Skip to main content

ভবিতব্য

আগুন আলো দেবে বলে জ্বলে না। তার না জ্বলে উপায় নেই বলেই জ্বলে। সে জ্বলনে যদি আমি তাপ পেয়ে থাকি, আলো পেয়ে থাকি, সে নেহাতই একটা বাড়তি ঘটনা মাত্র। মূল ঘটনা না। মূল ঘটনাটা ওই জ্বলন। আগুন নিভলে তাই যতই অভিমান করি না কেন, আগুনের কাছে তা মূল্যহীন। সে জানেই না তার জ্বলে থাকার মূল্য আমার কাছে অন্যরকম ছিল। আমার ব্যবহারের ছিল সে। 

ছায়া আর স্ট্রিট লাইট

নুন-চিনি-জল খেয়ে চেয়ারে বসেই বুঝলেন, আবার যাওয়া লাগবে। 

     গেলেন। এলেন। ক্লান্ত। ডাক্তার বলেছে, এরকম হবে। কোভিডের নতুন লক্ষণ। আগে পেটে এরকম হলে একটা অনুশোচনা থাকত, আহা, ওটা বেশি খাওয়া হল, কি সেটা খাওয়া উচিত হয়নি। কিন্তু এতো আশ্চর্য কাণ্ড! কোথা থেকে কি হল! 

উভমুখী

কারাগার কি শুধু শিকলের হয়? মন নিজে যখন নিজেই নিজের কারাগার হয়ে ওঠে? কিছুতেই নিজেকে ঠেলে নিজের বাইরে যাওয়া যায় না? তখন? সেও এক দুঃসহ কারাগার।

কান্না ধন

গোঁসাই বলল, দেখ, মহাপ্রভু পেয়েছিলেন ডেকে, রামকৃষ্ণদেব পেয়েছেন কেঁদে। উনি তাই বলতেন না, কাঁদতে পারো? লোকে মাগ ছেলের জন্যে ঘটি ঘটি কাঁদছে। ঈশ্বরের জন্য, ভগবানের জন্য আর কে কাঁদছে বলো? 

     গোঁসাই বলে চলল, ঠাকুরকে যে ঠিক ঠিক ডেকেছে, ঠাকুর তাকে কাঁদিয়েছেন। 

     চমকে উঠে বললাম, একি বলো গোঁসাই… এ তো ভয়ের কথা….
...

রথ

স্থির রোদ। গাছের ছায়া লুটোপুটি খাচ্ছে মাটিতে। রোদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা। মাটি কোল পেতে বসে। 

     মাটি জানে খানিকবাদে রোদ থাকবে না, ছায়া থাকবে না। গাছটাও একদিন থাকবে না। সে থেকে যাবে। 

     গোঁসাই বসে গাছের তলায়। চাঁদের আলোয় ছায়ারা খেলছে। গোঁসাই এ ছায়া রোদের আলোতেও দেখেছে। চাঁদের আলোয় মায়া বেশি। সত্যে আর কল্পনায় মেশানো যে! রোদের আলো বড্ড স্পষ্ট। জ্ঞানের অহংকারের মত। জ্ঞানের চেয়ে জ্ঞানী বাজে বেশি। চাঁদের আলো অনুভবীর। সে অনুভবী জ্ঞানী রসের খবর জানে না শুধু, সে জ্ঞানী রসিকও। রসের সমঝদার!
...

স্বেদ

১২৫টা সিঁড়ি ভেঙে ওঠার পর, মন্দিরে শিবের মাথায় জল দেওয়ার পর, যখন ভক্তি, শান্তি না এসে শুধু তেষ্টা আর খিদে চাগাড় দিল, সন্ধ্যা বুঝল, এই চুয়াত্তরটা বছর ভগবান তাকে শুধু ঠকিয়েইছে। সে-ও ঠকিয়েছে বিস্তর। ভগবান আর তার মধ্যে সারা জীবন শুধু লুকোচুরি খেলাই হয়েছে। স্বামীকে ঠকিয়েছে, ছেলে-মেয়েদের ঠকিয়েছে, আত্মীয়-স্বজনকে ঠকিয়েছে। আর নিজেকে তো ঠকিয়েছেই। তারাও ঠকিয়েছে তাকে। 
    বিয়ের আগে আর পরে নিজেকে যখন দেখে, নিজেকে মনে হয় হরিদ্বারের গঙ্গা, আর কলকাতার গঙ্গা। না, শুচিতা-অশুচিতার ধার ধারেনি সন্ধ্যা কোনোদিন। তার শরীরে প্রথম খাবলা বসিয়েছিল তার ঠাকুর্দার ভাই, জগন্নাথ ভট্টাচার্য। সে-ই যখন পুজো-আচ্চাকে জীবিকা করে আশি বছর জীবন কাটিয়ে সজ্ঞানে মারা গেল, সন্ধ্যার বিশ্বাস হয়েছিল যে শুচি-অশুচি মানুষের। সে শুধু মেয়েমানুষের মনে ভগবানের ভয়ের শিকল পরিয়ে পোষ্য বানাবার কল বই আর কিছু নয়।
...

