কয়েকটি কথা আবশ্যক বিবেচনা করিয়া লিখিবার প্রয়াস পাইতেছি। আমি নানাবিধ বিষয় লইয়া লিখি। যে বিষয় আমায় পাইয়া বসে সেই বিষয়ই আমায় দিয়া লিখাইয়া ছাড়ে। কিন্তু কোনো বিষয়েই আমি নিজেকে অথোরিটি মনে করি না। অথোরিটির কোনো বাংলাই মনোমত না হওয়ায় অথোরিটিই লিখিলাম।
সংসারে ভ্রমণ করা বাধ্যতামূলক। আমি চলিতে না চাহিলেও সময় না চলিয়া থাকিতে পারে না। এবং যেহেতু সময়ের সহিত শ্বাসাদি নানা জৈবনিক ক্রিয়া সহ আমার জীবন, অগত্যা আমাকেও চলিতে হয়। চলিতে গেলেই পঞ্চেন্দ্রিয় বাচাল হইয়া উঠে। শুধু ইন্দ্রিয় বাচাল হইলে একপ্রকার হইত, মন ততোধিক বাচাল, সে বুদ্ধির হস্ত হইতে লাগাম কাড়িয়া, এমন হেস্তনেস্ত বাধাইয়া বসে যে তাহাকে সামলায় কার সাধ্যি। সে এইদিকে উঁকি দিয়া, সেইদিকে বেড়া ভাঙিয়া ঢুকিয়া, সোজা পথকে বাঁকা করিয়া, বাঁকা পথকে কুটিলজটিল করিয়া একটি দক্ষযজ্ঞ বাধাইয়া থাকে। সুবোধ হইবার কোনো লক্ষণ এই বয়েস অবধি হইল না যখন আর হইবে বলিয়া আশা রাখি না।
তো পথে চলিতে চলিতে যাহা দেখি তাহাকেই সম্পূর্ণ অথবা যাহা শুনি তাহাই সম্পূর্ণ - এমন বলি না। শুধু বলি না তাহাই নহে, যখনই কেহ বলেন, এই হইল সম্পূর্ণ কথা, তখন তাহাকেও দূর হইতে নমস্কার করিয়া পালাইবার পথ খুঁজি। কারণ সাধারণ বুদ্ধিতে বুঝি, সম্পূর্ণ হইলে বাদ পড়িবার মত কিছু অবশিষ্ট রহে না। আমি এমন শিষ্ট নহি যে অবশিষ্টকে ছাড়িয়া শুধু এক কাল্পনিক সম্পূর্ণ লইয়া কোথাও স্থির হইব। "অন্ত কে তার সন্ধান পায়, ভাবিতে লাগায় ধন্দ"। রবি ঠাকুর গাইলেন। আমার প্রাণে ধরিল। এমনকি রামকৃষ্ণ ঠাকুর যখন বলিলেন, "আমার বলিবার আমি বলিলাম, এবার তোমার ল্যাজামুড়া বাদ দিয়া লও", সেও মনে ধরিল। গীতা যখন সমস্ত তত্ত্ব বলিবার পর বলিলেন, "যথা ইচ্ছসি তথা কুরু" - সেও মনে ধরিল। নইলে গীতা বলিবার পর যুদ্ধ বাধাইবার উপক্রম করিলে কৃষ্ণ যদি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের মত বেত্র হস্তে লইয়া দুর্যোধনাদির প্রতি ধাবিত হইতেন, ও হুঙ্কার দিয়া বলিতেন, "ওরে মূঢ়, অদ্বেষ্টা সর্বভূতানাম... ইহাই ধর্ম, ইহাই অমৃত এত করিয়া বলিলাম, মায় বিশ্বরূপ অবধি দেখাইলাম, তাও যুদ্ধ করিবি….."। তবে কৃষ্ণকে ভয় পাইতাম, তাহার বংশীকে নিতান্তই সৌজন্য বলিয়া বোধ করিতাম, সত্য নয়।
অগত্যা দেখিলাম, কেহই আপনার অথোরিটিত্ব লইয়া সংসারে মাথা ঘামান না। এতাদৃশ মহৎ ব্যক্তিত্ব যদি আপনাকে অথোরিটি বলিতে ইচ্ছুক না হয়েন, তাহা হইলে অ্যামিবা সদৃশ আমিই বা কি করিয়া কয়েকটি পুস্তককে আঁকড়িয়া চীৎকার করিয়া জগত মাতাই, ওহে আমি সত্যকে জানিয়াছি তোমরা আমার নিকট আইস।
