দেখেছি
আমি রাগী মানুষ দেখেছি
আমি কামুক মানুষ দেখেছি
আমি লোভী মানুষ দেখেছি
আমি ঈর্ষাপরায়ন মানুষ দেখেছি
আমি ঠগ মানুষ দেখেছি
আমি শঠ মানুষ দেখেছি
আমি খুনি মানুষ দেখেছি
আমি ধর্ষক মানুষ দেখেছি
আমি এদের সবার চোখেই একটা ভয় দেখেছি
আর সেই ভয়কে আড়াল করে
হিংস্রতার মুখোশ।
গণতন্ত্র
আজ প্রতিদিন না। আজ অন্যদিন। আজ এ বলবে, "খবরদার!" সে বলবে, "তবে রে!"
একজন বলবে, "ওঠো" অন্যজন বলবে, "বসো"। ঘরে থাকলে এ কূলের গোঁসা, বাইরে গেলে সে কূলের! যাই কোথা?
আড়াল
তোমায় বলা কথাগুলোর আড়ালে, আমার না বলা কথাগুলো আছে।
বোঝো তুমি?
সারাদিন দূরে থাকার অভিনয়ে
কাছে থাকতে চাওয়ার কাঙালপনা ধরা পড়ে তোমার চোখে?
তুমি পাশে আসলে আমার বেহায়া মনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে ছদ্ম শালীনতায় ঢাকি।
দেখতে পাও?
ছাপ
হাত ছিল ভিজে
দেওয়ালে ছিল কাঁচা রঙ।
ভিজে হাতে লাগল রঙ
কাঁচা রঙে লাগল হাতের ছাপ।
ভিজে হাতে উঠল রঙের দাগ
পাকা রঙে এখনো হাতের ছাপ।
মেয়েটা এখনো সে ভিজে হাতের খোঁজে।
পারি না
আমার ঘুমের আশে পাশে টহল দিচ্ছে
কিছু সশস্ত্র প্রহরী
স্বপ্নগুলোতে কারফিউ জারি।
আমার ভাবনাগুলোর চারপাশে টহল দিচ্ছে কিছু সশস্ত্র প্রহরী
খবরের কাগজে ওদের পায়ের ছাপ।
ভাষার সাথে সত্যের ভুল বোঝাবুঝি-
সত্যগুলো মিয়ানো পাঁপড়ের মত বানাতে চায় ওরা
আমি সেঁক দিয়ে রাখি মননের উত্তাপে
মিয়ানো সত্যে গা গুলায় আমার এখনও।
জল ছিটিয়ে গোলাপ তাজা রাখি না-
অকৃতজ্ঞ
আমায় ধাক্কা দিতে দিতে
ধাক্কা দিতে দিতে
খাদের ধারে নিয়ে আসলে।
আমি ঝাঁপ দিলাম না।
বললে, অকৃতজ্ঞ।
অ্যা-পলিটিক্যাল
আচ্ছা আপনাদের কি কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই! আমি বিজ্ঞানী মহাশয়দের বলছি। দু'দিন ধরেই ভয় দেখিয়ে চলেছেন – কলকাতার নীচ দিয়ে এমন একখানা পাত গেছে নাকি যে, তা একবার নড়েচড়ে বসলেই সব হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে। আজ আবার আরেকদল বিজ্ঞানী বলছেন, উঁহু শুধু তা তো নয়!
