কুসুম
======
কুসুমকে নিষ্ঠুর বলার সংসারে অনেক কারণ ছিল। কুসুমের নিষ্ঠুরতার একটাই দর্শন। তার ভাবনার সত্য আর কর্মের সত্য কোনোদিন আলাদা ছিল না। তাই আর পাঁচটা গৃহস্থ সংসারীদের মত, কি ভিখারি বৈষ্ণবদের মত তার মধ্যে নম্রতার স্বাদ প্রায় ছিলই না।
কুসুম কী করে জানি সংসারে ঢুকেই টের পেয়েছিল সংসারে নম্রতা, ভদ্রতাটা অনেকখানি নকল। ওর উপর শ্রদ্ধা অনেক আগেই খুইয়ে বসেছিল কুসুম। এরপর মা-বাপ মরা মেয়েকে যখন আত্মীয়রা এক মোদোমাতালের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে নিজেদের 'কর্তব্য'টা সারল, কুসুমের আত্মীয়দের উপর ঘৃণার জন্যেই হোক, কি ঘৃণাজনিত অবসাদের জন্যেই হোক, সব আত্মীয়দের থেকে মুখ ফিরিয়েছিল।
কুসুম স্বামীর সেবা করেনি। মদে চুর স্বামীকে ডিঙিয়ে কাজে বেরিয়েছে। স্বামীর জন্য ভাতটুকু পর্যন্ত রেঁধে যায়নি, যা সংসারে আর পাঁচজন আশা করে স্ত্রী-ধর্মের কাছে। স্বামী মারমুখো হলে কুসুম দা-বঁটিহস্ত হয়েছে। নিজে এক ঘা খেলে ফিরে দশ ঘা দিয়েছে।
তবু কুসুম জানে সে না তো কোনোদিন পাপ করেছে, না অন্যায়। নিজের পেটের দায় নিজে নিয়েছে। গায়ে গতরে খেটে টাকা উপার্জন করেছে। অবেলায় আসা ক্ষণিক মেঘের মত বুকে দুর্বলতা যদি জন্মিয়েছে ভালোবাসার মত, কুসুম জেনেছে ও খিদে। এক রহস্যময় খিদে। কুসুম মেঘ কেটে যাওয়ার অপেক্ষা করেছে। কুসুমের কান্না পেয়েছে যদি কোনো কারণে, নিজের পায়ে সেফটিপিন ফুটিয়ে কেঁদেছে। হৃদয়ের কান্নাকে শরীরের ব্যথার কান্না করে নিয়েছে।
কুসুম গ্রামে বেঁচে থেকেছে। গ্রামের আত্মীয় না হয়েই। কিন্তু গ্রামের আলোচনার হয়েই।
======
কুসুমের বরকে একদিন সকালে পুকুরের পাঁকে পাওয়া গেল। কুসুম নিজের হাতে শাঁখা ভেঙে, সিঁদুর মুছে কাজে গেল। তখন কুসুম ইটভাটায় কাজ করে। মাইনে ভালো। খাটনি বেশি।
গ্রামে সবাই নিন্দা করল। কুসুম একটা বড় ভোজের আয়োজন করল। নিন্দার ধার কমল। কিন্তু আঁশের মত ছড়িয়ে থাকল তার আশেপাশে।
======
একদিন ইটভাটায় গিয়ে কুসুম দেখে বড় হইচই। সবাই জটলা করে কী যেন নিয়ে শোরগোল করছে।
কুসুম সবাইকে ঠেলে এগিয়ে দেখে, কাপড়ে জড়ানো একটা মানুষের বাচ্চা। গঙ্গার ধারে কে ফেলে গিয়েছে।
বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে, এই প্রথম তার মনে হল কী যেন একটা বুকের মধ্যে হচ্ছে। কী হচ্ছে বোঝার আগেই তার শরীর, মন কেমন একটা সুখে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। চোখে জল এলো। সে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বলল, আমি নিলাম।
“আমি নিলাম” --- এইটুকু বাক্য। কিন্তু এর মধ্যে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে যেন একটা কম্পন উঠল - এ আমার।
সংসারে হৃদয় আর বাক্যের যোগ ভীষণ কম। যেখানে সে যোগাযোগ স্থাপন হয়ে যায় সেখানে এমন কিছু একটা ঘটে যে চির কপটতায় অভ্যস্ত বুদ্ধি বিবশ হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও তাই হল। সবাই সবটা বোঝার আগেই দেখল কুসুম নেই। বাচ্চাটা নিয়ে ওই দূরে মাঠ পেরিয়ে চলে যাচ্ছে।
ইটভাটার মালিক সেদিন অনেকবার কুসুমের টাকাটা কাটতে চেয়েও পারল না। কেন পারল না নিজেকে জিজ্ঞাসা করার সাহস দেখালো না। অত সাহস যদি থাকত!
