Skip to main content

আমার সহযাত্রীদের কথা বলি। আমার পাশেই আছেন একজন আসামের প্রত্যন্ত গ্রামের মাঝবয়সী একজন ব্যক্তি। নীল টি-শার্ট আর খয়েরী রঙের প্যান্ট পরা। কাল দশটার থেকে মুখের অভিব্যক্তির খুব একটা পরিবর্তন দেখিনি। বসার ভঙ্গীও প্রায় একই রকম। পূর্ণ নির্বাক। 

আমার স্বভাব যাবে কোথায়? খুঁচিয়ে জানলাম, চাকরীর খোঁজে একটা পরীক্ষা দিতে এসেছিলেন ব্যাঙ্গালোরে। সমস্যা হল না পারেন হিন্দী বলতে না পারেন ইংরাজী। তাই মৌন অবলম্বন করেছেন। কিন্তু মানুষটার হাসিটা বেশ। বাচ্চাদের মত সরল। চোখদুটোতে কি বিস্ময় চারিদিকে তাকিয়ে। তবু মাঝে মাঝে একটা অব্যক্ত ব্যাথা, যন্ত্রণা ওর উদাস চোখে। কিসের সেটা? দারিদ্রতা? বেকারিত্ব? জানি না। জানতে চাইও না। বোঝাবে কি করে? তবে একটা কেক বা বিস্কুট যখন বাড়িয়ে দিচ্ছি, স্মিত হেসে, একটু সংকোচে নিয়ে নিচ্ছেন। এখনো কপট ভদ্রতাটা শিখে পারেন নি তো!

আমার দু'পাশের দুদিকের কুপে, একনিষ্ঠ মুসলমান আর একনিষ্ঠ শৈব পরিবার। ভোর হতেই একজন মোবাইলে 'ওঁ নমঃ শিবায়' চালিয়ে হাউ মাউ করে গেয়ে উঠলেন। সুরদেবীর সাধক যে নন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আর অপর জন তাঁদের সুরে স্রষ্টার উদ্দেশ্যে কিছু গাইলেন বোধায়। এর মধ্যে খানেই আমার কূপের অল্প বয়সী ব্যাঙ্গালোর চাকুরে সহযাত্রী তাঁর মোবাইলে 'মেরে নয়না সাওন ভাদো' চালালেন। আহা শিবে, আল্লায় আর কিশোরকুমারে কি অনবদ্য কনসার্ট, না শুনলে লিখে বোঝানো দায়!

আর এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে নব্য বাঙালী যুবকেরা। ব্যাঙ্গালোর, চেন্নাই এ চাকুরীরত। তাঁরা ইয়াব্বড় বড় স্মার্টফোন নিয়ে উঠেছেন। গান শুনছেন, সিনেমা দেখছেন। চার্জ শেষ হলে চার্জে বসিয়ে জিরিয়ে নিচ্ছেন। আবার উঠে পড়েই গান শুনছেন, সিনেমা দেখছেন। 

আমি বাংলায় থাকি শুনে সকরূণ দৃষ্টিপাত করলেন কজন। বললেন বাংলায় গাধার মত খাটনি, কম মাইনে। এখানে মাইনে ভাল, গাড়ী বাড়ি করার সুযোগ কত! কত অঙ্কের টাকার হিসাবও দিলেন তাঁরা। মুশকিল হল ছোটবেলা থেকেই আমার আবার অঙ্কে মাথা নেই। তাই তাঁরা এক প্রকার নিরাশ হয়েই আমায় ত্যাগ করলেন।

তবু আমায় প্রবুদ্ধ করার চেষ্টা করলেন। আমার আবার জোঁক হওয়ার চেয়ে কেঁচো হতে বেশি ভাল লাগে তো, মানে জমি চষতে, তাই তাঁরা একপ্রকার ক্ষুব্ধই হলেন আমার আচরণে।

সক্কালের সৌন্দর্য্যে চিল্কা অসাধারণ লাগছে। মুগ্ধ হয়ে দেখছি। যেন গলানো রূপা কেউ নীল জলে ভাসিয়ে রেখেছে। আমার আর এক তরুণ সহযাত্রী ঘুম চোখে উপরের সিট থেকে নেমে পাশে বসে বললেন, চিল্কা না?

আমি না তাকিয়েই বললাম, হ্যাঁ।

উনি বললেন এই চিল্কায় একটা মাছ পাওয়া যায় জানেন! সরষে বাটা দিয়ে উড়িয়ারা যা রাঁধেন না! উফ্। বলতে বলতে তিনি চুকচুক আওয়াজ করে উঠলেন। না এখানেই বিরাম না। উড়িষ্যায় কি কি মাছ কি পদ সহযোগে খাওয়া যায় ব্যখা করে যেতে লাগলেন। অগত্যা চিল্কা দর্শন স্থগিত রেখে বইতে মনোনিবেশ করতে গেলাম।

মজাটা হল আমার হাতে বই দেখে। পাশের একজন তরুণ বললেন, আপনার সেমিনার ছিল নাকি? আমি বললাম, না। উনি বললেন, তা হলে হাতে বই? আমি বললাম, এমনি, পড়তে ভাল লাগে। তিনি এত অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকালেন, যে প্রাইমারী স্কুলে আমার হাতে পর্ণোগ্রাফী দেখলেও আমার পিতা বোধকরই এত চমকাইতেন না! 

সব শেষে মনে হয় স্লোগানের মত বলি, জাগো বাঙালী জাগো। তোমার বাপ ঠাকুর্দা চাকুরীজীবী ছিলেন বলে কি তোমায়ও হতে হবে? নিজে থেকে কিছু একটা করো। হোক না ছোট। তবু শুরু করো। অনেকের মত, ঠোঙা করা, তেলে ভাজাও শিল্প। আমি তা বলছিনা। আমি বলতে চাইছি, তোমার এত প্রযুক্তিবিদ্যায় জ্ঞান, শুধু অন্যের শ্রী বৃদ্ধিতেই লাগবে? আর তুমি তার উদ্বৃত্তে, উচ্ছিষ্টেই সন্তুষ্ট থাকবে? না হে না। আচার্য্য প্রফুল্লদাকে মনে করো। ভাই ওঠো। জোঁক না, কেঁচো হই এসো।