স্নেহ
কিছু দৃষ্টি ছায়ার মত
রোদে তাপে হঠাৎ ঠান্ডা জলের মত।
বয়স বাড়তে বাড়তে সে ছায়াদৃষ্টি কমে
অনেক গাছ নেই যে আর।
তখন ছায়াহীন মরুভূমিতে সে একা।
তার চোখে তখন ছায়ার দৃষ্টি
কিছু তরুণ, শৈশবের মুখে চেয়ে।
মোহনা
মাত্র দুটো ছবি ছিল মনে
এক, তুমি আসবে
দুই, তুমি থাকবে
দিন গেল
মাস গেল
বছর গেল
আমার মনে দুটো আশা
এক, হয়তো তুমি আসবে
দুই, হয়তো তুমি থাকবে
দিন গেল
মাস গেল
বছর গেল
আমার মনে দুটো ভয়
এক, বোধহয় তুমি আসবে না
দুই, বোধহয় তুমি থাকবে না
দিন গেল
মাস গেল
বছর গেল
মন
মন বাইরের দিকে ছুটেছে। সারাক্ষণ তার বাইরে বাইরে খোঁজ। সে ছুটে মহাকাশকে ছুঁতে চাইছে, সে প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে গিয়ে নুড়ি কুড়িয়ে আনতে চাইছে। সে আলোর বেগে ছুটতে চাইছে, মাতাল হাওয়ায় নাচতে চাইছে। সেই ছোটবেলায় একরকমের খেলনা ছিল, একটা যন্ত্রকে পাঁই পাঁই করে ঘুরিয়ে যাওয়া, ওর সাথে একটা দড়ি লাগানো থাকত সেটাও পাঁই পাঁই করে চরকীর মত ঘুরত। আমাদের মনটাও সেরকম। সারাদিন পড়িমড়ি করে ছুটছে। কেন ছুটছে?
আচমকাই
কিছু মুখ জানলার কাঁচের ওদিকে এখন
এদিকেই ছিল ওরা
এই তো কিছুক্ষণ আগেও
আর জল হাওয়া লাগবে না
আওয়াজ, আর্তনাদ, ডাক কানে যাবে না
আচমকাই হল,
কিছু বোঝার আগেই
প্রেম ও কাম
সংশয়ীর রোজনামচা
একটা ইতস্ততঃ বাঁচা
আগু- পিছু ভাবছে
ভাবতে ভাবতে দু'পা গিয়ে
চার পা ফিরে আসছে
একটা অস্বস্তির হাসি
ঠোঁটের আগায় ঝুলছে
ভাবের ঘরে চুরি-
বুঝছে, তবু করছে
একটা না-ভরসার মানুষ
হাতেতে হাত রাখছে
আঙুলের ফাঁকে জ্বালা জ্বালা
তবু হাত দেখি না ছাড়ছে
আশা
কিছু স্বপ্ন ঝরে গেছে
কিছু স্বপ্ন মাড়িয়ে গেছে
কিছু স্বপ্ন একটা প্রজাপতি পেলো না সারাজীবন
শুকিয়ে গেছে
তবু বেঁচে আছি, কারণ-
আজও কিছু স্বপ্ন কুঁড়ি হয়ে আছে
সম্পর্ক
কিছু সম্পর্ক এত আলগা
আগে থেকে যায় না বোঝা -
একটা হালকা ঝাঁকুনিতেই
এক্কেবারে ফালা ফালা!
কিছু সম্পর্ক এমনই ফাঁস
গলার কাছে এখনো লাল
ছেড়ে গেছে ফাঁস, তবু -
বুকের মধ্যে জ্বালা জ্বালা
কিছু সম্পর্ক এত পিছল
ধরতে শিখতে জম্ম কাবার
এই বুঝি সে কাছের ছিল
বাঁক ঘুরতেই, পালা পালা!
আকাশকে খোঁজ
কি আশ্বাসে তাকাবো তোমার মুখে?
বিকালের পড়ন্ত রোদ বটগাছটার মাথায়
শুকনো কিছু পাতা ডাল ছড়ানো মাটিতে
এতো বিষন্ন কেন তোমার মুখ?
সারাদিনের সাজানো প্রদীপ ভেঙেছে?
