Skip to main content

বুদ্ধি বলিয়া বস্তুটি যতটা সহজপাচ্য ভাবিয়াছিলাম, কার্যক্ষেত্রে দেখিলাম ততটা নহে। মস্তিষ্কে উহার কিঞ্চিৎ উপস্থিত টের পাইয়াছিলাম সে বহুদিন হইল। পর্যাপ্ত যে নাই তাহা শিক্ষককূল নানাবিধ সংখ্যা দ্বারা বুঝাইবার প্রয়াস পাইয়াছেন বিদ্যালয় হইতেই। কিছুতেই অধিক সংখ্যা ফলাফল পত্রে রহিত চাহিত না, অন্য ছাত্রদের ফলাফলপত্রে শোভিত হইত। মনে অবশ্য ঈর্ষা কোনোদিন জাগে নাই, মনে হইয়াছিল যেটুকু রহিয়াছে তাহাতেই কার্য মিটিবে। 
বাস্তবে অন্যরূপ ঘটিল। বুদ্ধি নিজে বুদ্ধিমান এ নিয়ে সন্দেহ নাই, কিন্তু যাহার মস্তিষ্কের কোষগুচ্ছ আবাস করিয়া উহা রহিয়াছে তাহার প্রতি বিন্দুমাত্র করুণা তাহার আছে বলিয়া বোধ হয় না। কারণ বলিতেছি। যাহা বুঝিতে চাই, তাহা উহা বুঝাইতে চাহে না। যাহা উহা বুঝাইতে চাহে, আমি আবার তাহা বুঝিতে চাহি না। কি গোল! তাহার উপর উহার গুমোর প্রবল। কিঞ্চিৎ বাহিরের বাতাস লাগিলে কাহিল হইয়া পড়ে। আপন ঘরে দরজা জানলা দিয়া, দাবার ঘুটি সাজাইয়া প্রবল পরাক্রমে কখনও নিজেকে, কখনও নিজের ছায়াকে, কখনও আমাকে প্রতিদ্বন্দ্বী করিয়া কোমর কষিয়া যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। যখন বলি, বাহিরে বসন্ত আসিয়াছে, ভ্রুকুটি করিয়া আমার দিকে তাকায়। যদি কাহারো নয়নে নয়ন মিলিল, অমনি মস্তিষ্ক হইতে চিরকুট পাঠায় - মূর্খ! ফলে বোঝাই যাইতেছে বুদ্ধির সহিত সহজ বনিবনায় ঘর করা এ জীবনে আর হইল না। 
যদি ঘটনাটি এতদূর হইত, তাও সামলানো যাইত। কিন্তু সমস্যা আরো গভীর। বুদ্ধি যেদিন মস্তিষ্কে পাকাপাকি থাকিতে আসিল, সেদিন উহার দিকে কিঞ্চিৎ অপ্রসন্ন হইয়া মুখ ভার করিয়া রহিল হৃদয়। এই হৃদয় শব্দটি বড় অপর্যাপ্ত। বলা যাইতে পারে উৎপেতে কক্ষ। বুদ্ধির সহিত বনিবনা না হউক, তবু উহার গতিবিধি ঠাহর করিতে পারি। কতটা উঁচুতে উঠিল চড়িতে না পাই, দূর হইতে দেখিতে পাই, ও নামিয়া আসার অপেক্ষায় থাকি। কিন্তু এই উৎপেতে কক্ষটির অভ্যন্তরে যিনি থাকেন তাহার গতিবিধি ঠাহর করা এক প্রকার অসাধ্য বুঝিয়া রণে ভঙ্গ দিয়াছি। কোনো নীতি, ধর্ম, নিষেধ উহার কর্ণগোচর হয় না। সব কিছু আপনি গড়িয়া লইতে চায়। যত বলি এইরূপ ব্যবহার করিলে সমাজ মানিয়া লয় না। সে বলে, “সমাজের দোহাই বুদ্ধির কাছে পাড়িও, আমার কাছে নহে”। বুদ্ধি শুনিয়া বলে- “আজন্ম আকাট মুর্খ!” হৃদয় বলে, “শুষ্কজীর্ণ বৃদ্ধ!” ব্যস, লাগিয়া গেল। কার পক্ষ লই? অগত্যা 'আমার কাজ আছে' বলিয়া সেই কুরুক্ষেত্র হইতে পলাইয়া আসি। দূর হইতে শুনি চলিতেছে বাদ-বিতণ্ডা, বাহিরের লোক জিজ্ঞাসা করে, "অন্যমনস্ক দেখি যে?” মনে মনে বলি, আর দাদা অন্যমনস্ক, অন্যের মন লইয়া ঘর করিবার যে জ্বালা। বাহিরে কৃত্রিম হাসিয়া বলি, 'ও কিছু নহে'। ঘরের কথা পাঁচকান করিয়া কি লাভ! 
তবে এইটুকু বুঝিয়াছি, আপনাকে বুদ্ধিমান অথবা ইন্টেলেকচ্যুয়াল বলিয়া দাবি করিবার কোনো অভিপ্রায় মনের কোনো কোটোরে না রাখাই ভালো। যদ্দিন এই উন্মাদাশ্রম ফেরৎ হৃদয়খানিকে বশে না আনা যাইতেছে ততদিন বুদ্ধির সহিত পূর্ণ বনিবনা সম্ভব নহে। উহা যাহারা পারিয়াছেন তাহাদের শ্রীমস্তিষ্ককে জোড়করে প্রণাম জানাই। আমি আপাতত ফিরি গঙ্গাতীরে, সংসার একঘরে করিয়াছে, বাউল বলিয়াছে তুমি বড্ড শিক্ষিত, অগত্যা ঘর ও ঘাটের কোনো ঠিকানাই যখন পাকাপাকি হইল না তখন গঙ্গাতীরই শ্রেষ্ঠ স্থান। কোনো একটি তরণী যদি ভুল করিয়া এই দিকে আইসে, যাহার মাঝির সহিত পূর্ব জনমের পরিচিত এমন বোধ হয় নয়নে নয়ন মিলিবা মাত্র, তাহার নৌকায় কিঞ্চিৎ স্থান ভিক্ষা চাহিয়া লব। তাহার পর সে যেদিকে লইয়া যায় যাইব। বুদ্ধিকে বলিব, এইবার তুমি আইস, আমার প্রয়োজন মিটিয়াছে, ওপারে তোমার না হইলেও চলিবে, আর হৃদয়কে বলিব সম্মুখে মাঝির দিকে চাহিয়া থাক, হাল ধরিবার প্রয়োজন নাই তোমার, গান ধরিবার সব প্রয়োজন ফুরাইবার পর যে প্রয়োজন থাকে, তাহা রহিয়াছে। নাও খানি বাও মাঝি, জুড়াই গঙ্গার শীতল স্পর্শে!