সত্যের সমস্যা মিথ্যাকে নিয়ে ততটা নয়। মিথ্যা সত্যের সতীন। তাদের মধ্যে কোন্দল আছে যেমন, তেমন পাশাপাশি অবস্থান করে সংসার চালানোও আছে। সত্যে মিথ্যায় মিলে জগৎ সংসার। এ আমরা একপ্রকার মেনেই নিয়েছি। এইতেই স্বাভাবিক ছন্দ আমাদের। কে আর বেছে বেছে খাঁটি সত্যে জীবন ধারণ করবে রে বাবা, অমন পরমহংস হলে আমাদের পেট ছেড়ে দেবে। তাই মানুষের আরেকটি আবিষ্কার হল, অতিশয়োক্তি।
সত্যের সমস্যা একে নিয়েই বেশি। কারণ সে সত্যের ছদ্মবেশী। তিলকে তাল করতে যে অল্প পরিমাণ তিল লাগেই, সেইটেকেই সে কাজে লাগায়। অতিশয়োক্তি, অত্যুক্তির সঙ্গে লড়া বেশ শক্ত তাই। মানে বিশেষ করে তর্কের সময় যারা এই অতিশয়োক্তির সাহায্য নেয় তাদের নিয়ে মহাঝামেলা হয়। ক’দিন আগেই যেমন তালিবানদের সঙ্গে সব এক হয়ে যাচ্ছিল, মায় মেয়েদের সিঁদূর পরা অবধি। সে নাকি আমাদের সমাজ তালিবান শাসনের সমান। কেউ একজন লিখলেন, তালিবানেরা আর আমেরিকানরা নাকি একই রকমের বর্বরতা চালায়। অথচ বাস্তবে মানুষ কাবুলের ভিসা না বার করে আমেরিকা যাওয়ার জন্যে পড়িমরি করে জাতে উঠতে চায়। তারপর ‘হিন্দুত্বা’ আর ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ নাকি একই রকম। এখন এই কথাগুলোর মধ্যে যে হোয়াইট লাই আছে তা তো নয়, সবই অতিকথন দোষে দুষ্ট। এগুলো সব তথ্য হিসাবে সত্য। কিন্তু যে ভাবে উপস্থাপিত করার চেষ্টা হচ্ছিল তা নিতান্ত অতিশয়োক্তি। এবং সত্যকারের সেই মাত্রায় ভয় নেই বলেই তারা যে পাব্লিকলি এইসব কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখছেন এও সত্য। সে তারাও ভালো করেই জানেন। অনেকে আবার দেখেছি, "জানেন আমায় থ্রেট করেছে" লিখে বেশ গর্বও অনুভব করেছেন। পরে জানা গেল কেউ থ্রেট করেনি। উনি চেয়েছিলেন বা আশঙ্কা করেছিলেন। হল না দেখে হতাশ হয়ে ওসব লিখেছেন। এ সবই অতিশয়োক্তির উদাহরণ। তিল নেই বলছি না, তবে তা তালে পরিণত হয়নি এখনও তাই বলছি।
তবে অন্য ক্ষেত্রে এই অত্যুক্তির মধ্যে একটা বেশ সামাজিক গোবেচারা, ভালো মানুষ ইমেজ আছে। মানে, "আরে আমি তো ভালোবেসেই বললাম.. আরে ইচ্ছা করেই তো বাড়িয়ে বললাম, যাতে উনি খুশী হন"... ইত্যাদি ইত্যাদি। সমাজে ভদ্রতার নামে যে কত অতিশয়োক্তি চলে আর নিন্দার জন্য যে কত অল্পোক্তি চলে সে বলাই বাহুল্য। কথাটা বাড়িয়েই বলি আর কমিয়েই বলি, দুটোতেই সমস্যা। সে অত্যুক্তিই হোক, কি অল্পোক্তিই হোক। সত্য থেকে সরে এলো তো অবশ্যই।
তবে কাব্যে এ বড় দরকারি বস্তু। আর ধর্মে। প্রেমে আর ভক্তিতে অতিশয়োক্তির জয়জয়কার। এ ছাড়া ও দুটিকে টিকিয়ে রাখা বেশ কঠিন। তবে সে নিয়ে লোকে খুব একটা মাথা ঘামায় না। সে কাব্যের জগতে আর ভক্তির জগতে আপন মতে নিজের মত করে থেকেই যায়। বুদ্ধ যখন বলেন, জগতে শুধুই দুঃখ, এ যেন অতিশয়োক্তি। আবার বেদান্ত যখন বলেন, জগৎ আনন্দময়, তখন মনে হয় এও অতিশয়োক্তি। জগত আসলে জগতের মতই। রামকৃষ্ণদেব এসে যখন বলেন, জগতটা বালিতে চিনিতে মেশানো, তখন মনে হয়, বাহ্, এই তো খাঁটি কথা। এ অতিশয়োক্তি হল না। একজন এসে রামকৃষ্ণদেবকে বললেন, আপনি জগৎ ত্যাগ করতে বলেন, তবে সংসারের সৃষ্টিলীলা চলবে কি করে? রামকৃষ্ণদেব বললেন, তা সবাইকে তো বলি না। আমি বলি মনে ত্যাগ করো।
তখন সে বলল, কিন্তু তিনি সৃষ্টি করবেন বলেই না এই জগত সৃষ্টি করেছেন, এই তো তাঁর ইচ্ছা!
ঠাকুর বেশ উষ্মার সঙ্গেই বললেন, তা মহামারী, বন্যা, ভূমিকম্প --- এই সবে তাঁর ইচ্ছা দেখো না কেন বাপু!