আলগোছে রেখেছিলে হয়তো বা
কিম্বা হয়তো ওদের ভাঙারই ছিল আজ।
উঠে এসো
সামনের পুকুরটার পাড়ে গিয়ে বসো
দেখো একটু পরেই জ্বলবে সন্ধ্যাতারা
সে তোমারও সন্ধ্যাতারা, আমারও।
বিশ্ব দিবস
বিষুবরেখার মধ্যভাগে দাঁড়াতে পারি
চীৎকার করতে পারি গলা চিরে
হয়তো পৃথিবীর দুই প্রান্তদেশে
কিছু বরফের পাহাড়ে ধরতে পারে চিড়
কটা পেঙ্গুইন, শীল চমকে তাকাতেও পারে এদিকে
দিবাস্বপ্ন
একবার উঠে কড়াটা নেড়েই দেখো না
হয়তো দরজাটা খুলবে
না হয় খুললোই না।
তবু জানবে, কড়া তো নেড়েছিলাম
নাকি বসে বসে ভেবেই যাবে-
'আহা রে, যদি দরজাটা খুলত!'
একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতা
একাকীত্বের সাথে নিঃসঙ্গতা রোজই সকালে বেরোয় বেড়াতে।
একাকীত্ব নিয়ে আসে মুঠো ভরা ফুল, চোখ ভরা বিস্ময় আর বুক ভরা গান।
নিঃসঙ্গতা নিয়ে আসে মুঠো ভরা ধুলো, চোখ ভরা ঈর্ষা আর বুক ভরা দীর্ঘশ্বাস।
আমি বলি কেন এই রকমই হবে?
এতটুকুই থাক
তুমি পারতে আরো আরো বেশি যন্ত্রণা দিতে, জানি
যদি পারতাম তোমায় আরো আরো ভালোবাসতে, মানি
তবু এতটুকুই থাক
বাকিটুকু রাখি বাকি
সব পলাশ কি এক বসন্তেই হবে লাল
কিছু পলাশ দিক না, এই বসন্তে ফাঁকি!
দান
যা নিয়ে গেলে, যাও
ফেরৎ চাইব না।
চেয়েছিলে দু'হাত পেতে
শূন্য হাতে ফেরাতাম কি করে?
তুমি জানতে, আমি তা পারব না
যাওয়ার সময় পিছনে ফিরে তাকালে না একবারও।
আমি তাকিয়েছিলাম,
যদি কিছু ফেলে যাও
কুড়িয়ে ফিরিয়ে দেব বলে
আমি যা দিই, একেবারেই দিই।
তুমি হতভাগ্য,
যদি তিলমাত্র বুঝতে সে ব্যাথার সুখ
আর হাত পাততে হত না
আঁচড়
আয়নার কাঁচে ধুলো পড়েছিল
পরিস্কার করতে গিয়ে
কাঁচে পড়ল আঁচড়
এখন মুখ দেখতে গেলে আঁচড়ের দাগটাও দেখি
দেখতেই হয়
বুকের ভিতর প্রতিবারই চিনচিন করে ওঠে
বুঝতে পারি না কেন
ধূলোর জন্য না আঁচড়ের জন্য
বিলাসী
১
---
কিছুটা হলেও টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়েই যাচ্ছিল বিলাসী। বয়স চল্লিশের আশেপাশে। বাড়ি মুকুন্দপুর। হরিনাভীতে স্বামীর ভিটে। মেয়েটাও তার সাথে কাজে বেরোতো। গীতা। উনিশে পড়েছিল এই মাঘের শেষে। বিলাসী চারটে বাড়ির ঠিকে ঝি-র কাজ করত। তার স্বামী মদন ভাগের চাষ করত। ছেলেটার বিয়ে দিয়েছে গত শ্রাবণে। নেতাই আর তার বৌ কামিনী। নেতাই চব্বিশে পড়েছে। আর কামিনীর বয়স ওই গীতার মতই হবে।
তীক্ষ্ণ উপস্থিতি
রোজ রোজ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে যেত
আজ ডাকলাম, বললাম কি চাও?
