Skip to main content

puthi 01

 

এ পুঁথিগুলো জন্মাবধি দেখে আসছি। ঠাকুর্দার কাছেই প্রথম দেখি। ঠাকুর্দা, মানে স্বর্গীয় শ্রী সুরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, তাঁর বাবা স্বর্গীয় শ্রী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য, এবং তাঁর বাবা স্বর্গীয় শ্রীরামচন্দ্র ভট্টাচার্যের আমলের এ পুঁথিগুলো। সংস্কৃতে মন্ত্রের পর মন্ত্র লেখা। ছোটোবেলায় এগুলোতে হাত দেওয়ায় আমাদের নিষেধ ছিল। ঠাকুর্দাই হাতে করে দেখাতেন। আমরা আলতো করে ছুঁতাম। আবার গুটিয়ে রাখা হত।

আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট দিন হিসাবে হার্পার কলিন্স একটা বিজ্ঞাপন দেয়, সেখানে লেখে যে ইন্টারনেট আসার পর থেকে একেকটা বাড়ি লাইব্রেরি হয়ে উঠছে।

কথাটা আমার বেশ লাগে। কারণ সত্যিই তো তাই। আজ যত না কাগজে ছাপা বই পড়ি, তার চাইতে বেশি পড়ি ইবুক। তাছাড়া বিভিন্ন বাংলা ওয়েবসাইট থেকে অনলাইনে বই পড়ি। যেমন টেগোরওয়েব থেকে গোটা রবীন্দ্রনাথ, অদ্বৈত আশ্রম থেকে গোটা স্বামীজি, এমকে.ওআরজি থেকে গোটা মহাত্মা গান্ধী, ইবাংলালাইব্রেরি.কম থেকে বাংলার বহু সাহিত্যের বই…. ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যিই তো ইন্টারনেট আসার পর অনলাইনে শুধু কি বই? কাগজে ছাপা মড়মড়ে খবরের কাগজের বদলে ই-পেপারে গ্রাহক হচ্ছি।

পড়াটা থেমে থাকছে না। পুঁথি থেকে ই-বুকের রাস্তাটা তো বড় কম নয়। এখন আবার কথকের মত অডিওবুক-ও এসে গেছে। তবু নিজের মনে পড়াটার আরামই আলাদা। নইলে অন্যের আবেগের উপর নির্ভর করতে হয় খানিক। তবু সেও একরকম ভালো, বিশেষ করে যাদের পড়তে অসুবিধা আছে শারীরিক কারণে।

তবে শুধু গল্পটা তো পুঁথির থেকে ই-বুকের নয়। গল্পটা একটা সমাজেরও। সেও তো গড়িয়েছে অনেকটা রাস্তা। আমি তো এক্কেবারে পূজারী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মেছি। ছোটোবেলাতেও দেখেছি বাবা, জেঠু সরকারি চাকরি করেন যদিও, কিন্তু ঠাকুর্দা পূজারীর কাজ করে চলেছেন। আসলে ওটাই তো তাঁর পরিচয়ও, শুধু তো পেশা নয়। ঠাকুর্দা দুর্গাপুজো, কালীপুজো করে শাড়ি, ধুতি নিয়ে আসতেন। শ্রাদ্ধশান্তি ইত্যাদিও করতেন। পৈতে, গীতা ইত্যাদি নিয়ে আসতেন। একটা ট্রাঙ্কই ছিল তাতে গীতা ভর্তি। ঠাকুর্দা ক'দিন পর বাড়ি ফিরলে আমি উৎসুক হয়ে দেখতে যেতাম কি এনেছেন। শাড়ি ঠাকুমা, কি মা-জেঠিমার মধ্যে ভাগ হয়ে যেত। কি কোনো আত্মীয়ের জন্য, কি কারোর দরকার, তাকে দেওয়ার জন্য ঠাকুমা তুলে রাখতেন। আমাদের ভাইবোনেদের জন্য বরাদ্দ হত মিষ্টি। একটু বড় হলে আমার নজরে আসত গীতা। বেশিরভাগই অবশ্য শুধুই সংস্কৃতে লেখা পাতলা বই। তবে একটা গীতা পেয়েছিলাম মনে আছে তাতে বাংলা অনুবাদ ছিল। সেটা বহুদিন আমার সঙ্গে ছিল।

