি বিষম বস্তু। যার কবল থেকে মুক্তির জন্য বাইপাস কেন, কোনো উপায়ই নেই, শুধু পাশের পর পাশ বেড়েই যায়। এ পাশকেই শাস্ত্রকারেরা বলেন অষ্টপাশ। সেই মহাভারতের যুগে দেখুন। ধৃতরাষ্ট্র বললেই লোকে বলে স্নেহান্ধ। আচ্ছা বলুন, কোন স্নেহটা অন্ধ নয়। স্নেহ মানেই ঝাপসা দৃষ্টি। সে অন্ধত্ব অবধি পৌঁছাক বা না পৌঁছাক, ছানি অবধি তো যাবেই। স্নেহ মানেই একদিকে গোঁত্তা খেয়ে চলা মনের গতিবিধি। গোটা মহাভারতটাই হয়ে গেল এই এক স্নেহের চক্করে। মায় গান্ধারী ম্যাডাম অবধি অত করে বোঝালেন না স্যারকে। তিনি আর বুঝেছেন, তা কি করে বুঝবেন? মস্তিষ্কের যে স্নেহ জমে জমে পাহাড় হয়ে আছে। ছেলেকে নিয়ে ভাবনাগুলো সব মাখো মাখো। এমনকি আমাদের রবি ঠাকুরও কি সুন্দর পদ্য লিখে গান্ধারীকে দিয়ে বলালেন। হল কি কিছু? হবে না তো। এক গোঁ। আসলে ঠিক গোঁ নয় জানেন, ওটা একটা মাখো মাখো অবস্থা। আর ওদিকে দশরথের কথা ভাবুন। সব দিক রাখতে গিয়ে প্রাণটাই খোয়ালো মানুষটা। একদিকে স্নেহ, অন্যদিকে প্রেম। যায় কোনদিকে মানুষটা?
এই দেখুন না আমাদের কালে লোকে কত কি বলে – কার জানি ভাইপোর জন্য দলে নাকি এত সমস্যা। ভাইপো স্নেহ। কার জানি স্নেহের জন্য দেশের একটা প্রধান রাজনৈতিক দলের আজ ভরাডুবি। ছেলেটা বিয়েও করল না, রাজা হওয়ার জন্য লড়াইটাও ঠিকঠাক করল না। শুধু মায়ের আর দলের দাদু-দিদার স্নেহে লুতুপুতু খেয়ে মাখো মাখো হয়ে আছে থেকে থেকেই বিদেশে চকোলেট খেতে চলে যাচ্ছে। যায় ভাগ্যি মেয়েটার বিয়ে থা হয়ে গিয়েছিল। নইলে দলের লোকগুলোর নাওয়াখাওয়া ভুলে ভাইবোনের ফাইফরমাশ খাটতে খাটতেই প্রাণ যেত। পার্লামেন্টে যে শান্তিতে পাছা ঠেকিয়ে বসবে সে সময় পেত?
আজকাল আমার আবার নানা জাতের ওয়েবসিরিজ দেখে দেখে পেরায় দিব্যজ্ঞান হওয়ার জোগাড়। কি বলি বাপু, বিশ্বের যত তাবড় তাবড় ডাকু-খুনী-ঠগ-জোচ্চর এইসবের গপ্পো ফেঁদে ফেঁদে সিরিজের পর সিরিজ বানিয়ে যায়। আর আমি দেখেই যাই, দেখেই যাই। ওয়েবসিরিজে দুটো লোক কথা বললেই আমার প্যালপিটিশান হয় জানেন, এই বুঝি প্যান্টুলুনের পিছন থেকে একটা বন্দুক বার করে ঠাঁই করে গুলি চালিয়ে দিল। বলি জগতে এত প্রতিভাধর গুণ্ডা-বদমায়েশ ছিল তা এই ওয়েবসিরিজগুলো না থাকলে জানতে পারতুম? তাদের জীবন কি নিখুঁত দেখায় মা গো মা! কেন? দেশে সাধু মহাপুরুষ নেই? সেই বিশ্বামিত্র, বশিষ্ঠ, ব্যাসদেব কি সেন্ট পিটার, সেন্ট অগাস্টিন, সেন্ট থমাস এদের জীবনী দেখা! তা না, পাবলো এস্কোবার বলে এক কলোম্বিয়ান কোকেন গুণ্ডা ছিল সে প্যান্টুলুন খুলে কমোডে বসে হাগছে আমায় তাও দেখতে হবে। না দেখলেও হয়, কিন্তু ওসব না দেখলে আপনি আবার অসামাজিক হয়ে গেলেন যে। লোকে মায় সারাদিন এখন ওইসব কুখ্যাত গুণ্ডাগুলোনরে নিয়ে কি গালগল্প করে গা! মনে হয় হাতে ধানদুব্বা দিয়ে বসিয়ে দিই।
তা এই স্নেহ’র কথা বলতে গিয়ে কেন এই সব প্যাঁচাল পাড়তে বসলাম? আরে ওই যে পাবলোর কথা বললাম না, সে তার মেয়ের ঠাণ্ডা লাগছিল বলে কত কত টাকার বাণ্ডিল জ্বালিয়ে দিল জানেন? আমি তো দেখেই থ! অথচ কত কত রাস্তার বাচ্চাগুলোকে হাতে বন্দুক দিয়ে এই মানুষটাই নিজের স্বার্থসিদ্ধির পথ তৈরি করেছে। স্নেহ এমনই একচোখা।
