নিজের জন্য মন খারাপ হল সরস্বতীর। কার্তিক মাসের সকাল। শীত আলতো হাতে বাচ্চাদের মত ছুঁচ্ছে। ফুটছে না। পুকুরের উপর অল্প অল্প ঢেউ। ছেলেবেলা, যৌবনবেলা, সোহাগবেলা, মা-বেলা সব আবছা। এখন শুধু মন খারাপ বেলা। জবাগাছটার জন্য, তুলসীমঞ্চটার জন্য, হাঁসগুলোর জন্যে, রামকৃষ্ণ ঠাকুরের ছবিটার জন্য।
কত বছর হল দক্ষিণেশ্বর যায়নি। আর যাবেও না। আগে কালীপুজোর দিন নিয়ে যেত স্বামী, বলাই। ছবিটাও কিনে দিয়েছিল। সরস্বতীর রামকৃষ্ণ ঠাকুরের মুখটা দেখে ভালো লেগেছিল। ঠাকুর মনে হয়নি। বাচ্চা মনে হয়েছিল। যেন শিশু তাকিয়ে। স্বামী চলে গেল। ছেলেরা ব্যস্ত। মেয়েরা ব্যস্ত। নাতি নাতনিরা ব্যস্ত। ভাগ্যে পুকুরটা ব্যস্ত নয়। জবাগাছ, কলাগাছ, তুলসীমঞ্চ ব্যস্ত নয়। রামকৃষ্ণ ঠাকুর ব্যস্ত নয়। মাঝে মাঝে তো ভাতের থালাও ব্যস্ত। দেরি করে আসে।
সরস্বতী একটা সাদা শাড়ি, যা বহুব্যবহারে প্রায় কালো এখন গায়ে জড়িয়ে পুকুরধারে বসে। চুলগুলো উসকোখুসকো। সকাল দশটা হবে। সকালে খই আর একটা কলা খেয়েছে। জিনিসের দাম বাড়ছে। এখন বেঁচে থাকতে অল্প অল্প লজ্জা করে। বিশেষ করে খাওয়ার সময়। ঝাপসা হয়ে যাওয়া রামকৃষ্ণ ঠাকুরের ছবির দিকে তাকায়। চন্দন দিতে পারে না এখন আর। বাটা হয় না। হাতে লাগে। ফুল মাঝে মাঝে দেয়। ছোটো বউ ঠাকুর দেয়। বামুনের মেয়ে। ভালোবাসা করে বিয়ে। নইলে কায়েতের বাড়ি বামুনের মেয়ে বউ হয়ে আসে?
রামকৃষ্ণ ঠাকুরের ছবিটা তার খাটের পাশে। তাকের উপর। খাওয়ার পর তাকায়। লজ্জা লাগে। ঋণ বাড়ছে। সংসারে কি দেবে সে? রামকৃষ্ণ ঠাকুরকে বলে, কি দেব? রামকৃষ্ণ ঠাকুর হাসে। একটু পরে সরস্বতীও হাসে। ঈশ্বরের ইচ্ছা বোঝা যায় না। হাঁসের মতিগতিই বুঝতে পারে না, তো ঈশ্বর!
