আমার দিদা
সংসারে সুতার্কিক দেখেছি, ধূর্ত মানুষ দেখেছি। তারা বুদ্ধিমান অবশ্যই। তবে মনের পরিধি ছেড়ে গহন গভীরে প্রবেশ করে, আত্মচেতনাকে স্নিগ্ধ করে, সংসারকে শান্তিনিকেতন করে গড়ে তুলতে খুব কম মানুষকে দেখেছি।
আমিও গেলাম মিলিয়ে
আলো জ্বাললাম। আলোর সমুদ্রে
আমার ক্ষুদ্র আলো গেল হারিয়ে।
আমিও গেলাম মিলিয়ে।
আপনি কি বলেন?
এবারের পূজোর ছুটিতে আমরা বন্ধুরা মিলে অজন্তা বেড়াতে গিয়েছিলাম। ফর্দাপুর বলে অজন্তা সংলগ্ন একটা জায়গায় একরাত্রি হোটেল বাস করতে হয়েছিল।
সকালবেলা হোটেলের বয় আমাদের ঘরে চা দিতে এলো। ঘরের দ্রব্যসামগ্রীর দিকে ধাঁ করে একনজরে চোখ বুলিয়েই, হঠাৎ তার মুখটা সলজ্জ দুষ্টু হাসিতে রক্তিম হয়ে উঠল। তারপর একটু সংকোচের সাথেই বলল, সাহাব, এক বাত পুছে?
বললুম, বোলো।
আমি
আশীর্বাদ
অসময় অসময়ে এসে কড়া নাড়ল
সময়ের দরজায়
গিঁট বাঁধা হল না
পুঁথিগুলো ছড়িয়ে পড়ল মেঝেয়
আর যাই করো
আর যাই করো
কিছুটা জমি বাঁচিয়ে রাখো
ঘর তুলো না সবটাতে
একটা ছোটো উঠোন রাখো
তাতে গাছ না হয় নাই লাগালে
জানি ভীষণ তোমার ব্যস্ততা
ঘাসই না হয় থাকুক
তারা শিশিরে ভিজুক ভোরবেলা
আবার একটা মৃত্যু
আবার একটা মৃত্যু! না ইতিহাসের দৃষ্টিতে নতুন কিছু না। শুধু ইতিহাসের গতিপথটা বুঝছি না।
বার্টান্ড রাসেলের দুটো উক্তি ভীষণ ভাবে মনে আসছে। ওনার জীবনের একদম শেষের দিকে একটা টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে, ওনাকে আগামী প্রজন্মের জন্য কিছু বলতে বলা হয়েছিল (ইউটিউবে প্রাপ্য)।
আছো
ভিতরে আছো
ভিতর হয়ে আছো
মিলিয়ে আছো
ভিতর বাইরে জুড়িয়ে আছো
ঘিরে আছো
চারপাশেতে পরিধি হয়ে
প্রেমের বৃত্তে কেন্দ্র হয়ে আছো
আবছায়ার কথা
ছায়ার ভিড়ে ভিড়ে সার দিয়ে
মিশে কিছু কথা
ওদের ছায়া পড়ে না
রাতের বেলায় পেঁচার ডাকে
যখন সাদাডানা পরীরা দুঃস্বপ্ন দেখে
হাড় হিম করা ঠাণ্ডা হাওয়া
কবরের গায়ে আঁচড় কাটে
তখন ওই ছায়ারা মুখের ঘোমটা সরিয়ে
আবছা
কয়েক পশলা বৃষ্টি
মন খারাপের ঝিরঝিরে কথা
হঠাৎ আসা আবছা আঁধারে
ফেলে আসা দিনের ছেঁড়া পাতা
আশ্চর্য প্রদীপ
'একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে'- এর থেকে বড় আশ্চর্য প্রদীপ আছে কি? যার থেকে রোজ একটা করে দিন জন্মায়, সেই প্রদীপের দৈত্যের মত। নিত্য তার হাতে নতুন কিছু একটা কাজ দিই। কাজটা হয়তো সম্পূর্ণ হয়, কিন্তু আশাটা পূর্ণ হয় না। রাতে বালিশে মাথা রাখি আর পাশে রাখি সেই প্রদীপটা, সেই আশ্চর্য প্রদীপ - 'একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে!'
আমার আকাশ
যদি মনন, চেতনার হাত ছেড়ে ছোটে?
যদি অনুকম্পার কণ্ঠ, প্রকাশ ভঙ্গীর অলঙ্করণে পড়ে চাপা?