======
কুসুম বদলে যেতে শুরু করল। দেখতে দেখতে কুসুমের 'ঢেলা' বড় হতে শুরু করল। গঙ্গার ধারে মাটি থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিল বলে কুসুম ওর নাম রাখল ঢেলা। ভালো নাম জ্যোৎস্না।
ঢেলার গায়ের রঙ চাপা। নাকটা তীক্ষ্ম। চোখদুটো কটা। ঠোঁট পাতলা। মুখটা যেন কুসুমের আদলে বানাতে বানাতেই বিধাতা ছাঁচ বদলে ফেলেছিল।
ঢেলা সরকারি স্কুলে ভর্তি হল। কুসুম তাকে দিতে যায়। আবার নিয়েও আসে। তার জন্য জামা নিজের হাতে সেলাই করে। তাকে স্নান করায়, খাওয়ায় নিজের হাতে।
ঢেলা মায়ের শাসন আর আদর দুই-ই বোঝে। আবার এও বোঝে তার জন্ম আর পাঁচটা বাচ্চার মত নয়। তার বাবা নেই। তাকে গঙ্গার ধার থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিল তার মা। একটা লজ্জা আর কৃতজ্ঞতাবোধ একসঙ্গে কাজ করে ঢেলার মধ্যে। দিন যত যেতে লাগল, ঢেলার লজ্জাটাই বড় তীক্ষ্ম হতে লাগল। কৃতজ্ঞতাটা ভুলতে মানুষের প্রকৃতির বেশি সময় লাগে না। ঢেলারও লাগল না।
======
কুসুম আর তার মেয়ের সম্পর্কটা তেতো হতে শুরু করল। কথায় কথায় ঝাঁঝিয়ে ওঠে ঢেলা। কুসুম কিছু বলে না। সে তো নিজের থেকেই ওকে নিয়ে এসেছিল। কী করবে সে? তবে ভেঙে পড়ার ধাতুতেও তো গড়া না কুসুম। সে জানে স্নেহ, ভালোবাসা সবেরই একটা ঋতু আছে। ফুরিয়ে যায় সময় হলেই। আর ঢেলার কাছে কী চেয়েছে সে? সম্মান? কৃতজ্ঞতা? ভালোবাসা? কিচ্ছু না। ঢেলাকে দেখে যে মায়াটা জন্মেছিল সেটা ছিল খাঁটি। খাঁটি জিনিসে সাড়া দিতে কোনোদিনই বাধা দেয়নি কুসুমের হৃদয়। আজও দিল না, যখন ঢেলা মাত্র তেরো বছর বয়সে ইটভাটার একটা ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেল। একটা চিঠিও না লিখে।
======
গ্রামের লোক এইবার আশা করেছিল কুসুম ভাঙবে। অন্তত এইবার তাদের নাগালে আসবে।
সংসারে দুটো সাধন আছে। এক নিজেকে ঈশ্বর করে তোলার; দুই, নিজেকে ঈশ্বরের কাছে সঁপে দেওয়ার। বেশিরভাগ মানুষই নিজেকে ঈশ্বরের সমকক্ষ করে তুলতে চায়। ক্ষমতায়। অধিকারে। কুসুম চায়নি। কুসুম হাতের কাছে যা আছে তাকেই সত্যি বলে জেনেছে। হাতের বাইরে যা আছে, বা গেছে তা নিয়ে ভাবনা, বা হাপিত্যেশ করা তার স্বভাববিরুদ্ধ।
একদিন কেউ এসে বলল, তোমার ঢেলাকে দেখলাম কলকাতায়। নষ্ট মেয়েছেলের পাড়ায়। ছি ছি!