সে তাকিয়ে থাকল শুধু
অনেকদিন গেল
রোজ দেখি তাকে পুকুর পাড়ের রাস্তার পাশে
আমারই জানলার দিকে তাকিয়ে
কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি চাও?
আরো অনেক বছর গেল
রোজ তাকে দেখি আমার সান্ধ্যভ্রমণের পথে দাঁড়িয়ে
আমারই দিকে চেয়ে
কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি চাও?
বাঁকাচোরা
(লেখাটির সাথে আমার পরিচিত জীবিত/ মৃত/অনাগত কোনো মানুষের মিল নেই।)
জোঁক না, কেঁচো হই এসো
আমার সহযাত্রীদের কথা বলি। আমার পাশেই আছেন একজন আসামের প্রত্যন্ত গ্রামের মাঝবয়সী একজন ব্যক্তি। নীল টি-শার্ট আর খয়েরী রঙের প্যান্ট পরা। কাল দশটার থেকে মুখের অভিব্যক্তির খুব একটা পরিবর্তন দেখিনি। বসার ভঙ্গীও প্রায় একই রকম। পূর্ণ নির্বাক।
নীল নীরবিন্দু
দীঘির ধারে ডাকলে, মৃদু হাসির ইশারায়
বললে, নামো
আমি বললাম ভয়ে, সাঁতার জানি না যে!
বললে, তবু নামো
নামলাম
যত নামলাম শরীর হতে লাগল হাল্কা
মাঝ দীঘিতে দাঁড়িয়ে তুমি
চোখে তোমার দৃঢ় প্রত্যয়ের জ্যোতি
স্নেহের কিরণে মাখা
বললে, চিৎ হয়ে ভাসো
দু'হাত মেলো ডানে বাঁয়ে
মেললাম
এখন নীলাকাশে চোখ
সারা শরীর দীঘির জলে মগ্ন
অ্যালপ্রাজোলাম
দাঁড়ান। ও কি! অত জোরে জোরে পা ফেলছেন কেন? এত জোরে জোরে কেউ শ্বাস নেয়? আরে অত তড়বড় করে কি বলে ফেলছেন কিছু খেয়াল আছে?
বুঝেছি আপনার অসুবিধাটা কোথায়। সকাল থেকে একটাও অ্যালপ্রাজোলাম পড়েনি বুঝি?
ভারত আর ইন্ডিয়া
ব্যাঙ্গালোর থেকে ফেরার পথে এখন। স্লিপার ক্লাস। ছোটবেলায় বাবার রেলের চাকরীর কারণে যেখানেই বেড়াতে যেতে হত, AC 2/3 তে যেতে হত। খুব রাগ লাগত। কারণ একটাই, রাত্রে জানলা দিয়ে কিছু দেখা যেত না। মনে আছে, আমি বেড়াতে যাওয়ার টিকিট কাটা হলেই দেখতাম সেদিনটা পূর্ণিমা কিনা। আরে তবু কিছু তো দেখা যাবে!
সময় সমুদ্র
মন একলা দাঁড়িয়ে সময়-সমুদ্রের সামনে
অনেক কিছু হারিয়েছে এ সমুদ্রে সে
ঢেউয়ের পরে ঢেউ আছড়ে ভেঙেছে তার ঘর
কেড়েছে তার সুখ
বুকের পাঁজরগুলোতে করেছে বড় বড় ফাঁক
কিছু কথা
আমার সব কথা অক্ষরের মত না, শব্দের মত না।
কিছু কথা কৃষ্ণচূড়া ফুলের মত
কিছু কথা বর্ষার পাতাঝরা জলের মত
কিছু কথা ফসল তোলা ক্ষেতের মত
কিছু কথা মাটিতে ঝরা, তবু না যেতে চাওয়া ফুলের মত
কিছু কথা টিন কাটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদের মত
কিছু কথা শেষ ট্রেন চলে যাওয়া প্ল্যাটফর্মের মত
এরকম আরো অনেক অনেক কথা
যার শব্দ অভিধানে নেই, বলব কি করে?