যদি স্থির জলাশয়ের স্বচ্ছ তলদেশ দেখাটা হয় অতিসরলীকরণ,
দেখতে হয় তাকে - গুলিয়ে, নেড়ে, ঘেঁটে..তারপর আন্দাজে তলদেশে ছুঁয়ে?
যদি বলতে চাওয়ার তাগিদের চেয়ে, বলতে চাওয়ার ভঙ্গীতে করতে হয় মুগ্ধ?
আমার অভিমানের বদলে
আদিম ভাষা
অন্য কোনো ভাষায় কথা বলবে?
যে ভাষাতে মিথ্যা বলা যায় না!
সাজানো শব্দরা কর্পূরের মত উড়ে যায়
সে ভাষার ভাষা আমি জানি,
তুমিও জানো
সে অনুচ্চারিত চিরটাকাল
তবু প্রকাশিত
তার উপরে আমার সৌখিন ভাষার প্রলেপ
মিথ্যার বুনুনিতে প্রাণের স্বাচ্ছন্দ্য মরে দম আটকে
আমি মূক হয়ে বলি কথকতার জাল
বধির হয়ে শুনি মিথ্যার বিষাদাবলী।
আমার না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে
"এমন কোনো পরিস্থিতি নেই, যার ওপর রবীন্দ্রনাথের কোনো গান বা কবিতা পাওয়া যায় না।"
এ কথা আমিও আগে বিশ্বাস করতাম। বিশেষ করে গানের ক্ষেত্রে এ উক্তিটিকে ধ্রুবসত্য বলে জানতাম।
আজ মনে করি না। আজ সে কথা কেউ বললে ভাবি, হয় আপনি পুরো গীতবিতানের পথ হাঁটেননি, নতুবা মানুষটাকে বোঝেননি। অহংকারীর মত শোনালো?
আছি, আসছি, এসেছি
অভিমানের ঘরের দরজা বন্ধ হোক
সে আসুক, যে জন্মালো এই গভীর রাতে
বাঁশি বাজুক আবার,
নূপুরের রিনিরিনি শব্দের সাথে বাজুক
বনের মর্মর
আমি কান পেতে গভীর গহন আলোয়
আশ্বাস
প্রতিটা গাছ
সারাটা রাত
স্থির আশ্বাস
দাঁড়িয়ে একা
হবেই ভোর
কাটবে ঘোর
তরুণ অরুণ
দেবে দেখা
আবছায়া
(কঠোরভাবে অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য)
আবর্ত
শত্রুপক্ষ কেউ নেই
যাঁরা আছেন তাঁরা
বিপরীতপক্ষ
আর আছেন কেউ কেউ মাঝে
নিরপেক্ষ
আসল উৎসব
এই প্রথম শান্তিনিকেতনের কোনো উৎসবে থাকার সুযোগ ঘটল, বা সৌভাগ্য হল বলা যায়। বৃক্ষরোপণ উৎসব। সার দিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা 'মরু বিজয়ের কেতন উড়াও' গানের সাথে সাথে নাচের মাঝে বৃক্ষকে মহাসমারোহে আহ্বান করে নিয়ে আসল।
না, আমি কোনো উৎসবের বর্ণনা দেব বলে লিখছিনা। উৎসব অনেক দেখেছি। অংশ নিয়েছি, হই হুল্লোড় করেছি।
আশঙ্কা
গোলাপকে দেখে মুগ্ধ হয়েছি
গোলাপ বোঝেনি কোনোদিন।
রামধনুর রঙ চোখ জুড়িয়েছে
মনে মনে বলেছি, বাহ্।
সে শোনেনি কখনো সেভাবে।
নীলাকাশের বুকে চাঁদের শোভা-
এও তো যুগান্তরের মাধুর্য্য
আত্মভোলা আবেগে বলেছি, উফ্
চাঁদ, আকাশ ফিরেও তাকায়নি।
তুমিও কি ওদের মতই হবে?
আক্ষেপ
এত বড় জীবন, কটা আক্ষেপ থাকবে না, তাও কি হয়!
ছোটবেলায় যখন লুডো খেলতাম, তখন খেলার শেষে আক্ষেপ হত না? - ইস্, ছয় পড়ল না কেন? হায় রে এই গুটিটা না খেলে ওই গুটিটা খেললেই ভাল হত...এরকম আরকি। তা সামান্য লুডো খেলতেই যদি এত ক্ষোভ, তো এত বড় জীবনটা কি করে কটা নির্ভেজাল ক্ষোভ ছাড়া হয়!