আমি দেখেছি তো, এমন মানুষ দেখেছি। যে মানুষ তার কাজের জায়গায় একটা নয়া পয়সা ঘুষ নেয়নি, সে নিয়ে সবাই ধন্যি ধন্যি বলে, সেই মানুষ নিজের অসৎ, হাড়েবজ্জাৎ, লোকঠকানো ছেলের প্রতি স্নেহে অন্ধ হয়ে তার বউ-বাচ্চাকে পর্যন্ত অস্বীকার করে নিশ্চিন্তে রাতে ঘুমায়! মা গো মা! বলি একটু বিবেক দংশন হয় না গা? হয় না। বিবেক আর মস্তিষ্কের উপর এমন পুরু স্নেহের আবরণ। এরকম ভুরি ভুরি উদাহরণ সংসারের ঘরে ঘরে। মা এক ছেলের উপর স্নেহে অন্ধ হয়ে আরেক ছেলেকে পথে বসিয়ে দিল, এও দেখলাম। বলি কত কত গল্প, উপন্যাস হয়ে গেল না এই স্নেহের অত্যাচারের উপর ভর করে।
এখন লোকে বলে নেপোটিজম। এই নতুন শব্দ আজকাল লোকের মুখে মুখে ফিরছে। যেন স্নেহান্ধ কথাটা আমরা জানি না। আসলে জানি তো সবই। ভাবটাও একই যুগে যুগে, শুধুমাত্র ভাষাটা বদলে বদলে যায়। সেদিনের লুচ্চামিকে এখন বলি ওপেন রিলেশানশিপ।
স্নেহের সমস্যা শুধু কি এই একপেশেমি গোলমালেতেই? না। সে সব তো বহির্মুখী সমস্যা। এর সঙ্গে আছে অন্তর্মুখী জ্বালা। কিভাবে বলি। আসলে স্নেহের সঙ্গে মর্যাদাবোধের একটা আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক। কথাটা একটু খোলসা করে বলা যাক। যেমন ধরুন কারুর প্রতি আমার বেজায় স্নেহ জন্মে গেছে। এই স্নেহ জন্মে যাওয়ার উপর তো কারোর হাত থাকে না বলুন। অতএব কি আর করা, যখন জন্মেই গেছে তখন উৎপাতও শুরু হল। বাইরের নয়, ভিতরের। স্নেহ প্রথম যেটা সরিয়ে দেয় তা হল আত্মমর্যাদাবোধ। স্নেহের বস্তুটির সামনে এলেই নিজের সমস্ত মর্যাদাবোধ যেন সেই মানুষটার কৃপাদৃষ্টির উপর দাঁড়িয়ে। তার মধু ব্যবহারেই, তার সান্নিধ্যেই আমার সুখ, আমার সব কিছু। সে দূরে গেলেই আমার সব শূন্য বোধ। এখন সমাজে তো অধিকারবোধের একটা হিসাব নিকাশ করে রাখা আছে। স্নেহ সে কথা মানবে কেন? আপনার যদি অন্যের বাচ্চার উপর স্নেহ জন্মায়, তবে সে স্নেহের ব্যথার উপশমের জন্য তাকে আপনি সবসময় কাছে পাবেনই তার কি মানে আছে? যেখানে অধিকার আছে সেখানেই মানুষ বঞ্চিত হয় যখন তখন আর অন্য ক্ষেত্রের বিষয়ে কি কথা। কত দাদু-দিদা, ঠাকুমা-ঠাকুর্দার কাঙালপনা দেখেছি। যেন তাদের ভালোবাসা আর স্নেহের চাইতে বড় বাধা সংসারে আর কিছুতেই নেইকো। কিসের বাধা? আরে বড়মানুষ হওয়ার বাধা গো। যতদিন যাচ্ছে দাদুদিদিমারা যেন ভুলেই যাচ্ছে যার প্রতি তাদের স্নেহ সে একটা মানুষ শুধু না, সে একটা ভয়ংকর সম্ভাবনা। তাকে শুধু স্নেহের বস্তু করে রাখলেই হয় না। উচ্চমানের মান-যশ-অর্থের উপার্জন তালিকায় তার নাম নথিভুক্ত করতে না পারলে সংসারে আসাটাই তার ব্যর্থ বলে গণ্য হবে যে! অগত্যা উপোসি স্নেহ নিয়ে দাদু-দিদা-ঠাকুমা-ঠাকুর্দার দিনাতিপাত। নাতি-নাতনীদের কল্পনা, ছবি, ক্ষণিক ভিডিওকল, ক্ষণিক কাছে পাওয়া ইত্যাদিতেই সমস্ত স্নেহের দাবি মিটিয়ে নিতে হবে, এমন চুক্তিপত্র লেখা হয়ে গেছে। এ হল অতৃপ্ত স্নেহের যন্ত্রণা।