আশা
আমার প্রদীপটা নিভেছে খানিক আগে
শেষ ধোঁয়াটাও মেলালো বাতাসে, এই তো,
পোড়া পলতেটা লেগে আছে এখনও
একটা আলতো ছোঁয়ায় ঝরে যাবে যদিও
ও নিজেও জানে
তবু হাত দিয়ে দেখো
পয়লা বৈশাখ
এই প্রথম পয়লা বৈশাখ কাটালাম বাংলার বাইরে। বাংলা গান ছাড়া। আমি এখনো জানি না এটা বাংলার কোন সাল পড়ল। কাজের জগতে যেহেতু তার দরকার নেই, তাই দিনের খাতাতেও তার হিসাব নেই। থাক, নাই বা জানলাম।
আমার জীবনে বাংলা দেওয়াল পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার তিনটে দিনেই ইংরাজী ক্যালেন্ডারকে সরিয়ে দাঁড়ায়। পয়লা বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণ।
বিন্দু
ঝরণা
জীবনটা খাদের ধারে আসলেও থামতে বলি না
দে ঝাঁপ! দিক ঝাঁপ!
নদী খাদের ধারে এসে থমকায় না
বলে না, ওরে বাবা, যদি মরি!
দেয় ঝাঁপ
সে ঝরণা হয়ে ঝরে
নতুন খাতে, নতুন স্রোতে ছোটে
(শুভ নববর্ষ। প্রবীণদের প্রণাম জানাই। নবীনদের শুভেচ্ছা জানাই। বয়স্যদের দিই আলিঙ্গন। সবাই ভাল থাকুন, শান্তিতে থাকুন, আনন্দে থাকুন এই প্রার্থনা।)
হলুদ পাতা
হলুদ পাতায় ভরেছে আমার উঠান
আমি সকাল বিকাল ঝাঁট দিয়ে দিয়ে ক্লান্ত।
বস্তা বস্তা পাতা ফেলে এসেছি নদীর ধারে, একা, গোপনে।
দুদিন পরেই জমেছে পাতা, হলুদ ঝরা পাতা এদিক ওদিক সারাটা বাগান ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
ঝরা পালকের রোঁয়া উড়ে এসেছে পাতার সাথে, কোন পাখির জানি না।
মৃত পাখির শাবক মুখে করে পাঁচিল ডিঙ্গিয়েছে বেড়াল
ঝরা পাতায় লেগে রক্ত, আবার ফেলেছি সরিয়ে।
বেগতিক
যদি ভালবাসতে
পুড়তে পারতাম
যদি গালাগাল করতে
রাগতে পারতাম
তুমি তো দেখেও দেখলে না
না ঝাড়া ঝুলের মত ঝুলে রইলাম
পৃথিবী
প্রতিটা মানুষ তার একটা নিজের পৃথিবী নিয়ে ফেরে। তাতে তার নিজস্ব নদী, পাহাড়, বন, সমুদ্র সব আছে। তার হাতে লাগানো বাগান আছে, তার হাতে তৈরী ঘর আছে। সে পৃথিবীতেও তার বাইরের পৃথিবীর মতই ঋতু পরিবর্তন হয়। গ্রীষ্মের তাপ যেমন লাগে, বসন্তে ফুলও তেমন ফোটে। বর্ষা যেমন প্লাবন আনে, শীত তেমন কুয়াশাতেও ঢাকে।
মেঘ-মল্লার
ঝড়
ভেবেছিলাম তুমি আসলে
আমি হব নিশ্চিন্ত
তখনো কি জানতাম
তুমি ঝড়কে নিয়ে ফেরো?