কথামৃতে এ এক অদ্ভুত বিষয়। অতিকথন ওনার মুখে একটাও নেই। রামকৃষ্ণদেব একজনকে রাজা বলে ডাকতে পারলেন না, সেটা তার উপাধি ছিল যদিও। কারণ হিসাবে বললেন, এটা তো মিথ্যা কথা বলা হত, তুমি তো আসলে রাজা নও।
আরেকটা ঘটনা, কোথাও একটা উষ্ণ প্রস্রবণ আছে। একজন ওনার সামনে বলল, দেবী নাকি ওইখানে রান্না করেছিলেন। রামকৃষ্ণদেব শুনলেন, কিন্তু মানলেন না। কারণ এটা ভক্তির অতিকথন। মাষ্টারের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন, কারণটা কি গা? মাষ্টার তখন তাঁকে রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণটি বোঝালেন। আবার কোনো একটি ভক্তিগ্রন্থ একজন পড়ে শোনাচ্ছেন। ভক্তিমাল। উনি শুনে বললেন, একজনকে বড় করে দেখাবে বলে বেশি বেশি লিখেছে।
এটা ওঁর স্বভাবের একটি বৈশিষ্ট্য। অন্যমনস্ক রাণীর গালে চড় মারতেও ভয় পাননি, আবার অধর, বঙ্কিম প্রমুখ উচ্চপদস্থ মানুষদের মুখের উপর উচিৎ কথাটা বলতেও বাধেনি। ভয় পাননি ওর ভবিষ্যৎ কি হবে ভেবে। রাণী ক্ষিপ্ত হননি। কারণ সে চড়ে শাসন ছিল, অপমান ছিল না। রাণীর অনুচরেরা ক্ষিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু সে মানুষটা তো কি খাব, কোথায় যাব, কি পরব, রোগ হলে চিকিৎসা করার টাকা কোথায় পাব --- এই সব ভেবেও নিজেকে সংযত রাখতে পারতেন? মানে আমাদের মত চালাক নীতিবান হতে পারতেন। কিন্তু তা করেননি। শুধু সত্যের অমার্যাদা হবে বলে।
কথামৃতে রামকৃষ্ণদেবের মুখে নিজের স্তুতি শুনে স্বামীজি, মানে তখনকার নরেন সঙ্কুচিত হতেন। ঠাকুর কেশব সেনের চাইতেও তার প্রশংসা এত কেন করেন? কোথায় কেশব সেন, যিনি দেশ বিদেশ খ্যাত আর কোথায় চালচুলাহীন নরেন। বিবেকানন্দের মনে হত এ বুঝি ঠাকুরের ভালোবাসার অতিকথন। কিন্তু বাকিটা তো আজ ইতিহাস। সবাই জানে।
রামকৃষ্ণদেবের কথা বলার দুটো ধরণ আছে। এক আপনি কি শুনতে চান, আর দুই উনি কি বলতে চান। যে মানুষ নানা তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে চান, তিনি তাকে সেই আলোচনায় ওই তুঙ্গে নিয়ে যাবেন। যে যে ভাবের হবেন তার সেই ভাবকে অক্ষুণ্ণ রেখেই। ঠাকুরের নিজের দেওয়া উদাহরণ, ধোপাঘরের কাপড় রাঙানো গামলা উনি। যে যে রঙে রাঙতে চান, সে সেই রঙেই রেঙে যাবেন। মানে উনি রাঙিয়ে দেবেন।
কিন্তু যদি আপনি জিজ্ঞাসা করেন আপনি কি বলতে চান। উনি বলবেন, শুধু একজন ভালো মানুষ হও। আন্তরিক হও। ঈশ্বর কেমন এত কথা জানতে চাওয়ার দরকার নেই। আন্তরিক আর শ্রদ্ধাশীল হলেই হল। সৎ আর অসৎ দুটো রাস্তা, সৎ রাস্তাটা দিয়ে চলে যেতে হয়। জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বরলাভ। যদি জিজ্ঞাসা করা হয় ঈশ্বর কি? কথামৃতে কোনো সংজ্ঞা নেই। একটাই কথা আছে, তাঁর ইতি করা যায় না। তিনি ভালোমন্দ মিশিয়েই অস্তিত্ব। যদি বলেন, ঈশ্বর মঙ্গলময়। রামকৃষ্ণদেব বলেন, জানি না, এক এক সময় আমার মনে হয় তাঁকে ভালো, আবার এক এক সময় মনে হয় তিনি মন্দ। অর্থাৎ, কোনোদিকেই ঝোল টেনে উনি কথা বলবেন না। ওঁর কথায় থাকবে সত্য। সে সত্য ধারণের যোগ্যতা আসবে মান আর হুঁশে। মান আর হুঁশ যদি ছেড়ে গেল, তবে সব ছেড়ে গেল। ঈশ্বর তো গল্প তখন। রামকৃষ্ণদেবের উপলব্ধি না। একটা অভিজ্ঞতা দিয়ে শেষ করি---
একজন গরীব মানুষ কাজ করতেন আমাদের বাড়ি। বিশেষ কারণে কাজ ছেড়ে দিতে হল। বেশ কিছু মাস পরে ওনার বাকি টাকাটুকু নিতে এসেছিলেন। সামনে পুজো, মা তাই বোনাসের টাকাটাও দিলেন। উনি চমকে উঠে বললেন, আপনারা ভুল হিসাব করছেন, এত টাকা বাকি ছিল না।
এইটাই ধর্ম। এই সততটাই ঈশ্বরের আরাধনা। যার মধ্যে নিজের সততা নিয়ে না আছে গর্ব, না আছে অহংকার। একেই সে স্বাভাবিক জীবন যাত্রার নিয়ম বলে জানে। রামকৃষ্ণদেবের ঈশ্বর এদের সবাইকে নিয়ে, সমস্ত অতিশয়োক্তি আর অল্পোক্তির থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে।