Skip to main content

সবক'টা নীল আলো যেন ডাকছে, আয় আয় নীলু আয়...

'নীলু' বলে ডাকার কেউ নেই। বাষট্টি বছর হল এই জুলাইয়ে।

পুরী এক্সপ্রেস। থ্রি টায়ার। ছেলে, বউ, দুই নাতনি। লোয়ার বার্থে উল্টোদিকে ছেলের শালী। ওর বর বাইরে থাকে। মেয়ে হস্টেলে।

শবরী উঠে বসল। অম্বল হয়েছে। গলার কাছটা জ্বালা করছে। বোতলটা টেবিলের উপর দেওয়ালের সাথে লাগানো আঙটায় ঝুলছে। দু'ঢোক খেয়ে বসে থাকল। শুতে ইচ্ছা করছে না।

মাথার কাছে রাখা কাপড়ের ব্যাগটা হাতে নিল। ডান হাতটা ঢুকিয়ে স্পর্শ করল, ধাতুর শীতল স্পর্শ। গোপালের মূর্তি। বার করে টেবিলের উপর রাখল।

কাঁচটায় নাক ঠেকিয়ে দেখল শবরী। বাইরে মাঠ পার হয়ে যাচ্ছে। পূর্ণিমা আগামীকাল। বউমা পূর্ণিমার রাতে সমুদ্র দেখবে। ভীষণ আনন্দ পায় বউমা। পাক। আনন্দের কোনো মানচিত্র হয় না। গড়িয়ে আসে কোথা থেকে কেউ টের পায় না। আবার চলেও যায়। না বলেই।

গোপাল তাকিয়ে আছে শবরীর দিকে। বউমা বলে বাড়াবাড়ি। নাতনিরা বলে আদিখ্যেতা। শবরী উত্তর করে না। অন্যের আনন্দ বোঝা যায় না গোপাল না বোঝালে। নইলে একদল জিতলে আরেক দল তাদের আনন্দ অনুভব করে না কেন?

গোপালের দিকে তাকিয়ে বসে থাকা শবরীর অনেক দিনের অভ্যাস। গোপাল তার আনন্দ। শৈশবের আনন্দ। শিশুর সঙ্গে মানুষ নিজের শৈশবকে পায়। তাই এত সুখ। গোপাল সেই সুখ। তত্ত্ব নেই। শাসন নেই। সুখ আছে।

তলপেটে চাপ আসছে। অনেকক্ষণ আসছে। যেতে ইচ্ছা করছিল না।

উঠল শবরী। কাঁচ ঠেলে বাইরে এলো। অনেকদিনের অভ্যাস। স্বামী রেলে কাজ করত। বড় অফিসার ছিল। বাবুও তো অফিসার্স কলোনীতেই মানুষ। এখন প্রাইভেটে কাজ করে। ভালো জায়গাতেই আছে। তবু সুখ নেই। বাবুর কি যেন নেই। সুখের চাবিটা নেই।

টয়লেটের হেলানো কাঁচের বাইরে থেকে হুহু করে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে। মাঘের বাতাস।

শবরী বাইরে এসে দাঁড়ালো। প্রচণ্ড দুলছে। ব্যালেন্স রাখতে অসুবিধা হচ্ছে। দু'জন মানুষ মেঝেতে কম্বল জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। বেসিনটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। এবার ফিরতে হবে। আজকাল কোথাও ফিরতে ইচ্ছা করে না। তবুও। বাধ্য। কার কাছে?

 

=======

 

কাঁচটা ঠেলে ঢুকল। নীল আলোর সারি। বাঁদিকে উপরে নীচে। ডানদিকে কূপগুলো। শবরী বার্থে, লোহার বিভেদকে হাত দিয়ে দিয়ে টাল সামলাতে সামলাতে এগোচ্ছে। বুকটা ধড়ফড় করছে। চিনতে পারছে না তো! সাদা চাদরে ঢাকা সব মানুষ। রঞ্জনকে হাস্পাতালের পাশে একটা চাকা লাগানো ট্রলিতে শুইয়ে রেখেছিল এমন।