তোমায় ঘরে আনতে গিয়ে
ঘুড়িটা
আকাশ থেকে ছিঁড়ে পড়া ঘুড়িটা
বিদ্যুতের তারে আটকে পরশু থেকে ঝুলছে।
এক একটা দমকা বাতাসে মনে হচ্ছে-
এই বুঝি উড়ে যাবে, একটা গতি হবে।
হল না।
শেষমেশ বৃষ্টির জলে নেতিয়ে
মাথা বুক হেঁট করে, কাঠিগুলো বার করে ঝুলছে।
যারা পরশু থেকে আশা করেছিল, পাড়বে
তারা ওর কথা ভুলে গিয়ে, নীচে দৌড়াচ্ছে।
আমি ভাবছি, কোথায় আটকালো ঘুড়িটার-
নামতে, না উড়তে?
একমুখী
এই মুহুর্ত্তে আমি হাওড়া-যশোবন্তপুর দুরন্ত এক্সপ্রেসে আছি। সারা ট্রেন থিকথিক করছে বাঙালী। যেন বাঙলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাচ্ছে ট্রেনটা। কিন্তু তা তো নয়। এক রাজ্য ছেড়ে ভিন রাজ্যে এতগুলো মানুষ প্রতিদিন ছুটছে - কাজের জন্য, উচ্চশিক্ষার জন্য। দোকানের কাজ থেকে শুরু করে আইটি-র বড় বড় কম্প্যানীতে কাজ করেন এঁনারা, অনেকের সাথে কথা বলে জানলাম।
নদী
আমার শরীরে-বুকে স্মৃতির নদী
শাখা-প্রশাখায় প্রাণের শিকড় ছুঁয়ে গেছে
কোন শাখাতে কখন লাগে ঢেউ
সে খবর কি তার নিজের কাছেই আছে?
আমি যদি এ বলি,
এসব কথা ভুলেই আমি ছিলাম
সে বলে হেসে
ভোলো নি তুমি, সে কথা জানিয়ে গেলাম।
খেলা
খেলতে খেলতে বুঝিনি
কখন খেলার সাথীর বেলা এসেছিল ফুরিয়ে
তাকে বললাম খেলা শেষে কি খেলা ভাঙতেই হয়?
সে বলল, হ্যাঁ
বললাম, বেশ ভাঙলাম না হয় খেলা,
যদি সত্যি সত্যিই চাই?
সে বলল, এ আবার কি নতুন খেলা করলে শুরু!
সঙ্কল্প
চিন্তার আগাছা কিছু ছাঁটতে হবে
অনেকদিন ধরেই ভাবছি
কয়েকটা মুখভার করা শব্দ অভিধানে রাখব না আর
কয়েকটা মই নামিয়ে রাখব এবার
উঠব উঠব করে বসে আছি আকাশের দিকে চেয়ে
পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে গেছে, হাঁটব এবার, ওঠার কথা ভুলে।
কিছু নদীর মুখ ঘুরিয়ে ক্ষেতের দিকে আনতে হবে
আগুন ফাঁদে মারতে হবে কিছু পোকা
চর্বিত চর্বনের পিক ফেলে ফেলে দেওয়ালটা নোংরা করেছে যারা
ফিরব
কি ভাবে কখন বেলা হল বুঝলাম না,
হঠাৎ দেখলাম সূর্যাস্তের রঙ
আমগাছটার মাথায়
পাখিগুলো ফিরছে দল বেঁধে, ঘরে।
আমিও ফিরব, আজ না হয় কাল
এরকম করেই হঠাৎ কোনো একদিন
যখন সূর্যাস্তের আলো সবুজ ক্ষেতকে
দেবে শেষ চুম্বন, পরম আদরে।
টিফিন বক্স
যখন স্কুলে পড়তাম, টিফিন বক্সের একটা রহস্য ছিল। মা কি টিফিন দিয়েছেন আজ? ম্যাগী না পরোটা? চাউ না রুটি? না সুজি? না অন্য কিছু!