কুসুম শুনে বলল, ওর ভাগ্য।
কেউ এসে বলল, ভালোই তো আছে, চন্দননগরে, ওর স্বামী লেবারের কাজ করে। ও পাঁচবাড়ি বাসন মাজে।
কুসুম বলেছে, ওর ভাগ্য।
======
কুসুমের বয়েস হল। গ্রামে কুসুমের সময়ের লোকেরা প্রায় অনেকেই নেই। মারা গেছে। শহরে চলে গেছে। কুসুমকে এখন অনেকেই চেনে না, কুসুম হিসাবে। জানে এক বয়স্ক মহিলা, কম কথা বলে, এক পালিতা মেয়ে ছিল, চলে গেছে, আর আসেনি। কুসুম কাজ কম করে। শরীর দেয় না। বাড়িতেই মাটির পুতুল বানায়। রঙ করে। বিক্রি করে। আবার ইচ্ছা না হলে ভেঙেও ফেলে।
গ্রামে যারা এখন প্রায় কুসুমের বয়েসী তাদের মধ্যে ওর জন্যে কেমন ঘৃণামিশ্রিত দরদ। দু'দিন তাকে না দেখলে খোঁজ নেয়। অসুস্থ হলে এর বাড়ি ওর বাড়ি থেকে রান্না করে পাঠায়। কুসুম নেয়। কুসুম আসলকে ফেরায়নি তো কোনোদিনই। সংসার এতদিনে সেটা বুঝেছে হয় তো।
======
কুসুম মারা গেল এক বর্ষার রাতে। গ্রামের হাস্পাতালে। মারা যাওয়ার আগে দু'একবার কার নাম করে যেন ডেকেছিল। নার্স কান পেতে শোনার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এত বৃষ্টির শব্দ যে কানে কিছু আসেনি।
কুসুমের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে যেতে যদি কেউ তাকায়, ভাঙা, ঝোপেঝাড়ে ভর্তি ঘরটার দিকে…. মনটা উদাস হয়ে যায়। কুসুম নেই।
কুসুম যতদিন ছিল, ততদিন কথাটা এত বড় ছিল না যে, সে আছে। কুসুম নেই, এই কথাটা গ্রামে অনেকের বুকে বাজল। তাদের গল্পে কুসুম জন্মালো অন্যভাবে। শ্রদ্ধা বিস্ময় মিশিয়ে। তারা এটুকু বুঝল, কুসুম তাদের উপেক্ষা বা ভালোবাসা কোনোটারই অপেক্ষা করেনি কোনোদিন। এত শক্তি পেলো কী করে মেয়েটা?
