আলোটা নিভিয়ে দে শম্ভু, আর আওয়াজটাও বন্ধ করে দে।
কথাটা বেশ চীৎকার করেই বলতে হল। উপায় নেই। সামনে প্রচণ্ড জোরে লরির উপর বক্স বাজছে।
সামনে শোয়ানো বৃদ্ধার নিথর দেহ। এখনও গরম। এইমাত্র হল। হাতের উপরেই। মুখটা হাঁ করে, ডান দিক থেকে জল গড়িয়ে নীল বালিশের ওয়াড়ে পড়ে। ভিজে। বৃদ্ধার ছেলেই কথাগুলো বলে, নিজের মাথাটা হাঁটুর উপর রাখা দুটো হাতের উপর ভর দিয়ে রাখল। ক্লান্ত লাগছে। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হল মায়ের সন্ধ্যে সাতটা দশ থেকে। হঠাৎই। অ্যাম্বুলেন্স ডেকে বেরোতে বেরোতে প্রায় আটটা। শম্ভু, মানে অ্যাম্বুলেন্স চালক বলল, রতনদা রাস্তায় আজ ছ'টা প্রসেশান বেরোবে। জানি না হাস্পাতালে পৌঁছতে পারব কিনা সময় মত।
রতন ছেলেকে বলল, বাবলু সামনে দেখে আয় তো কতটা দূর অবধি প্রসেশান রাস্তা আটকিয়ে… আর শোন.. কাউকে কিছু বলিস না… বেকার ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই আর..
বাবলু ইলেভেনে পড়ে। রাস্তা জুড়ে আলো, নাচ, গান। ব্যাণ্ডপার্টি। ঢাক। সাঁওতালদের মত সেজে মেয়েরা। নাচছে। মিকি মাউস সেজেছে কেউ। কেউ ডোরেমন। যত এগোচ্ছে, তত আওয়াজ বাড়ছে। নাচ বাড়ছে। কিছু চেনা মানুষের মুখ পড়ল চোখে। ঘুরিয়ে নিল। কান্না পাচ্ছে। সকালেও ঠাকুমার সঙ্গে কথা হয়েছে। দুপুরে পাশেই ঘুমিয়েছে ঠাকুমাকে জড়িয়ে। হাতটা শুঁকলো, এখনও যেন জর্দার গন্ধ লেগে।
এগিয়ে লাভ নেই। যতদূর চোখ যায় শুধু আলো আর হুল্লোড়। আর কালীমূর্তি।
রতন মায়ের দিকে তাকিয়ে বসে। মা প্রত্যেক পুজোয় উপোস করত। বাবা চলে যাওয়ার পর একদিনও আমিষ মুখে দেননি। চোখটা বন্ধ। স্থির শরীরটার দিকে তাকিয়ে বসে রতন। বাবলু এসে ঢুকল। দরজা বন্ধ করে বসল। বলল, ও যাওয়া যাবে না এখন। ছাড়ো। বাড়িতে ফোন করবে?
রতন মাথা নাড়ল। কিছুক্ষণ পর বলল, না না, ব্যতিব্যস্ত করে লাভ কি ওদের। বোস।
শম্ভু মাঝে মাঝেই পিছনে ফিরে তাকাচ্ছে। অপরাধীর মত মুখ করে কয়েকবার বলল, দাদা আমি কিছুতেই গাড়ি বার করতে পারতাম না দেখো….
রতন বলল, শম্ভু চুপ কর। আমি তো অন্ধ না রে। জানি। বোস, দেখ কখন ছাড়া পাস।
শেষের দিকে ঠাকুমার চোখগুলো ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল যেন। বাইরে তখন "কেশরিয়া তেরা ইস্ক হ্যায় পিয়া…" বাজছে। তুমুল আলোর ঝলকানি। বাবলু নিজের হাতটা দেখল। ঠাকুমা'র আঙুলের দাগ বসে আছে। হাতটা চেপে ধরে শ্বাস নিতে চাইছিল। বাবা তখন মুখে জল দিচ্ছে অক্সিজেনের মাস্কটা সরিয়ে। কিছু কি বলতে চাইছিল? এত আওয়াজে শোনা যেত না তো। ভল্যিউম কম করতে বলছিল কি?
অল্প অল্প গাড়ি এগোচ্ছে। গাড়ির মাথার নীল আলোটা বন্ধ। আওয়াজটাও বন্ধ। সামনে ছ'টা কালী। প্রচুর মানুষ। বিশাল হুল্লোড়। অ্যাম্বুলেন্সের আলোটা সামনে এত আলোর মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে।
বাবলু বলল, বাবা তুমি প্রেসারের ওষুধটা খেয়েছিলে?
রতন ছেলের মুখের দিকে তাকালো। পিঠে হাত রেখে বলল, আমি ঠিক আছি রে… ভাবিস না….
বাবলু বাবার কাছে এগিয়ে এলো আরো। বাবার ডান থাইয়ের উপর হাত রাখল। কান্না পাচ্ছে…. একবার বলল, আজকে না হলে হয় তো ঠাকুমা বেঁচে যেত, না বাবা?
রতন বলল, কি? শ্বাসকষ্টটা, না বিসর্জন?
বাইরে তখন গান চলছে, "জিমি জিমি.. আজা আজা……"
রতন খেয়াল করল, তার অজান্তেই ডান পায়ে তাল দিচ্ছে সে। অভ্যাস হয়ে যায় সবই।
বাবলু বলল, জল খাবে?
রতন বলল, নাহ্ রে, একটু চা হলে ভালো হত।