আজও টিফিন বক্সের ঢাকনা খুলছি প্রতিদিনের মোড়কে। রোজই ভাবি, আজ কি এনেছে আমার জন্য? ঠোঁটের কোণে হাসি, না চোখ জ্বালা ধরা ব্যাথা? নাকি পাঁচ মিশালি তরকারী?
যাই আনুক, নিতে হবে হাসি মুখেই, পরের দিনের দিকে তাকিয়ে।
এমনটাও ঘটে
সংসারে প্রকৃত সুখী সেই, যে সুখে থাকার চেষ্টাই করে না। ভাবেই না কতটা জমল, কতটা গেল।
যেদিন আমি ক্ষেপব
যেদিন আমি ক্ষেপব-
সেদিন টগরকে বলব, লাল গোলাপ
তোমায় তাই মানতে হবে
মানতেই হবে
বাড়ির উঠানের জবা গাছকে বলব-
"হে পারিজাত বৃক্ষ, দাও একটি পারিজাত পুষ্প
আমার হস্তে, গাঁথিব তাহার খোঁপাতে!"
তুমি জবা গাঁথবে খোঁপাতে
তুমি ভিতরে এসো
বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?
ভিতরে এসো
পায়ে ধুলো?
তার চেয়ে অনেক বেশি ধুলো
আমার ঘরে বন্ধু
ময়লা জামা?
সে ময়লা সহ্য হবে
জামার নীচে যে হৃৎযন্ত্রটা?
আমার সে যন্ত্রটা বিকল হয়েছে অনেকদিন,
তোমায় বাইরে রেখে।
আমিও
দিদার মুখে ছোটবেলায় অনেক গল্প শুনতাম। তার মধ্যে একটা গল্প আজও সময়ে অসময়ে খুব মনে পড়ে। গল্পটা বলছি। দিদা কোথায় পড়েছিলেন জানি না। হয়তো অনেকের জানা। তবু যাঁদের অজানা তাঁদের জন্যই বলছিঃ
দূরে
তোমার দিকে কম তাকাই
কারণ, তোমার হৃদয় ফোঁড়া চোখ।
তোমার সাথে কম কথা বলি
কারণ, তোমার কথা বলার ফাঁকে
শুদ্ধ নীরবতা।
তোমার কাছে যাই না
কারণ আমার নিঃসঙ্গ হৃদয়।
তবু
ভয়ের জিনিসকে যত সহজে বিশ্বাস হয়, অভয়কে তত সহজে বিশ্বাস হয় কই? তুলসীদাসজী বলছেন, অমৃত সারা জীবন কানেই শুনে এলাম, চোখে পড়ল শুধু বিষ।
এ অভিজ্ঞতা কার জীবনে না নেই। তবু নিজের সামনে যখন দাঁড়াই, প্রশ্ন করি তোমার এ সংসারে চলার পুঁজি কি? মন বলে, কিছু ভাল কাজ করার ইচ্ছা। হ্যাঁ, এইটাই আজ থেকে কাল, কাল থেকে পরশু হাত ধরে নিয়ে চলেছে।
সম্পদ
সব সম্পদ সিন্দুকে, লকারে, আলমারীতে রাখা যায় না। কিছু সম্পদ বুকের মধ্যেও সযত্নে রাখতে হয়। বন্ধুত্ব, বিশ্বাস, ভালোবাসা - এ সম্পদ চুরি হয় না, যদি না আমি হারিয়ে ফেলি।
সব ফসল ক্ষেতেই জন্মায় না। কিছু জীবনেও জন্মায়। উপলব্ধির ফসল ছাড়া জীবন রিক্ত। সাধক রামপ্রসাদের সেই বিখ্যাত গান আছে না- 'এমন মানব জমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা'।
দূরত্ব বাড়বে স্মৃতিতেও
জানো
যে পেনটায় তোমায় চিঠি লিখতাম
সেটা পাশের বাড়ির হাবলু নিয়ে গেছে
কাল থেকে ওর মাধ্যমিক
যে ডায়েরীটার পাতা ছিঁড়ে চিঠি লিখতাম
সেটা লুকিয়ে রেখেছিলাম
কাল দেখলাম উইয়ে কেটেছে এমন
একটা পাতাও আস্ত নেই আর!