সরস্বতী আগে ঘুঁটে দিত। এখন বাড়িতে গ্যাসে রান্না হয়। কিন্তু ঘুঁটে দিতে খুব ইচ্ছা করে। রাস্তায় গোবর পড়ে থাকলেই হাত নিশপিশ করে। কিন্তু কার দেওয়ালে দেবে? চারদিকে পাকা দেওয়াল। তার নিজের বাড়িতেও। পাকা দেওয়ালে ঘুঁটে দিলে খুব অশান্তি হয়। আগে হয়েছে।
কিন্তু মারা যাওয়ার আগে একবারও ঘুঁটে দেবে না? হঠাৎ মনটা কঁকিয়ে উঠল সরস্বতীর। সারা জীবন নিজের জন্য কি করেছে? কি চেয়েছে? কিচ্ছু না। কিন্তু নরম গোবর থেকে শক্ত ঘুঁটে বানাতে গিয়ে তার মনে হয়েছে এ তার নিজের জন্য। কারোর জন্য না। দেওয়াল জুড়ে ঘুঁটে দেখে মনে হয়েছে তার মনের সব কথা ঘুঁটেরা জানে। আগুনে দিয়ে মনে হয়েছে তার সব কথা আগুনে পুড়ে ধোঁয়া হয়ে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। একটা যা হোক গতি হচ্ছে। তার এক এক সময় মনে হয় ভগবান যেন সারা সংসার ঘুঁটে দিয়ে রেখেছে। ইচ্ছা হলেই পোড়াচ্ছে নিয়ে গিয়ে। যাকে তাকে। যখন তখন। ভগবানের পোড়াতে আগুন লাগে না। ইচ্ছা হলেই হয়। বড় নাতিটা যেমন জলে ডুবে পুড়ে গেল। দেড় বছর বয়সে।
সরস্বতী উঠল। জীবনের শেষ ঘুঁটেটা দেবে আজ। রাস্তায় এসে দাঁড়ালো। কোনদিকে যাবে? ডানদিক ধরে এগোতে শুরু করল। বুকটা ধক ধক করছে। কিছুটা যেতেই পাওয়া গেল একতাল গোবর। টাটকা। হাতে তুলে নিল। সদ্যজাত সন্তানের মত। গন্ধটা প্রাণে এসে লাগল। সব নাড়িকাটার সুখ আর ব্যথা একসঙ্গে মনে পড়ে গেল। মাটির সঙ্গে ওইটুকুই তো যোগ। বাকি জীবনটা তো মানুষের বানানো নিয়মের সঙ্গে।
কিন্তু দেওয়াল কোথায় পাবে?
গোবর নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা ভাঙা স্কুল পেয়ে গেল। আগে এখানে বাচ্চারা আসত। এখন কেউ আসে না। ঝোপেজঙ্গলে ভর্তি। সরস্বতী রাস্তা ছেড়ে ঝোপ সরিয়ে সরিয়ে স্কুলে এসে ঢুকল। গেল বর্ষায় এখানে সাপে কেটে মরেছে হারুর বড় ছেলেটা। মদ খেয়ে পড়েছিল।
কাল রাতের বৃষ্টিতে স্কুলের এখানে সেখানে জল জমে আছে। সরস্বতী উবু হয়ে বসে আঁজলা করে সেই জল তুলে নিয়ে গোবর মাখতে বসল। কাঁধের থেকে শাড়ি খসে মাটিতে পড়ল। উন্মুক্ত বুকের উপর ছুঁলো হালকা শীতের হাওয়া। সরস্বতীর চোখ মুদে এলো। আঁচলটা আবার তুলে কাঁধে, মাখা গোবরটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কোমরটা টাটিয়ে উঠল।
দেওয়ালে ঘুঁটে পড়ল। সরস্বতীর হাতের ছাপ নিয়ে। সরস্বতী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। তার পাশে এসে দাঁড়ালো রামকৃষ্ণ ঠাকুর। বারো বছরের বাচ্চাটা। তার গোবরমাখা হাতটা ধরে খিলখিল করে হেসে উঠল। সরস্বতী বলল, কাল এসে তুলে নিয়ে যাব ঠাকুর। তোমায় পায়েস রেঁধে খাওয়াব।
পরেরদিন আর আসা হল না সরস্বতীর। স্কুলের পাশ দিয়ে, মালাচন্দন গায়ে সরস্বতী যখন মাথাটা দোলাতে দোলাতে খাটে শুয়ে যাচ্ছে, চোখ বন্ধ চিরকালের জন্য, তখনও ভাঙা স্কুলের দেওয়ালে সরস্বতীর হাতের ছাপ মাখানো শুকনো ঘুঁটেগুলো সরস্বতীর ফেরার রাস্তার দিকে তাকিয়ে। তাদের নিয়ে যাবে বলে, ঘরে। আগুন দেবে। তখন অন্য কোনো এক আকাশে রামকৃষ্ণ ঠাকুর এক্কা দোক্কার ছক সাজিয়ে অপেক্ষা করছে সরস্বতীর, এলেই খেলবে বলে। সরস্বতীর আরাম ছাওয়া মুখে কার্তিকের নরম রোদের আমেজ। আজ তার আর লজ্জা লাগছে না। ঘুঁটের মত পুড়ে যাব। আঙুলের সব ছাপটুকু নিয়ে, সংসারে যেখানে যেটুকু লেগে ছিল। সবাই সবটুকু ভুলে যাবে।
(ছবি Aniket)