সংসারে বিদ্যাসাগরের অভাব হয়নি কোনোদিন। আজও নেই। বরং বিদ্যাসাগরের সুনামিতে সমাজের প্রাণান্তকর অবস্থা হয় মাঝে মাঝে। বিদ্যাসাগরেরা প্রাচীনকালেও ছিলেন, আজও আছেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন। বিদ্যাসাগরের ঢেউয়ের গর্জনে কান ঝালাপালাও হবে।
করুণাসাগরের অভাব বড় বেশি। করুণাসাগর কথাটার মধ্যে না আছে গ্ল্যামার, না আছে আভিজাত্য, না আছে গৌরব। তাই করুণাধারার কুলকুল শব্দ, সাগরের গর্জনে চাপা পড়ে থাকে।
আজ করুণাসাগরের জন্মদিন। আজ খবরের কাগজের প্রথমপাতা জুড়ে কমলা ভাসিনের চলে যাওয়ার কথা। কমলা ভাসিনের জীবন বোঝায়, করুণাসাগরের কাজ শেষ হওয়ার নয়। একজন মহাপুরুষ যদি মশাল হন, তিনি যদি জ্বলেই নিভে যান, তবে আরো গভীর অন্ধকার সৃষ্টি হয়। কিন্তু তা হয় না। আরো আরো অনেক প্রদীপ জ্বলে ওঠে। আলোর ধারাস্রোত চলে।
কমলা ভাসিন চেয়েছিলেন সমান মর্যাদা। পুরুষতন্ত্র থেকে শুধু নারীকে বাঁচাতে চাননি, চেয়েছিলেন পুরুষকে বাঁচাতেও। লিখেছিলেন - একজন কি করে বলবে, আমি এটা পারি না, আমার দ্বারা এটা সম্ভব নয়, কি করে বলবে? সে তো পুরুষ, তাকে তো সব পারতে হয়! হ্যাঁ, পুরুষতান্ত্রিকতা এইভাবেই সগর্বে, ঔদ্ধত্যের সঙ্গে পুরুষকেও তিলে তিলে শেষ করে। যাকে পুরুষ গর্বের সঙ্গে বলে, বলিদান।
বিদ্যাসাগর কাঁদতে পারতেন। হ্যাঁ, আমাদের সমাজ যাকে মেয়েদের মত কাঁদা বলে, সেরকমভাবেই কাঁদতে পারতেন। এ ক্ষমতা ওঁর ছিল। কারণ অভেদ্য, দুর্গম পৌরুষত্ব রাখার দায় ছিল না ওঁর, ছিল মনুষ্যত্বের সীমাহীন অনুকম্পায় ডাকে সাড়া দেওয়ার দায়বদ্ধতা।
কমলা ভাসিন বলতেন, প্রকৃতি ভেদ সৃষ্টি করে, ভেদভাব নয়, সমাজ সৃষ্টি করে ভেদভাব। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় সমাজে দুই স্তরের মানুষের মধ্যে পার্থক্যটাকে বড় করে দেখলে সম্পর্ক গড়ে ওঠে কি করে? মৈত্রী, ভালোবাসার চাদরে ঢাকা পড়ে সেই পার্থক্যের গর্তগুলো।
ভারত, বাংলাদেশ থেকে যে চারজন মানুষ অর্থনীতি ও শান্তির সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত, সেই, অমর্ত্য সেন, অভিজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, কৈলাশ সত্যার্থী, মহম্মদ ইউনুস - এঁদের প্রত্যকের কাজ অতি সাধারণ মানুষকে নিয়ে। যাদের মধ্যে একটা বৃহৎ অংশ নারীরা। যা নিয়ে তাঁদের কাজ, সেই, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষানীতি ইত্যাদিতে নীতি শব্দটা এসে দাঁড়ায়। অভিধান শব্দের বুৎপত্তি যাই বলুক না কেন, শব্দের মর্মার্থ জানে মর্ম। শ্রদ্ধেয় এই চারজন মানুষ সম্পূর্ণ সত্যকে দেখতে চেয়েছেন। মর্মে জেনেছেন। মনুষ্যত্বর অধিকারকে জাগ্রত করতে নারী ও শিশুদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষার অধিকার নিয়ে ভেবেছেন। রাস্তা খুঁজেছেন। একি শুধু বিদ্যার কাজ? মানুষকে হারিয়ে যাওয়া থেকে আটকানো, সেকি এত সোজা কাজ? আমরা কতজন জানি যে মানুষ হারিয়ে যায় অতি সহজেই? Poor Economics বইতে ১৮৪ পাতায় অভিজিত মহাশয় লিখছেন - In the 1980s, in a now classic article in the New York Review of Books, Amartya Sen calculated that there were 100 million 'missing women' in the world.
