১
---
বাসে ওঠার পর থেকেই মাথাটা ঝিমঝিম করছিল দিব্যেন্দুর। গা বমি বমি করছে। সকাল থেকে এত দৌড়াদৌড়ি হচ্ছে যে খাওয়ার সময় পায়নি ঠিক মতন। ঘড়িতে দেখল, বেলা সাড়ে দশটা।
জুন মাসের ভ্যাপসা গরম। দিব্যেন্দুর বাড়ি বালিতে। বয়স ৩৭। একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করে। মাসে সব মিলিয়ে দশ হাজার টাকা মতন হাতে পায়। মা, বাবা আছেন। বাবার পেনশান আছে বলে তেমন অসুবিধা হয়না। দিব্যেন্দুর স্ত্রী রাই, মাধ্যমিক অবধি আর্টস গ্রুপটা বাড়িতে টিউশানে পড়ায়।
গত মাসের শুরুর দিকে মায়ের ব্রেস্ট ক্যানসার ধরা পড়ে। তারপর থেকে সব এলোমেলো হতে শুরু করেছে। রাইকে নিয়েও আজ পিজিতে যাওয়ার ছিল, গাইনো দেখাতে। এত বছরেও ওদের কোনো সন্তান নেই। রাই দিব্যেন্দুর চেয়ে দু'বছরের ছোট। একই কলেজে পড়ত।
বাসটা কিছুটা চলার পর এখন কিছুটা ভাল লাগছে। একটা জানলার ধারে সিট পেয়ে গেল। যাদবপুর গিয়েছিল, ছোটকাকার কাছ থেকে কিছু টাকা আনতে। এ মাসের মধ্যে মায়ের অপারেশানটা করাতেই হবে। খুব খিদে পাচ্ছে এবার দিব্যেন্দুর। বাসে ওঠার আগে দু'টাকা দিয়ে চারটে লজেন্স কিনেছিল, তাই একটা মুখে পুরল। চোখটা বন্ধ করে বাসের গায়ে মাথাটা ঠেকিয়ে রাখল।
মাথার মধ্যে হাজার চিন্তার জট। বাবার অসহায় মুখটা ভেসে আসছে। রাই আর সে কিছুটা টাকা জমিয়েছিল, ভেবেছিল এই বছরের শেষে একবার ভেলোরে যাবে। সেটা আর হলনা। সব টাকাটা রাই বাবার হাতে তুলে দিয়েছে। বাবা নিতে চাননি। রাই বাবাকে বলেছিল, বাবা ভাগ্যে থাকলে এমনিই হবে। মাকে বাঁচাতেই হবে।, বাবা উঠে অন্য ঘরে চলে গিয়েছিলেন। কোনোদিনই বাবা কারোর সামনে আবেগপ্রবণ হওয়া পছন্দ করেন না।
দিব্যেন্দু খেয়াল করল, তার চোখের কোণদুটো ভিজে ভিজে লাগছে। হাত দিয়ে মুছে নিল, চোখ না খুলেই। মাথার ভিতরটা একটু হাল্কা লাগছে।
দিব্যেন্দুর খুব ইচ্ছা ছিল ফুটবল খেলবে। হল না। মধ্যবিত্ত পরিবার হলে যা হয়। অনেকদূর এগিয়েও ছিল। কটকে খেলতে গিয়ে পায়ের লিগামেন্ট বিচ্ছিরিভাবে ছিঁড়ে গেল। ভাল জায়গায় চিকিৎসা করালে হয়তো ঠিক হয়ে যেত। কিন্তু তাদের অত টাকা কোথায় তখন?
বাসে একটা বাচ্চা খুব চীৎকার করছে। দিব্যেন্দু চোখ মেলে তাকালো। উল্টোদিকের সারিতে বাচ্চাটা মায়ের কোলে দাঁড়িয়ে পড়ে চীৎকার করে কাঁদছে। প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেছে বোধহয়। ভদ্রমহিলা ওকে ন্যাপকিন জাতীয় কিছু পরাচ্ছেন। রাইয়ের মুখটা মনে পড়ল হঠাৎ। আবার চোখ বুজল।
তারা দুজনেই একটা মেয়ে চেয়েছিল। রাই নামও ঠিক করেছিল, কমলিকা। একটা ঝাঁকুনি লেগে দিব্যেন্দু চোখ খুলল। রাস্তাগুলোর যা অবস্থা। খুব মেঘ করেছে দেখল। কালো হয়ে এসেছে আকাশের একদিক। বর্ষা এসে গেল? পেপারে বলছিল অবশ্য আজকালের মধ্যে বর্ষা ঢুকে পড়ার কথা।
দিব্যেন্দুর এক এক সময় খুব অপরাধী লাগে নিজেকে। রাইয়ের জন্য। রাইদের অবস্থা খুবই ভাল। ওর দুই দাদাই সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টে কাজ করে। ওর বাবা রিট্যায়ার্ড আর্মি চিফ। কেন যে ওদের দেখা হয়েছিল? রাইকে বলেছিল, তোমার আফসোস হয় না?
- তোমার হয়?
- বাজে বোকো না। বলো না, কখনো আফসোস হয়না?
- হয় তো, ইস্... আমার মানুষটাকে যদি আরেকটু বুদ্ধি দিতেন ভগবান!
