(এটা গল্প, আবার গল্প না। ভারতের প্রাচীনতম দর্শনের যে দিক নির্দেশ, তাকেই আমার বোধের ভিতর দিয়ে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি)
আমার গা ছিল সেদিন নগ্ন। তুমি একটা কাপড় জড়ালে আমার শরীরে, বললে, বাইরে যাও, ঘুরে এসো। বললাম, কি খাব? বললে, খাবে গাছের ফল, মূল। পান করবে নদীর, ঝরণার, পুস্করিণীর জল। বললাম, কি দেখব? বললে, নদী পাহাড় জঙ্গল সমুদ্র বিস্তীর্ণ প্রান্তর মরুভূমি ইত্যাদি অনেক কিছু। আমি বললাম, ব্যস? তুমি বললে, না, এ হল বাইরের দেখা। এরপর দেখবে নিজের শরীর, তারপর মন, তারপর বুদ্ধি তারপর... বললাম, তারপর কি? তুমি বললে, বুঝে যাবে। তবে মনে রেখো, এ খণ্ডদৃশ্যগুলোর মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে হবে, সবের মধ্যে ‘এক’কে খুঁজে পেতে হবে তোমায়। আমি বললাম, না যদি পাই? যদি সব থাকে বিচ্ছিন্ন? তুমি বললে, তবে কোন কিছুকে পাবে ভীষণ অতিরিক্ত করে, কোনো কিছুকে পাবে ভীষণ তুচ্ছ করে। ভারসাম্য থাকবে না। তোমার সাথে ফিরবে ভয়, মহাভয়!
আমি বাইরে আসলাম। কি অভূতপূর্ব দৃশ্যাবলী চতুর্দিকে আমার! আমি যত এগোলাম তত মগ্ন হতে থাকলাম, রূপে রসে রঙে। আমার মনেতে আরেক মন উঠল জেগে। সে ভাষা পেল। তার কথা বলার ধরণ অন্যরকম, তোমার মত না। সে বলল, এসব তোমার! আমি বললাম, মিছে কথা, এসব তাঁর! সে অট্টহাস্য করে উঠল। বলল, কার? আমি ফিরে তাকালাম, পিছনে ঘন অন্ধকার।
আরো এগোলাম। সেই মনটাও আমার সাথে সাথে এগোলো। সে আমার শরীরে আরেকটা শরীর বানিয়ে দিল, তাতে জ্বালালো আগুন। বলল, শরীরের খিদে শুধু বনের ফল মূলেই নিবৃত্তি হয় না, এগিয়ে এসে ছোঁও একে... দেখলাম, আমারই মত শরীর তবু যেন আমি না। আলাদা কোথাও কোথাও। সেও চলল সাথে। কিছুটা এগোতেই শুনতে পেলাম কোলাহল। দূর থেকে দেখলাম, আমার মত, আমার পাশের শরীরের মত অনেক মানুষ হইচইতে মেতে। আমি এগোতে যাব, সেই মন এসে হাত ধরল চেপে, বলল, কোথা যাও? আমি বললাম, ওই যে কিসের মেলা, সেখানে। সে বলল, নিজের দিকে তাকাও। আমি তাকালাম। এবার ওদের দিকে তাকাও। তাকালাম। বলল, কিছু বুঝলে? বললাম, হ্যাঁ, ওদের দেহ নানা রঙীন আবরণে আর নানান জ্যোতির্ময় আভরণে ঢাকা। সে আবার অট্টহাস্যে পড়ল ফেটে। বলল, ঠিক, ঠিক, ঠিক। আমি বললাম, আমারও চাই যে ওসব। সে বলল, নিশ্চয়, বিলক্ষণ। বলে সে শেখাতে লাগল নানা কৌশল।
দিন গেল, মাস গেল, বছর গেল। আমি সেই মেলার বাসিন্দা হলাম। মনে জমল জল। তাতে ধরল শ্যাওলা, পাঁক। তৈরি হল কত জটিল ছোট বড় আবর্ত। আমার চারিদিকে ঘিরল কুয়াশা। রঙীন, চোখ জ্বালা করা, ঘুম পাড়ানো গন্ধবহা কুয়াশা। এখানে চোখ খোলা রাখলেই চোখে ধরে জ্বালা।
সব ঠিক চলে। কিন্তু মাঝে মাঝেই কেটে যায় রেশ। ঘুমের মধ্যে ধড়ফড় করে ওঠে বুক। বিভীষিকাময় স্বপ্নে ভরে রাত। তবু কিসের যেনো ঘোর।
সেদিন বিকালবেলা। আমি নদীর ধারে বসে। মনের মধ্যে যেন আসন্ন কালবৈশাখীর গুমোট। বুকের ওপর ভারী পাথর। দম আটকানো যন্ত্রণা। কোথায় যেন যাওয়ার ছিল, কি যেন করার ছিল। যতই ভাবি মনের মধ্যে পাথর হয় ভারী, গুমোট ওঠে বেড়ে।
হঠাৎ একটা কাগজ উড়ে এলো। শূন্য সাদা পাতা। মাঝখানেতে একটা বিন্দু আঁকা। অন্যদিকে, অনেক সরু রেখা কেন্দ্রে তার সেই বিন্দুটাই আঁকা। হঠাৎ যেন উঠল ভীষণ ঝড়। আগল গেল ভেঙে, কুয়াশা গেল ছিঁড়ে। পায়ে লাগল কত জন্মের টান। ছুটলাম আমি দিক হারানো বেগে। দিক হারিয়ে পেলাম দিকের হদিস। এলাম ফিরে আবার তোমার ছায়ায়। পথে পথেই ছিটকে পড়ল সব আবরণ, সব আভরণের ভার। অনেক খুঁজে পেলাম আবার তোমার দেওয়া বাস।
এখন আমি তোমার ছায়ায় বসে। তোমার দীঘির জলে আমার মুখের ছবি। কত কালি চোখের তলায়। কত সংশয়, কত আবিলতা সারাটা মুখ জুড়ে।
জিজ্ঞাসা করলাম, তবে কি হারিয়ে গেছি আমি?
তুমি বললে, হ্যাঁ।
আমি বললাম, উপায়?
তুমি বললে, আবার ফেরো।
আমি বললাম, আবার?
তুমি বললে, হ্যাঁ।
আমি বললাম, আবার আসবে ঘোর, আবার যাব হারিয়ে পথ ভুলে।
তুমি বললে, আবার আসবে, ঘোর ভাঙার শেষে।
আমি বললাম, কিছুই কি নেই পথ?
তুমি বললে, ‘এক’কে সবার মাঝে খোঁজ, পথের শেষে ফেরার রাস্তা পাবে।
আমি বললাম, চিনব কেমন করে?
তুমি বললে, নিজের মধ্যে নিজেকে এক করে।
(ছবিঃ সুমন দাস)