যে গোলাপ ঝাড়ের গোলাপ তোমায় দিতাম
সেটা নেই আর
ওখানে ড্রেন বানাবার জন্য মাটি কেটে রেখেছে
মিউনিসিপ্যালিটির লোকেরা
মহাকাশ কারোর অপেক্ষা করে না
কেন আমার জন্য বসে থাকবে?
ইচ্ছা হলে ডানদিক, বাঁদিক
যেদিক খুশী যেতে পারো
সমুদ্র, পাহাড়, জঙ্গল, মরুভূমি
যেখানে খুশী যাও
কিম্ আশ্চর্যম!
পার্কে এক যুবক এক যুবতীর ঠোঁটে চুমু খেল।
তার কিছু দুরে নর্দমা থেকে এক মৃতপ্রায় মানুষকে কোলে তুলে নিলেন এক বিদেশী সন্ন্যাসীনী।
অভিধান বলল, প্রেম।
ক্লাসে এক ছাত্রের গায়ে আরেক ছাত্র দিল পেন ফুটিয়ে।
আর ওদিকে এক পারমাণবিক বোমে এক নিমেষে লক্ষ মানুষ পড়ল কালের গ্রাসে।
অভিধান বলল, হিংসা।
ধন্য অভিধান, আর তার শিষ্যেরা।
প্রতিশ্রুতি
কিছুক্ষণ আগে যেন আমি তোমারই কথা ভাবছিলাম
পরিচিত বিকালগুলো শুকনো বারান্দা বেয়ে গুটি গুটি করে
খালি পায়ে হেঁটে গেছে খানিক আগে
আমার অন্যমনস্কতায় উঁকি দিয়ে, ভিজে হাতের ছাপ রেখে।
সারা দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদের তাপে পোড়া বুনো ঝোপের গন্ধ
পড়ন্ত রোদের আলোয়, গরম বাতাসে স্মৃতির ঝাঁপিতে রাখছে হাত।
সামনের পাতাহীন শুকনো বাঁশগাছটার মাথায় দোয়েলটা আজও বসেছে
আদিম ব্যথা
তুমি চলে যাওয়ার পর
সন্ধ্যাতারা উঠল
তখনও অন্ধকার হয়ে আসেনি গাঢ় হয়ে
গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে সদ্য জমছে অন্ধকার
ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক বাড়ছে ধীরে ধীরে
হালকা বাতাস সারা ছাদ আমার সাথে সাথে ফিরছে
একফালি চাঁদ যুগান্তরের বিরহ নিয়ে একা।
থাক
মাঝে মাঝে সব গুলিয়ে যাওয়া ভাল। আবার করে গোছাতে গিয়ে, কিছু জিনিসকে আবার নতুন করে চেনা যায়। যাকে মনের নীচের তাকে রেখেছিলাম তুচ্ছ করে, তাকেই হঠাৎ করে ড্রয়ারে তালা দিয়ে সুরক্ষিত রাখতে ইচ্ছা করে। মনে হয়, এতো মূল্যবান জিনিসটা চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল কি করে!
ধর্ম ও ধর্মান্ধতা
(আজ ধর্মান্ধতার বর্বরতা যখন আবার তার কালো ফণা তোলার উপক্রম করছে, তখন একটু ভয় ভয় করছে বৈকি। তবে কি আমরা...)
ধর্মের দুটো দিক আছে। এক অধ্যাত্মিকতা, দুই সমাজের রজ্জু হিসাবে।