- ঠাট্টা না রাই, বলো না প্লিজ, আমি আর কোনোদিন জিজ্ঞাসা করব না।
- হত। যদি তুমি, তুমি না হতে।
তারপর রাই অনেকক্ষণ তার বুকে মুখ গুঁজে শুয়েছিল। বোধহয় কাঁদছিল। দিব্যেন্দু ওকে বুকে জড়িয়ে দেওয়ালে আটকানো ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মনে হচ্ছিল, ঘড়ি, ক্যালেন্ডার সব মিথ্যা। তারও কান্না পাচ্ছিল।
-"টিকিট", দিব্যেন্দু মানিব্যাগটা বার করে বলল, আমায় পোস্তা আসলে ডেকে দেবেন প্লিজ।
২
---
মেঘটা আরো ঘন হয়েছে। গুমোটটাও বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে। এখন আর খিদেটা পাচ্ছেনা। চা খেতে ইচ্ছা করছে। ট্রেনে গেলেই হত। অবশ্য পোস্তাতে একবার তাকে নামতে হবে, অফিসে বড়বাবুকে একটা পেনড্রাইভ দিতেই হবে আজ।
মাকে জ্ঞানত কোনোদিন কিছুর জন্যই অভিযোগ করতে শোনেনি দিব্যেন্দু। সবসময় একটা প্রসন্নতা ঘিরে থাকত মায়ের মুখে। রোগটা যেদিন ধরা পড়ে, দিব্যেন্দু ঠিক করেছিল মাকে জানাবে না। তা কি হয়? ঠাকুরপুকুরে ক্যান্সার হাসপাতালে যাওয়ার কথা শুনেই তিনি বুঝে গিয়েছিলেন। আর ডাক্তারও বলেছিলেন জানিয়ে দিতে। রোগটা অনেকদূর ছড়িয়ে গেছে।
মাকে এখন দেখে অন্যরকম মানুষ মনে হয়। একদিন দুপুরে বললেন, লক্ষী আর আমাদের সংসারে রইল না বাবু। দেখ কোথায় তোরা এখন একটু হাত-পা ছড়িয়ে সংসার করবি, না আমি কি এক রোগ বাধিয়ে বসলাম। তোর বাবাকে দেখলে বড় কষ্ট হয়। সারাটা জীবন লোকটা জোয়াল টেনেই গেল। একদন্ড শান্তি পেল না রে! তাও মেনে নিয়েছিলাম। এখন তোদের একটা কিছু দেখে যেতে পারব কি না ভগবানই জানেন।
রাই মাকে খুব বকেছিল, এমন কিছু হয়নি তোমার, যে এসব কথা বলতে হবে। এই তো অপারেশানের পর তুমি পুরো সুস্থ হয়ে যাবে, আমি আর তোমার ছেলে ডিসেম্বর নাগাদ ভেলোর ঘুরে আসব। বুঝলে?
দিব্যেন্দুর মা একটু হেসে বলেছিলেন, আমি কি কচি খুকী রে রাই, যে যা খুশী বুঝিয়ে দিবি?
বাসটা অনেক ফাঁকা হয়ে এসেছে। দিব্যেন্দুর শরীরটা হাল্কা লাগছে অনেক। চা তেষ্টাটাও নেই আর। বাচ্চাটাও নেমে গেছে।
তার আর কিছু ভাবতে ইচ্ছা করছে না। বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল। অন্ধকার করে এসেছে মেঘে। কে বলবে বেলা এগারোটা এখন! ঠান্ডা হাওয়া দিতে শুরু করেছে। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা শুকনো তৃষ্ণার্ত রাস্তায় পড়েই শুকিয়ে যাচ্ছে। দিব্যেন্দুর মনটা হঠাৎ কেমন ভালো হয়ে গেল। যেন কিচ্ছু কোথাও হয়নি। সব ঠিক আছে। আরে সমস্যা না থাকলে জীবন কিসের! হঠাৎ করে তার সবাইকে খুব কাছের মনে হল। সবাই যেন তার আত্মীয়। সবার হাজার সমস্যা। অনেক সমস্যা। সবাই লড়ছে, সেও লড়ছে। দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। কন্ডাক্টারের দিকে তাকিয়ে হাসল। অকারণেই। কন্ডাকটরও হাসল, অকারণেই। একজন মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখলে যেমন হাসে মানুষ।
কেন সে এতদিন হাসেনি এই মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে? সে কন্ডাক্টারের সাথে কথা বলতে বলতে জেনেছিল, তাদের দু'বছরের বাচ্চা মেয়েটার ব্লাড ক্যান্সার।
দিব্যেন্দু বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাঁটছে। তার খুব কান্না পাচ্ছে। মাথা নীচু করে হাঁটছে। সে কাঁদছে। নিজের জন্য না। সবার জন্য। শুধু দুঃখে না, কি এক অজানা আনন্দেও। যেন জীবনকে সে এতদিনে মাঠে পেয়েছে প্রতিপক্ষ হিসাবে। আজ সে দেখিয়ে দেবে, সে কি জাতের খেলোয়াড়। সবার হয়ে খেলবে সে। দেখি কি হয়!
(ছবিঃ সুমন দাস)