ধর্ম পুস্তকবাহী না। চিত্তবাহী। ধর্ম মানে বিবেক। ধর্ম মানে নীতি। ধর্ম যা মঙ্গল, সত্য আর শান্তির স্থাপক হবে।
ধর্মগ্রন্থ কথাটা অক্সিমোরোন। ধর্ম কখনও গ্রন্থ হতে পারে না। ধর্ম ঈশ্বরেরই ধার ধারে না তো গ্রন্থের।
১) ধর্ম কাস্টমস না, প্রথা-আচার-আচরণ-অনুষ্ঠানাদি না।
২) ঈশ্বরে বিশ্বাস ধর্ম নয়।
৩) কোনো কিছুতে বিশ্বাসই ধর্ম নয়।
৪) কোনো থিওলজি ধর্ম নয়।
৫) কোনো ধর্মগ্রন্থ ধর্ম নয়।
৬) কোনো পুরুষ বা নারী ধর্ম প্রণেতা নন সম্পূর্ণভাবে, তিনি যত ক্ষমতাশালীই হোন না কেন।
৭) ধর্ম কোনো গাইডলাইন না।
৮) প্রাচীনত্বের হিসাব ধর্মের প্রমাণের নিয়ামক নয়।
ধর্ম একটা প্রতিক্ষণের অন্বেষণ। সত্য, মঙ্গল আর শান্তির দিশা অন্বেষণ। সে যদি আমার চিত্তের নিমিত্ত হয় তবে সে আমার স্বধর্ম। সে যদি আমার পরিবারের জন্য হয়, তবে সে আমার পারিবারিক ধর্ম। সে যদি আমার রাষ্ট্রের জন্য হয়, তবে সে আমার রাষ্ট্রধর্ম।
ধর্ম শব্দটা ছোটো হতে হতে, রিলিজিয়ন হতে হতে, এখন কাল্ট হয়ে ওকাল্ট এর দিকে যাচ্ছে। যা আদৌ তার মূল অর্থ নয়।
যখন বলি ধর্মের নামে অনেক রক্ত বয়ে গেছে, তখনও ভুল বলি। ধর্মের নামে না, কোনো মতের নামে। কোনো রিলিজিয়ানের নামে। কোনো কাল্টের নামে। যা ঔদ্ধত্য, অহংকার আর স্পর্ধার তাণ্ডব। এই শব্দগুলো ধর্মের সঙ্গে যোগ করা মানে সোনার পাথরবাটি বলা।
বিজ্ঞান মানুষকে সত্য, মঙ্গল আর শান্তির দিশা দেখাতে পারে না। সে দিশা দেখায় মানুষের শুভবুদ্ধি, বিবেক। যা ভালোবাসা বা সহমর্মিতা ছাড়া জন্মায় না। যখন বলা হয় অহিংসা পরমধর্ম, তখন তা অসীম সম্ভাবনাময় সত্য কথা হয়। অহিংসার অর্থ কোনোদিন নন ভায়োলেন্স হতে পারে না। অহিংসা একটা চিত্তস্থিতি, যা কর্তব্যের সঙ্গে গুলিয়ে যায় না। যে সৈনিক দেশের সীমা রক্ষার দায়িত্বে আছেন, তিনিও অহিংস হতে পারেন। কিন্তু সময় বিশেষে কর্তব্যের জন্য হত্যার রাস্তা নিতেই হয়। তার জন্য তার রাতের ঘুম নষ্ট হয় না। দুষ্টদমন আর অহিংসা একই সঙ্গে থাকতে পারে, কিন্তু নিরীহ মানুষ হত্যা আর অহিংসা একসঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। কর্তব্য আর চিত্তস্থিতি দুটো আলাদা শব্দ, যা আপাতভাবে স্ববিরোধী হলেও বাস্তবে নয়।
সত্যানুসন্ধান বিনা সত্যানুসরণ সম্ভব নয়। অন্য কেউ আমাকে সত্য দিতে পারে না। ব্যাখ্যা দিতে পারে। মত দিতে পারে। তথ্য দিতে পারে। সত্য দিতে পারে না। সত্য আমার চিত্তে জন্মায়। আমার চিত্ত যখন বৈরিমুক্ত হয়। আমার চিত্ত যখন চঞ্চলতা মুক্ত হয়। আমার চিত্ত যখন ক্ষুদ্রতা, সঙ্কীর্ণতা মুক্ত হয়। আমার চিত্ত যখন জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাযুক্ত হয়। সেই সময়ে আমার চিত্তে সত্য প্রতিভাত হয়। সে কোনো বইয়ের তত্ত্ব নয়, সে সম্পূর্ণ আমার।
শিশুর কান্নার আওয়াজের অর্থ শুধু মা বোঝেন। সে কান্না খিদের, না পেট ব্যথার, না ঘুমের। মা যেমন শিশুকে বোঝেন, তেমনই প্রতিটা মানুষ বোঝে তার চিত্তের পক্ষে কোনটা মঙ্গলের রাস্তা, শান্তির রাস্তা। যেটাই মঙ্গলের রাস্তা, শান্তির রাস্তা সেটাই সত্যের রাস্তা। বুদ্ধির সত্য মানে তথ্য, তত্ত্ব। যা বিজ্ঞান। চিত্তের সত্য মানে মঙ্গল, সংহতি, ভালোবাসা। যা ধর্ম।
পৃথিবীতে দুর্দিন কোনো নতুন ঘটনা নয়। মানুষের জীবনে সব চাইতে বড় অন্ধকারের সময় চিত্তের, বোধের অন্ধকারের যুগ। আজ সেই দিন নয়। আজ এইটুকু অন্তত আমরা জানি কে মানবতার শত্রু, কে নয়। এই বোধকে কোনো মত, কোনো কাল্ট, কোনো রিলিজিয়ন আমাদের আর অন্ধ করে দেবে না। এ নিশ্চিত। যুদ্ধ সংঘাত অবশ্যম্ভাবী। সে নিজের পাশবিক প্রবৃত্তি, অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে হোক কি বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে হোক। সংঘাত ছাড়া রাস্তা পাওয়া যায় না। তবে সে সংঘাত কর্তব্যের বোধজাত হোক। সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধি বা বৈরিবুদ্ধিজাত না হোক। তবেই রাস্তা পাওয়া যাবে। কারণ সবার শেষ কথা অবশ্যই, অহিংসা পরম ধর্ম। এই একটি শব্দে চিত্তমন্থনের সবটুকু বলা আছে। কিন্তু খুঁজতে হবে নিজেকেই। নিজের মত করে। নিজের ব্যাখ্যায়, নিজের ভালোবাসায়, নিজের স্থিতিতে। ধর্ম প্রতি মুহূর্তে খোঁজার জিনিস, বিশ্বাস করে স্থবির হওয়ার নয়, এ মনে রাখতে হবে।