ঠিক এই কারণে আমি তর্কাদিতে স্বচ্ছন্দবোধ করি না। খুচরা ব্যবসায়ী আমি, আড়তের হিসাব রাখাকে দায় মনে করি না। কিন্তু আমাকে আড়তদার বানাইয়া, কেহ যখন কোমর বাঁধিয়া তর্কে ডাকেন, আমি বাঁধন খুলিয়া পালাইবার রাস্তা খুঁজি। কারণ তর্ক করিবার মানুষেরা প্রায়শই আপনাকে অথোরিটি ভাবিয়া গোঁফে চাড়া দিয়া বসিয়া আছেন দেখিতে পাই। জগতে নানা বিষয়ে তাহাদের সংশয় রহিলেও দেখিয়াছি নিজেকে লইয়া তাহারা মৃত কাষ্ঠের ন্যায় দৃঢ় ও সুনিশ্চিত। ইহা ভুল অবশ্যই, কিন্তু সে ভুল ভাঙাইয়া কি লাভ। তাহা হইতে ভ্রমের সঙ্গে সহবাস যে যাবৎকাল সুখের অনুভব আনে তাহাই না হয় রহুক।
ভারতের দর্শনের ইতিহাস বিচিত্র। তাহাতে ডুবিয়া একটি কথা সার বুঝিয়াছি, সত্য আছেন বটে, তবে তাহা সত্য বলিয়া নাই। আছেন রহস্য হইয়া। একই মাটিতে আত্মা সত্য ও মিথ্যা হইয়াছে। একই মাটিতে সত্য অবিনশ্বর আবার সত্য সদাবহমান পরিবর্তনশীল - ইহাও আছে। চার্বাকের বস্তুবাদ যেমন রহিয়াছে তেমনই কবীর-তুলসী-চৈতন্য-মীরার রোম্যান্টিক মিস্টিসিজম রহিয়াছে। তুমি কে হে, ইহার একটিকে তুলিয়া, ইহাই সর্বস্ব বলিবে? পাণিনি, জৈমিনি, বুদ্ধ, মহাবীর, কুমারিল, গৌতম, বাদরায়ণ প্রমুখ যাহারা স্বমহিমায় আজও ভারতের চিদাকাশে ভাস্বর হইয়া রহিয়াছেন, তাহারা এক একটি স্তম্ভ। সত্যের রহস্যময় অস্তিত্বের এক একটি স্ফুলিঙ্গ। তাহাদের শ্রীচরণকমলে শতকোটি প্রণাম।
অগত্যা সংসারে অথোরিটি হইতে চাহি নাই। "দু তিন দিনের জন্য ভবে কর্তা বলে সবাই মানে, সেই কর্তারে দেবে ফেলে কালাকালের কর্তা এলে", গানে রহিয়াছে। অর্থাৎ কেহই অথোরিটি নয়। সময় বিশেষে আজ যাহা প্রামাণ্য, কাল তাহাই ফিরে তাকাইবার বস্তু নহে। ইহাই রীতি। সময় নিষ্ঠুর। তাহার অনন্ত ছলিবার কৌশল, মোহে ফেলিবার লীলা। সে কাটাইয়া উঠিব ভাবিলেই কাটানো যায় না। এক ছলনা হইতে আরেক ছলনায় গমন মাত্র হইয়া থাকে। মিথ্যা হইতে মিথ্যায় গমন একটি প্রবল মিথ্যা। তাই সমস্ত গমনাগমনের ভ্রান্তি হইতে নিষ্কৃতি লাভের উদ্দেশ্যকেই ভারত মুক্তি বা নির্বাণ বলিয়াছে। কিন্তু ছলনাকে ক্ষতির বস্তু ভাবিয়া তাহা হইতে দূরে পলায়ন করিতে গেলে পথ আরো জটিল হইয়া যায়। ছলনা লাভ বা ক্ষতি কোনোটিই নহে। ভ্রান্তি কেবল ভ্রান্তিই। কিন্তু তাহাতেও সুখ। সে সুখের আয়ুষ্কাল সীমিত জানিয়াও সুখ। তাই এই ভ্রান্তিকেই ধরিয়া চলিতেছি। ভ্রান্তিহারী যিনি সময় করিয়া আসিয়া নিশ্চয়ই ভ্রম ভাঙাইবেন। কারণ ভ্রান্তি অনন্ত হইলে ভ্রান্তি সত্যের গুণবাচ্য হইয়া উঠে। তাহা স্ববিরোধী। অগত্যা এমনই চলুক। কেবল নিজেকে অথোরিটি না জানিলেই হইল। যাহা জানি তাহার সীমা আছে, গলা বাড়াইলেই বেড়া দেখা যায়। দু পা জোরে হাঁটিলেই পরিখায় আসিয়া দাঁড়াই। তাহার পর রহিয়াছে অসীম অজানা। তাহা আমার প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমা কিম্বা গ্রন্থ প্রমাণের বাহিরে। ইহাই শান্তির কথা। ইহাই বিস্ময়। ইহাই পরম আনন্দ। আমি আমাতে শেষ হইলেও, সত্য আমাতে শেষ হয় না। জয়গুরু।