সেদিন সন্ধ্যেটা আর চার-পাঁচটা দিনের মতই তো ছিল। বাবু হস্টেল থেকে ফোন করেছে। রঞ্জন অফিস থেকে এসে চা খাচ্ছে। শবরী টিভি দেখছে। হঠাৎ বুকটা চেপে শুয়ে পড়ল রঞ্জন। হাস্পাতালে লড়ল চারঘন্টা। বাবু এলো বিকেলে। ফ্লাইটে।

সব কাজ মিটল। বাবু ফিরে গেল হস্টেলে। সারাদিন একা ঘরে শবরী। রঞ্জনের রিটায়ার করতে আর কয়েক মাস ছিল। অনেক বয়সের পার্থক্য ছিল। লোকে বলত অসুবিধা হবে। হয়নি তো। এবার হতে শুরু করল। শবরী জানত না একাকীত্ব কাকে বলে। বরং একা থাকার ইচ্ছা হত খুব। পাখির বাসার মত একা।

শাশুড়ির বাক্সের মধ্যে পেয়েছিল শবরী গোপালকে। একটা লাল কাপড়ে জড়ানো। পাশে রাখা শাশুড়ির জপের মালার থলি। তার মধ্যে জপের মালা। কিভাবে পেল?

কোয়াটার্স ছেড়ে শবরী এলো কল্যাণীর ফ্ল্যাটে। আগেই কেনা ছিল। নমো নমো করে গৃহপ্রবেশ করে চলে এলো। বাবু আসতে পারল না। সেই ফ্ল্যাটে এসে নতুন করে গোছাতে শুরু করল সব। রঞ্জনের ছবিটা রাখল খাটে, যেদিকে মাথা করে শোয় সেদিকে। একদিন শাশুড়ির বাক্সটা চোখে পড়ল। খাবার টেবিলটা লাগানোর সময়।

গোপালের চোখে চোখ পড়ল। ফাঁকা ঘরে বাজল নূপুরের শব্দ। শবরী নিজেকে বলল, তার পাখির বাসায় পড়ল জ্যোৎস্নার আলো। সব বদলে গেল সেদিন থেকে। খাট কিনল। সাজের পোশাক কিনল। আরো কি কি সব কিনল। শবরীর নিজেকে দেখেও অবাক লাগল। একা মানুষ বড় আশ্চর্যের। নিজের কাছেও।

 

=======

 

শবরী একটা একটা কূপের দিকে তাকাচ্ছে। নীল আলোর সারি যেন কি রহস্য। সামনে অনন্ত রাস্তা। রঞ্জন? কে দাঁড়িয়ে সামনে? ও কে?

কেউ না। ঘাম হচ্ছে। এটা কি অন্য বগি? আজকাল ভুল হয় খুব। যদি না পায়? চীৎকার করবে? ডাকবে?

হঠাৎ চোখ আটকালো একটা কূপের দিকে। টেবিলে বসে গোপাল। ট্রেন দাঁড়িয়ে কোনো স্টেশানে। জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে এসে পড়া আলো পড়েছে গোপালের গায়ে, মুখে। কালো চোখের ডাক।

শবরী বসল সিটে। ঘাড়টা নীচু করে। ঝাঁকুনি দিয়ে ছাড়ল ট্রেন। শুলো শবরী। বুকের উপর রাখল গোপালকে। জিজ্ঞাসা করল, কি হত যদি হারিয়ে যেতাম?

ঠাম্মি… তুমি জেগে?

ছোটো নাতনি। এইটে পড়ে।

কেন রে মা?

পটি পেয়েছে…. যাবে? দাঁড়াবে?

শবরী হাসল।

রিনা নেমে চটি খুঁজছে ঘুম চোখে। শবরী ফোনটার আলোটা জ্বালল। রিনা চটি পায়ে শবরীর হাত ধরে বলল, চলো.. উফ্… বেরিয়ে যাবে এখানেই ঠাম্মি না হলে…

শবরী গোপালকে টেবিলে রেখে বলল, চল… চল… এখানে হেগে কাজ নেই তোমার….

রিনা বলল, উফ্.. কিন্তু ওকে এখানে রেখে যাচ্ছ কেন? কেউ কিডন্যাপ করলে?

শবরী বলল, করবে না… তুই চল… ও থাকলে ফিরতে পারব…

সামনে নীল আলোর সারি। পিছনেও। শবরী জানে কোথাও দাঁড়িয়ে আছে রঞ্জন। এই অন্ধকারেই। নীল আলোয়।