বোকা উইয়ের ঢিবি

মানিয়ে তো নিতেই হবে। চ্যালেঞ্জটা হল নিজস্বতাকে হারাতে দেওয়া যাবে না। সেকি সম্ভব? নিজেকে না বদলে বদলকে মেনে নেওয়া যায়?
    দর্জির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই সব ভাবছিল জনাই। তার ছিটটা আস্ত জামা হয়ে গেল। অথচ তার জীবনটা… নাহ্, ভালো দর্জি সে হতে পারল না। এখন আশা ছেলেটাকে নিয়ে। স্বপ্ন। ছেলেটা অঙ্ক করতে এসেছে। ক্লাস নাইনে পড়ে। রাত দশটায় ছাড়বেন স্যার। অর্ধেক মাইনে নেন। 
    নিজের টোটোটার দিকে তাকালো। মানুষ কত কি বানায়! লোহা পিটে, টিন পিটে, কাপড় কেটে। সামনের বড় বড় ফ্ল্যাটগুলোর দিকে তাকালো। সিমেন্ট, ইট দিয়েই তো বানিয়েছে। মানুষের মাথায় কত কি ভাবনা! অথচ জীবনটা যেমন চায় বানাতে পারে না। কেন? 
...

রক্তমণি

মোবাইলটা অফ্ করে চার্জে বসিয়ে, এসিটা অফ্ করে ঝুল বারান্দায় এসে বসল মল্লিকা। আঁচলে মুখটা মুছে বলল, উফ্...। 
    রাত এগারোটা। সারাদিন বৃষ্টি। কেটেছে খানিক আগে। গোটা আকাশ যেন মুছে গেছে কেউ ন্যাতা দিয়ে, যত্ন করে। সবক'টা তারা বসার ঘরের শৌখিন সাজানো জিনিসের মত জ্বলজ্বল করছে। 
    তারা দেখলেই এই তিয়াত্তর বছর বয়সটা একটা বাইরের ঘটনা মনে হয়। সমস্ত ছেলেবেলা যেন বুক আঁকড়ে বসে আছে। লুকিয়ে। তারারা ওদের বাসা জানে। ঠিক বার করে আনে। স্কুলের ব্যাগ, ভাত মেখে খাওয়ানোর সময় মায়ের চুড়ির আওয়াজ, বাড়ির সামনের পুকুর, রাস্তা... সব মনে পড়ে যায়। 
...

আনন্দময়ী

তুমি কি আনন্দময়ী? আমার রেজাল্ট বেরিয়েছে। আমি ফেল করেছি। বাবা যখন পুজো দিতে আসবে মন্দিরে, বাবাকে একটু বুঝিয়ে বোলো না, আমায় যেন না মারে!
       সিক্সে পড়ে। নাম বুলবুল। বাবা মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। তান্ত্রিক, জ্যোতিষীও বটে। গ্রামে নামডাক বেশ। 
    বুলবুল বাড়ি এসে, নাকেমুখে গুঁজে মাসির বাড়ি চলে গেল। একাই। সাইকেল নিয়ে। বলে গেল দুদিন পর ফিরবে। মা নেই। এক লতায়পাতায় পিসি আছে। সে না থাকলেই খুশি হয় বেশি। 
...

জাহাজ আর লোকটা 

লোকটা যখন জেগে উঠল, তখন জাহাজটা মাঝ সমুদ্রে। বিশাল বড় জাহাজ। লোকটা হামাগুড়ি দিয়ে জাহাজের পাটাতনে এলো। মাথাটা উঁচু করে তাকালো। চারদিক জল জল আর জল। আকাশের দিকে তাকালো। নীল নীল আর নীল। শূন্য সব। লোকটা বুকের কাছে হাতটা নিয়ে গিয়ে নিজের বুকটা খামচে ধরল। সে জানে সে ডুবে যাবে। এ জাহাজ ডুবে যাবে। সবাই শেষ হয়ে যাবে। না, না, না, এ হতে পারে না। লোকটা নিজেকে গুটিয়ে শামুকের মত কুঁকড়ে শুয়ে থাকল। 
    
    পিঠে কারোর ছোঁয়া লাগল। সে ঘুরে তাকালো। জাহাজের কর্মচারী একজন। সে বলল, কি হয়েছে? বমি পাচ্ছে? 
...
Subscribe to অনুগল্প