আজ
সেদিন কেউ কেউ কাছে ডেকেছিল,
বেরোনোর দরজা পাইনি।
সেদিন থেকে হাতড়ে হাতড়ে পেলাম
একটা ছোট্ট সুড়ঙ্গ আজ
নিজেকে হেঁচড়ে হেঁচড়ে বাইরে আনলাম
কোথায় গেল ওরা,
যারা ডেকেছিল?
আলো জ্বালো
শুধু বাইরে না,
হারায় মানুষ ভিতরেও।
খুঁজবে কি করে?
সে ভাবেই খোঁজো,
যে ভাবে খোঁজো বাইরে,
আলো জ্বেলে।
আলো জ্বালবে কি করে?
বিশ্বাসে।
যুক্তির নুড়ি
বিশ্বাসের আকাশকে ছোঁয় না।
আরো জোরে
বেঁচে থাকাটা
যার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে
প্রতিদিন একটু একটু করে
দোহাই একটু জোরে পা চালাও
ওর পাশে পৌঁছাতে হবে আজই
আর বেশি দেরি না করে।
যার দীর্ঘশ্বাসে বালিশ বিছানা পুড়ছে
এমনি কি ঘরের ছাদেও যার পোড়ার দাগ
দোহাই ভাই, আরেকটু জোরে ছোটো
ওর শেষ নিশ্বাস বেরোবার আগেই
ওর বুকে রাখতে হবে হাত।
আঘাত
সব আঘাত ভুলতেই তো চাই।
তবে কিছু আঘাত
ভুলতে চাই না,
এমনকি পরজন্মেও না।
কিছু সুরের আঘাত-
সে হোক না মোহরদি
কিম্বা মেহেদি হাসান
বিসমিল্লাহ্ কিম্বা রবিশঙ্কর
অথবা খোদার কণ্ঠস্বর- আমির খান
সেই আঘাতেই তো বেঁচে আছি
পারের কড়ি অলিন্দে লুকিয়ে।
আঁচড়
আমার সারা বুক ক্ষত-বিক্ষত
তোমার চোখের আঁচড়ে
তবু আসি কেন জানো?
মরণ যে কাছ থেকে এত সুন্দর,
তোমায় না দেখলে জানতাম কি করে?
আবছায়া কিছু কথা
আমি ছায়া নিয়েই বাঁচি
আমার ধর্ম
আলোর জন্য প্রার্থনা
অন্ধচোখে করেছিলাম
আলোর জন্য প্রার্থনা
ভেবেছিলাম
আলোতে হয়তো আপনি ফোটে চোখ
বুঝিনি কোনদিন
আলো হারানোর যন্ত্রণা
আলো
প্রদীপ পুড়তে চায়
পুড়তেই চায়
সে জানে পোড়া মানে আলো
আছে কি সম্পর্কের বিন্দুমাত্র লেশ
আছে কি সম্পর্কের বিন্দুমাত্র লেশ
তোমার মায়ের সাথে মায়ের আমার?
কি আছে সম্পর্ক বলো
তোমার পিতার আর আমার পিতার?
আসিস না
বরং এ বছর পূজোগুলো বন্ধ থাক
মাটিগুলো মাটি হয়েই থাক
এক নারীমূর্তি বানিয়ে কি লাভ?
আরো যা যা লাগে, খড়, কাঠ, বিচুলি
সে সবও না হয় যে যার জায়গায় থাক
বাঁশগুলো তুলে ফেলেছিলে?
প্যান্ডেল হবে না এবার,
নামিয়ে ফেলো,
তিরপলগুলোও গুদামঘরেই থাক
আপন হতে বাহির হয়ে
'বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর’ - আজন্ম শোনা কথা। যত বয়েস বাড়ছে তত হেঁয়ালির মত শোনাচ্ছে কথাটা।
আত্ম-কথন
প্রতিদিন ভোরের এই সমুজ্জ্বল অরুণোদয়
প্রতিদিন উচ্ছল ঝরণায় আঁকা
এই মায়াময় রামধনু
প্রতি সন্ধ্যায় দূরের অসীম আকাশের বুকে
আরক্ত হয়ে ওঠা তুষারাবৃত পর্বতশিখর
সূর্যালোকস্নাত ক্ষুদ্র মক্ষিকার আত্মমগ্ন গুঞ্জন