কাজ করতে করতে শুনতে পেলাম দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে বৈষ্ণবী ভিক্ষুণী। গান গাইছে খঞ্জনি বাজিয়ে। নামগান।
ভিক্ষা নিয়ে দরজার কাছে দাঁড়ালাম। বৈষ্ণবী গেয়ে চলেছে। চোখ বন্ধ। সে যেন আজ ভিক্ষার জন্য গাইছে না। নিজের জন্য গাইছে। তার মুখ জুড়ে টইটম্বুর ব্যথা।
কিন্তু এ বৈষ্ণবীকে তো আমি চিনি না। তার ভিক্ষা তো দাবী হয়ে আসে। তার তীর্থযাত্রা, তার আশ্রমের নানা অনুষ্ঠান…কত দাবী তার! কিন্তু আজ তার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল, সব গেছে। যেন রুক্ষ মাটি বহুদিন বাদে বর্ষায় শ্যামল হয়েছে। শ্যামল মাটির উপরে বর্ষার মেঘ ঘন হয়ে এসেছে, যে কোনো মুহূর্তেই যেন শুরু হবে ধারাবর্ষণ।
চোখ খুলল সে, হেসে বলল, ভালো আছেন দাদা?
জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি ভালো আছ?
তার সমস্ত শরীর নিংড়ে একটাই শব্দ বেরোলো, সে ছেড়ে গেল দাদা!
তার গেরুয়া, তার কণ্ঠী, তার ভিক্ষার ঝোলা সব একসঙ্গে ফুঁপিয়ে উঠল যেন, বলল, সে ছেড়ে গেল।
ভিক্ষা নিল। গেট আটকিয়ে চলে গেল। শুনতে পেলাম অন্যবাড়ির সামনে তার নামগান। ব্যথার আকুতি। আকাশে বাতাসে নামগান ছড়িয়ে সে খুঁজছে সান্ত্বনা। আমার জন্য রেখে গেল একমুঠো ব্যথা। আমায় দিয়ে গেল ভিক্ষা। ব্যথার ভিক্ষা।
সব ছেড়ে যায় বৈষ্ণবী। মানুষ সান্ত্বনার জন্য কত দর্শন, কত গল্প বানায়। বুদ্ধ বলে গেলেন, সব ভেঙে যায়, সব ছেড়ে যায়, এই ধ্রুব সত্য। তাতে কি হল বৈষ্ণবী? সে ধ্রুবসত্যকে জেনে কি হয় বৈষ্ণবী? কিচ্ছু না। ব্যথাও ধ্রুবসত্য। তুমি বলো কৃষ্ণের মধ্যে সব, বুদ্ধ বলেন শূন্যের মধ্যে সব। আদতে বিরহের মধ্যেই সব বৈষ্ণবী। যন্ত্রণার মধ্যেই সব বৈষ্ণবী। আমাদের ঘুম থেকে জাগা। আমার গায়ের উপর থেকে আমার 'আমি'র চাদরটা সরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ানো। নিজেকে বলা, এই যে এসে দাঁড়ালাম, সব ব্যথাটুকুর মধ্যে। এই যে আমি জেগে আছি।
তুমি যে ভিক্ষা দিয়ে গেলে, আমার জমানো সযত্নে রাখা সব ব্যথার সঙ্গে একেও রাখলাম। তোমার খঞ্জনির আঘাত, তোমার গলার সুর সব মিলিয়ে সে থাক আমার বুকের গোপন কুলুঙ্গিতে। যদি কোনোদিন তোমার ঠাকুর এসে দাঁড়ান আমার সামনে, তাঁকে বলব, তোমার বাঁশিতে যদি সুরের অভাব হয়, মানুষের গোপন কুলুঙ্গিতে খুঁজো, সেখানে অসীম সুর, ব্যথার, পেয়েও না পাওয়ার। তোমার বাঁশিতে সুরের অভাব হবে না।