আর যার উপর আপনার অধিকার নেই? তখন তো আপনি ভিখারি। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম তখন। ক্রমে অবশ্য বোঝা যায় কারোর উপরেই আমার সে অর্থে অধিকার নেই। মনের মধ্যে একটা চিনচিনে বৈরাগ্য জন্মায়, এ হল অভিমানী বৈরাগ্য। শাস্ত্রে এ কথা নেই।
ওই যে মর্যাদাবোধের কথা বলছিলাম না? ওটা স্নেহের সঙ্গে ব্যাস্তানুপাতিক। স্নেহ অতি হলে মর্যাদাবোধ ঠিক মাত্রায় রাখা দায়। অন্যথায় মর্যাদাবোধ অতিরিক্ত হলে স্নেহকে তবু অন্তত বুকের উপর খিল আটকিয়ে হাসিমুখে ঠেকিয়ে রাখা যায়। হাসিমুখে বললাম কিন্তু, জ্বলন্ত হৃদয়ের কথা না। খিল খাপে খাপে বসাতে কতটা জোর দিতে হয়, সে যে দেয় সেই জানে। আসলে মানুষ তো যতটা শরীরে বাস করে তার চাইতে অনেক বেশি মর্যাদায় বাস করে। বাড়ির মানুষ যদি মর্যাদা নিয়ে থাকে তবেই তার থাকাটা থাকা আসলে বাড়িতে থাকা। নইলে সে বাড়ি শুধুই আশ্রয়। তার জন্যে তো রেলের স্টেশানের শেডই যথেষ্ট। যেখানে মানুষ অন্তত মর্যাদার আশাটুকুও রাখে না। যা মেলে তাইতেই পুষিয়ে যায় তখন। মানে পুষিয়ে নিতেই হয়।
শাস্ত্রে যে গাম্ভীর্যতার সঙ্গে কাম-ক্রোধ-লোভকে রিপু বলেছে, সতর্ক করেছে, সেই অর্থে স্নেহ সম্বন্ধে করেনি তো। ফলে ভালোবাসা, অনুকম্পা, ভালোলাগা ইত্যাদির মুখোশে কখন যে সে স্নেহ সারাটা বুক শিকড় ছড়িয়ে বসে তা জানতেও পারা যায় না। যখন বোঝা যায়, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই কি বাণপ্রস্থের কথা বলা হল? হবেও বা। যখন বারবার স্নেহের নিগড়ে ক্ষোভ জন্মাচ্ছে, তখন মানুষ যতটা না ঈশ্বরের জন্য ব্যকুল হয়, তার চাইতে ব্যাকুল হয় নিজের সেই নিগড় ভেঙে ফেলার জন্য। ওকেই নাম দেয় - মুক্তি। সে তো বোঝে তার যন্ত্রণার কারণ বাইরের কেউ না, সে নিজে। তার বুক উছলে ওঠা স্নেহের ভার সে আর বইতে পারছে না। সে মুক্তি চায়। এই স্নেহ থেকেই সে মুক্তি চায়। সংসার থাকবে আর স্নেহের পাশ থাকবে না তা কি হয়? ও যতই নিরাসক্তির কথা বলো না কেন? মনের একদিক যখন বলে আমি সব ছেড়েই যেতে পারি, তখনই আরেকদিক বলে, "ওর কি খাওয়া হল? জ্বর হল কি? ওর চোখটা কি ছলছলে? রোগা হয়ে যাচ্ছে কি?" - এ প্রশ্নগুলো তো আর বাণপ্রস্থাভিমুখী না। এগুলো যে বড় বালাই। ভীষণ বালাই। দুর্ভাগ্য আরো ঘনীভূত হয় যদি এর সঙ্গে জোটে অপর দিক থেকে শীতল অমর্যাদা। মানুষ যায় কোথায়? কোথাও যায় না। মানুষ তখন বলে আর কিছু না থাকুক, আমার মৃত্যু তো আছে। মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান... তুঁহু নেহি বিসরবি, তুঁহু নেহি ছোড়বি... রাধা হৃদয় তু কব হুঁ না তোড়বি...
এ অভিমানে সত্যি চিতা জ্বলে ওঠার আগে কত চিতা বুক জ্বালিয়ে জ্বলে গেল, অনেক দেখলাম। আবার সত্যি মরণ যখন এলো সে আবার বাঁচতে চাইল। কিন্তু মরণ সে সময় দিল কই? তাকে পুড়িয়ে কি মাটির মধ্যে মিশিয়ে সংসারে তাকে নিশ্চিহ্ন করে দিল না? দিল তো। সে তাও মেনে নিল। তার হয় তো কোথাও আশা জন্মালো সে তার স্নেহ তার মৃত্যুর পর নিজের মর্যাদাটুকু পাবে। নির্বোধ হৃদয়ের এ সাধটুকুও শুধুই মরীচিকা। স্নেহ সত্যিই এক বিষম বস্তু। এইটুকুই সার সত্য।