ছেলেটা সবাইকে চিনতে পারল। মেঘ করে এসেছে। চারদিকে উত্তাল নদী। তীরে বাঁধা স্টিমারটা দুলছে।
থেকে যা না!
দ্বীপের নাম কি?
কেউ উত্তর দিল না। মেঘ আরো নেমে আসছে। নদীর বুক ছুঁয়ে ফেলবে আরেকটু পরেই।
বৃষ্টি শুরু হল। ছেলেটার পিঠের উপর হাত রাখল তার মা। বৃষ্টি আকাশ থেকে ঝরে মাথার চুল ভিজিয়ে, চোখের পাতা ভিজিয়ে মুখ বেয়ে নামছে। কোনো ঐতিহাসিক মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে যেন। বৃষ্টির ধারা থেকে চোখটা বাঁচিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করল, ফিরতে হবেই?
এই দ্বীপের নাম কি? তোমরা সবাই এখানে কেন? এই স্টিমার কটায় ছাড়বে?
স্টিমারের মালিক সামনে এসে দাঁড়ালো। বলল, স্যার ছটা চল্লিশে ছাড়বে। আপনি ওপারে পৌঁছে ট্রেন পেয়ে যাবেন।
ছেলেটা বলল, এরা কেউ যাবে না ওপারে? কেন, বাজে ওয়েদারের জন্য? ঝড় আসতে পারে বলে? স্টিমার ডুবে যেতে পারে বলে?
মালিক বলল, না না, ওরা যেতে পারে না ওপারে আর… আর মৃত্যুভয় নেই ওদের… ক'বার মৃত্যু হবে স্যার ওদের… চিনতে পারছেন না আপনি… সবাই আপনারই তো… মৃত্যুভয়?… সে তো আপনার স্যার.. ভয় নেই… স্টিমার ডুববে না… আপনাকে সাড়ে আটটার ট্রেন ধরিয়ে দেব… গেলে বলবেন…
ছেলেটা দেখল স্টিমারটা ফাঁকা। কেউ নেই। জোলো হাওয়ায় দুলছে অল্প অল্প।
সবাই ঘিরে দাঁড়িয়ে তাকে।
থেকে গেলে হয় না?
ছেলেটা হাতঘড়ির দিকে তাকালো। ঘড়ির উপর জলের বিন্দু। বৃষ্টির জল। ভালোবাসা না, জীবন চাই। তার কতটা সময় বাকি আর?
আবার পিঠে হাত দাদার…. যে দাদা একেবারে ছেড়ে গেছে ভেবেছিল সে জলে নাভি ভাসিয়ে…
দাদার নাভিতে হাত দিল। বৃষ্টির জল থইথই। দাদা বলল, থেকে যা না!
বৃষ্টির জল নামছে অচেনা আকাশ থেকে। অঝোরে। ক'টা বাজে? চারদিক গাছ আর গাছ। জঙ্গল। কয়েকজন এখানে ওখানে ছড়িয়েছিটিয়ে বসে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে। টালির ফাঁক থেকে ধোঁয়া উড়ছে। মিশে যাচ্ছে বৃষ্টির বুকে। ভাত রাঁধা হচ্ছে?
ছেলেটা চমকে মাকে খুঁজল। মা কি ভাত বসিয়েছে? ক'টা বাজে? স্টিমার ছাড়ার সময় হয়ে আসছে কি? মেঘলা বেলা, সময় বোঝা যায় না।
মালিক স্টিমারের সামনে দাঁড়িয়ে। স্টিমারে লাগা দড়ির একটা একটা প্যাঁচ খুলছে, তার দিকে তাকিয়ে। মুখে বিড়ি। সেটা জ্বলছে বৃষ্টির তোয়াক্কা না করে। যেন নাভিরজ্জু কাটছে। জিজ্ঞাসা করছে, আসছেন স্যার? চলুন ট্রেনটা ধরিয়ে দিয়ে আসি….
আশেপাশে আত্মীয়রা নেই। টালির বাড়িটায় ঢুকে যাচ্ছে সবাই, মাথা নীচু, বিষণ্ণ। ফিসফিস করে বলছে, যেতেই হবে? থেকে গেলে হয় না? উত্তাল নদী। এই তো আমরা। এই তো ধোঁয়া ওঠা ভাত। এই তো আমি রে.. এই তো আমরা… আয় আয়…
ছেলেটা দৌড়াচ্ছে।
মালিক পোশাক বদলিয়েছে। এখন সে চালক। বারবার বলছে, আসুন স্যার… তাড়াতাড়ি… সময় চলে যাচ্ছে… জোয়ারের জল চলে যাচ্ছে স্যার… আসুন আসুন…
ছেলেটার পা আটকে যাচ্ছে কাদায়… পা কাটছে শামুকের খোলায়… রক্তের দাগ মিশছে বৃষ্টি ভেজা গলে যাওয়া মাটির ধারায়। সে স্রোত সরু হয়ে ঢুকে যাচ্ছে টালির বাড়িটায়। সন্ধ্যে নামছে। টালির বাড়িটার জানলায় রাখা প্রদীপ শিখার আলো। কেঁপে কেঁপে জ্বলছে। অন্ধকারে আবছা মুখেরা ভিড় করে। কেউ বলছে না আর থেকে যেতে…
সামনে স্টিমার.. মেঘ ঢাকছে স্টিমারের ছাদ… সিট… চালকের হাতল…. মেঘের ভিতর থেকে চালক ঢাকছে… আসুন স্যার… আসুন…. ট্রেনটা ধরিয়ে দিই….
ছেলেটা দৌড়াচ্ছে…. শ্বাস ফুরিয়ে আসার আগে পৌঁছাতে চাইছে স্টিমারে…. ঘন মেঘ সরিয়ে….