কুসুমের গল্প মুখে মুখে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে ছড়ালো। এখন যদি সে গ্রামে যাও, কুসুমের বাড়ি যেখানে ছিল, যেখানে দেখবে এখন চণ্ডীতলা প্রাইমারি স্কুল হয়েছে। কান পাতলে শুনবে কুসুমের গল্প। স্কুলের পাশের বড় হিজলগাছের তলাকে কেউ কেউ বলে, কুসুমতলা। এ ছায়ায় নাকি কুসুম বসে। কেউ বলে সে কাঁদে। কেউ বলে সে উদাস বসে থাকে। কোনটা যে সত্য, কেউ ঠিক করতে পারে না। আজও ঠিক করতে পারল না।
ঢেলা
=====
ঢেলা নষ্টপাড়াতেও যায়নি, গৃহিনীও হয়নি। তার জীবনটা বালিঝড়ের মত কাটল। নিজের মনের বালিঝড়ে নিজেই অন্ধ হল।
নয়ন তাকে প্রথমে এনেছিল গয়ায়। তারপর রাজগীরে। সংসারের প্রথমদিকের গতিতে ছন্দ ছিল। সুখ ছিল। সুখ কাটল ভাগ্য। দু'বার বাচ্চা পেটে নষ্ট হল। ঢেলাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছিল এক বৈষ্ণবী। রাজগীরে তাদের পাশের বাড়িতেই থাকত।
ঢেলা যখন হাসপাতাল থেকে ফিরে জানল নয়ন নেই, এই দশদিনে কেউ দেখেইনি তাকে, ঢেলা বুঝেছিল তার কপাল পুড়েছে।
ঢেলা বুঝল তার ফেরার রাস্তা নেই। কিন্তু বাঁধনও তো নেই। তার ভয় লাগল না। বিষণ্ণ লাগল কদিন। এত ভালোবাসার প্রতিদানে এতবড় বিশ্বাসঘাতকতাতেও সংসারে যে চন্দ্রসূর্য ভেঙে পড়ে না তা জেনে জগতের বিধানের উপর প্রথম আস্থা হারালো। জগতকে নিজের মনের রঙের বাইরে চেনার সেই প্রথম ধাপ। কিন্তু শেষ নয়।
বৈষ্ণবী তাকে সঙ্গে করে তার আশ্রমে গুরুদেবের কাছে নিয়ে আসে। গুরুদেব আশ্রয় দেয় ঢেলার প্রতি করুণায় তত নয়, যতটা বৈষ্ণবীর প্রতি আস্থায়।
কিন্তু ঢেলা তো আশ্রয় চায় না। জীবন চায়। স্বাধীন। স্বপ্নের। যে স্বপ্নকে এরা বলে মোহ। তার মোহ চাই। সে শরীরে মন যত সুস্থ হতে লাগল, অতীতের ঘা যত শুকাতে লাগল, তার রক্তমাংসের শরীরে ভাষা হতে লাগল স্পষ্ট।
বৈষ্ণবী মারা গেল। ঢেলা চলে এলো দিল্লী। তার বিশ্বাস - তার স্বপ্ন, তার আবেগ, তার ক্ষুধার্ত কামনা, এরা তাকে বিভ্রান্ত করলেও, স্থবির করবে না।
একটা হোটেলে কাজ পেল। বাসনমাজার কাজ দিয়ে শুরু। তারপর ঘরদোর পরিষ্কার করা থেকে বাগান দেখা সব। কয়েক বছরের মধ্যে এই হোটেলটাই তার বাড়ি হয়ে উঠল।
======
ঢেলার মায়ের কথা, নয়নের কথা, সব যেন বিচ্ছিন্ন অতীত জীবনের কথা। ঢেলাকে মনে ধরল এক বাঙালি ছেলের। মুর্শিদাবাদে বাড়ি। বাড়ি আছে। যোগাযোগ নেই। সে যায় না। তার নিজের কেউ নেই সেখানে। এখানে একটা রেস্তোরাঁতে রান্না করে। পুরোনো দিল্লীতে।
ছেলেটা তাকে বিয়ে করতে চায়। ঢেলার সব কথা জেনেই। ঢেলাকে নাম দিয়েছে কার্তুজ। বলে সে নাকি কার্তুজের মত বিঁধেছে তার বুকে।
ঢেলা শোনে। কিন্তু প্রাণের মধ্যে সাড়া পায় না। শরীরের ভাষা জগদীশ বোঝে। সাড়া দেয়। সাড়া জাগাতেও পারে। কিন্তু প্রাণের মধ্যে একটা অবিশ্বাস জন্মায়। ভীষণ নিশ্চিত অবিশ্বাস। সে অবিশ্বাসে দুঃখ নেই, আনন্দ নেই। জীবনের পায়ের ছাপ আছে। জগদীশ যত কাছে আসে অবসাদ তত বাড়ে ঢেলার। শরীরের সীমায় সুখ নেই। সুখ তবে কোথায়?