এত মানুষ হারিয়ে যায়?! বিস্ময় লাগে। স্তম্ভিত হই। এই চারজন মানুষের সবার লেখা তো পড়া সম্ভব হয়নি, তবে অমর্ত্য সেন ও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা যতটা পড়েছি, ততটা বুঝেছি, যা দেখি, যা জানি, তা কতটা সীমিত। মানুষ চোখ ফিরিয়ে, মুখ ফিরিয়ে রাখলেই কি সবশুদ্ধ 'নেই' হয়ে যায়? আমরা তাকাতে চাই না। আমরা শুনতে চাই না। আমরা আমাদের বিদ্যাসাগরে ডুব দিয়ে ঝিনুক কুড়াই, বাড়ি সাজাই, নিজের জীবনকে আরো কিসে মনোহর করে তোলা যায় সেই চেষ্টায় বিদ্যাসাগরের তীরে তীরে ঘুরি, জাল নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দিই, ব্যক্তিগত লাভের আশায়। কিন্তু কিছু মানুষ জেগে থাকেন। বারবার মুখ ফেরানোর জন্য ডাকেন। শুনি বা না শুনি তোয়াক্কা করেন না, ডেকেই যান, ডেকেই যান।
কমলা ভাসিন বলেন, আবার মূল ধরে নাড়া দেব, ওদের অত্যাচার আর শোষণের প্রাসাদের ভিত্তিভূমি নাড়িয়েই ছাড়ব। এই কথা শুনে মনে পড়ে মায়া অ্যাঞ্জিলেউ এর কবিতা Still I Rise. একই কথা, একই কথা। বিশ্বের দুই আলাদা প্রান্তের মানুষ। কিন্তু সে পার্থক্য শুধুই ভৌগোলিক।
মনুষ্যত্বকে বাদ দিয়ে যে প্রাসাদই বানানো হোক না কেন, সে কোনোদিন চিরকালীন হয় না। এ বোধ পাণ্ডিত্য জন্ম দেয় না। এ বোধ অন্তরের আলোকের। রামকৃষ্ণদেব বলতেন বিবেক-বৈরাগ্যহীন পাণ্ডিত্যর কোনো মূল্য নেই। চিল অনেক উপরে ওঠে, কিন্তু দৃষ্টি থাকে ভাগাড়ে।
বিদ্যাসাগরের কাজ শেষ হয়নি। এখনও অনেক অনেক রাস্তা বাকি। কমলা ভাসিনের কাজ শেষ হয়নি। এখনও অনেক অনেক রাস্তা চলা বাকি। কমলা ভাসিন বুঝিয়েছেন, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন, পুরুষতান্ত্রিকতা লিঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কহীন এক প্রাচীন অস্বাস্থ্যকর মানসিকতা। তিনি বারবার বলেছেন, আমি পুরুষতান্ত্রিকতায় বিশ্বাস রাখা নারী যেমন দেখেছি, তেমনই নারীবাদী পুরুষও দেখেছি।
ভাসিনের মেয়েদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হওয়া, বিদ্যাসাগরের সেদিনের সমাজে রুখে দাঁড়ানো, রামমোহন রায়ের সতীদাহপ্রথা রোধের লড়াই, কি আজকের দিনে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত মানুষদের নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্যাবস্থার জন্য লড়াই - এ চলতেই থাকবে, যতদিন না সাম্যাবস্থায় আসে সমাজ। তবে এইটুকুই মনে রাখার, সে কাজ বিদ্যাসাগরের শুধু নয়, সে কাজের সিংহভাগ প্রেরণা জন্মায় করুণাসাগরের হৃদয় থেকে। যার শিক্ষা বইয়ের পাতায় নেই, সজাগ মনুষ্যত্বর ডাক সে।