জেঠু মারা যান আকস্মিক। তখন ঠাকুর্দা, ঠাকুমা বেঁচে। এমনকি দেশ ভাগ হওয়ার পর ঠাকুর্দার যে ভাই রমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য'র হাত ধরে বাবা, জেঠু আর ঠাকুমা এদেশে আসেন, সেই তিনিও বেঁচে। আমরা ওঁকে ডাকতাম মণিকাকা দাদু। কারণ বাবা-জেঠু, মা-জেঠি সবাই যেহেতু মণিকাকা বলতেন, আমরা ডাকতাম মণিকাকা দাদু।

জেঠুকে যখন বাইরে শোয়ানো হয়েছে, বাড়িতে গিজগিজ করছে লোক। চারদিকে কান্নার হাহাকার। জেঠিমা, ঠাকুমা বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। তখন ঠাকুর্দাকে দেখেছিলাম ছাদে ওঠার সিঁড়ির কয়েক ধাপ উপরে বসে গীতা পড়ছেন। চোখদুটো টকটকে লাল। আমি সামনে দাঁড়ালাম। ঠাকুর্দা আমার দিকে তাকালেন, চোয়ালদুটো শক্ত করে উচ্চারণ করলেন, বলো তো দাদু,

 

"ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন

নায়ং ভুত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ

অজ নিত্যঃ শ্বাশ্বতহয়োং পুরাণো

ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে"

 

আত্মার জন্ম হয় না, মরণ হয় না, আত্মা অবিনশ্বর, চিরকালের। দেহটাই নষ্ট হয়, আত্মা নয়।

সেই আমার গীতার সঙ্গে আত্মিক পরিচয়। সেদিন বুঝেছিলাম আস্তিক, নাস্তিকতার পারে মানুষের আরেকটা পরিচয় হয়, যেটা তার জীবন্ত বিশ্বাস। বৌদ্ধিক সমর্থন, বা বৌদ্ধিক অসমর্থনের বাইরে আরেকটা কিছু আছে, যা ভীষণ গভীরের, সেটা তার বিশ্বাসেরও গভীরে, সে তার সান্ত্বনা। সে তার মৃত্যুকে জয় করার স্পর্ধা!

জেঠুর শ্রাদ্ধ হচ্ছে, আমার এই মণিকাকাদাদুকে দেখছি চোখের জলে ভাসতে ভাসতে কলাগাছের গোড়া কেটে ডোঙা বানাচ্ছেন। আর বলছেন, দাদুভাই, যাকে হাতে ধরে মানুষ করেছি, এ দেশে এনে পড়াশোনা শিখিয়েছি, মিলে চাকরি তখন আমার, ক'টা টাকাই বা দিত, টিফিনের কেকটা পকেটে লুকিয়ে নিয়ে এসেছি, যাতে ওদের খেতে দিতে পারি, ওদের চাকরি হয়েছে, বিয়ে দিয়েছি… আজ এই কাজটাও আমাকেই করতে হবে!!….

আমি পাশে বসে বেহাল হয়ে কেঁদেছি। গীতার শ্লোক, ঠাকুমার বিহ্বল শূন্যদৃষ্টি, জেঠিমার ভাঙা শাঁখা, সিঁদুর মোছা কপাল, বাবার পাথরের মত বসে থাকা…. সব মিশে গিয়ে বুঝেছি জীবনের গভীরে একটা নদী আছে। অবিনশ্বর নদী। ভালোবাসা আর অনুকম্পার নদী। শত বিপদেও সে নদীর জল শোকায় না। তাই যে চলে গেছে তাকে ঘিরে এত আয়োজন করার আস্পর্ধা মানুষ দেখায়। এই তার ধর্ম। ভালোবাসাকে বর্ম পরিয়ে রাখার।

আমি বড় হয়েছি। আমার বিশ্বাস, অনুরাগ বদলেছে। একদিন পৈতে ছেড়েছি। কিন্তু একটা দিক দেখেছি আমাদের পরিবারে গোঁড়ামিটা কখনোই প্রধান সুর ছিল না জীবনযাত্রার। যে বছর জেঠু মারা যান, সেই বছর আমাদের ভাইফোঁটা হয়। ঠাকুমা বলেছিলেন বোনেরা ভাইদের মঙ্গলকামনা করবে, এর সঙ্গে অশৌচের সম্পর্ক কই?

মণিকাকাদাদু, মানে একটু আগে যার কথা বললাম, আমার ঠাকুর্দার ভাই, তাঁর নবাগতা পূত্রবধূকে বরণ করতে হবে। কেউ কেউ বিধান দিলেন আমার বিধবা জেঠিমা যেন না আসেন বরণ করতে। মণিকাকাদাদু বললেন, তবে বরণই হবে না। জেঠিমা এলেন, বরণ হল।

এরপর আরো দিন গেল। একে একে ঠাকুমা, ঠাকুর্দা, মণিকাকাদাদু, মা, ভাই….. সব গেল। আমার চারদিক শূন্য হতে হতে দিগন্ত ছুঁলো।

আজ আমার এক প্রাক্তন ছাত্র, তথা ভাই-বন্ধু যখন এই পুঁথির একটা একটা দড়ি খুলছে সকৌতুহলে, আমার জীবনেরও অনেকগুলো প্রাক্তন পাক খুলে সামনে এসে দাঁড়ালো। একটা কথাই মনে হল, সঙ্কীর্ণতা থেকে বড় ব্যর্থতা জীবনে আর কিছু নেই। অনেক পণ্ডিত, অনেক উচ্চপদস্থ মানুষ দেখলাম। সেই সঙ্গে তাদের অনেক ছলচাতুরীও দেখলাম। আস্তিক, বা নাস্তিকতা নয়, কথাটা সঙ্কীর্ণতা আর উদারতার। আস্তিকতার বিশ্বাসে গোটা জগত এক পরিবার হতে পারে। আবার সঙ্কীর্ণতায় বাড়ির উঠানই ম্লেচ্ছ হয়ে যায়। তেমনই নাস্তিকতার যুক্তির সংকীর্ণতায় দাসপ্রথাকেও গৌরবান্বিত করে তোলা যায়, পরিবেশের দফারফা করে দেওয়া যায় আবার যুক্তির উদারতায় মানবাধিকারের ভিত্তিও স্থাপন করা যায়।

কথাটা উদারতা, আর সঙ্কীর্ণতার। ভাগ্যের আশীর্বাদে এমন একটা পরিবারে জন্মেছি, সেখানে আমার তথাকথিত সার্টিফিকেটহীন ঠাকুমা থেকে শুরু করে আমার উচ্চ শিক্ষিতা মাকে একটাই সুরে জীবনকে বাঁধতে দেখেছি, যার মোদ্দা কথাটা হল --- সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই। তাই জেঠিমাকে বৈধব্যের অত্যচারে পড়তে হয়নি, আর আমাকেও ব্রাহ্মণ হওয়ার সুবাদে আমি যে অন্যদের থেকে শুদ্ধ, এ বিষ মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়নি। শিক্ষা পুঁথি থেকে ই-বুক হোক, যে মাধ্যমেই হোক, এই উদারতার আলোটাই যেন জ্বালিয়ে যায়।

 

puthi 02

puthi 03