তার মা কুসুম, নয়ন, বৈষ্ণবী, আশ্রম, গুরুদেবের ভালোবাসাহীন আশ্রয়…. সব মিলে তার মনটা যেন বড্ড জট পাকিয়ে। যত ছাড়াতে যায় তত পেকে যায়। ভেবেছিল শরীর সে জট ছাড়াবে। ছাড়ালো কই? এতদিন ছিল বিভ্রান্তির মধ্যে আলোর আশা। এখন অবসাদের মধ্যে বিষাদের অন্ধকার। তার ঘুম পায় অসময়ে।
======
তবু বিয়ে করল জগদীশকে। বছর দুই পরে একটা ছেলেও হল। খরচ বাড়ল। ব্যস্ততা বাড়ল। জগদীশ দূরে গেল মন থেকে। ছেলেটা এলো মন জুড়ে। কিন্তু তাও তার কেন জানি বিশ্বাস হয় না। এও কি বিশ্বাসঘাতক হবে, তার মত? কিন্তু সে অপরাধ তার কার কাছে?
======
ছেলে যত বড় হল, ঢেলা'র অতীত তত বর্তমানের জীবনে ছায়া মেলতে শুরু করল। কে যেন কীসের শোধ তুলতে চায় তার উপর। কেউ যেন চায় না সে সুখী হোক। এমনকি সে নিজেও না। তার বুকের মধ্যে গভীরে তার মায়ের মত হওয়ার যেন এক তীব্র আকাঙ্খা। সে আকাঙ্খা কবে যে এত তীব্র ঈর্ষা বিষে পরিণত হয়ে তার বুকে শিকড় ছড়িয়ে বসে আছে সে জানে না। তার রাগ হয় যখন সে তার অবসাদে ভেঙে পড়ে, যখন ছেলেটার উপর অভিমান হয়। এত দুর্বল কেন সে? তার মা তো ছিল না! ঈর্ষা ছোবল মারে। ঢেলা বুক পেতে বিষ নেয়। গায়ে মাথায় মাখে। তবু মরে না।
======
ঢেলা একবার ঠিক করল তার গ্রামের বাড়ি ফিরবে। কিন্তু ভয় হয়। কীসের ভয় বোঝে না। তবু ভয় তো হয়। নিজেকে নিয়েও ভয় হয়।
তবু এলো। একদিন দুপুরে ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে এলো। স্টেশানে নেমে প্রথমে কিছু চিনতে পারল না। তারপর আলো থেকে অন্ধকার ঘরে ঢুকলে যেমন ধীরে ধীরে দৃষ্টি স্পষ্ট হয়, তারও স্মৃতিপটে মানসদৃষ্টি স্বচ্ছ হল। স্টেশানের পাশে একটা দোকানে চা খেয়ে হাঁটতে শুরু করল।
গ্রামের স্কুলে সেদিন ছুটি। কালীবাড়িতে অন্নকূট। প্রচুর বাইরের লোক গ্রামে। তাদের আলাদা করে চেনার পরিবেশ নেই। তবু ঢেলা ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকিয়ে চলল, নয়নের ভয়। যদি হঠাৎ চোখাচোখি হয়ে যায়। তার ভাঙা সুখের আক্রোশ নেই, এই নিরাপদে ঘেরা জীবনের নেশা হারানোর ভয় আছে। এ নেশা কাটলে সে এত অবসাদ নিয়ে বাঁচবে কোথায়?
হিজলগাছের নীচে এসে বসল। বাবা-ছেলে মন্দিরে গেল ভোগ আনতে। ঢেলা ভাবল কান্না আসুক বুক ছাপিয়ে। এলো না। দীর্ঘশ্বাস পড়ল। বগল চুঁইয়ে ব্যথাটা নামল হাত জুড়ে। টাটাচ্ছে।
বিকেলে ইটভাটায় গেল। শুনেছে এই গঙ্গায় মা পেয়েছিল তাকে। দাঁড়ালো। ইটভাটা নেই। পোড়ো বাড়ি ক'টা আছে। এখানে নাকি বাজ পড়ে সব পুড়েছিল। মদ খেয়ে নাকি মায়ের মন্দিরের সামনে কী বেলেল্লাপনা করেছিল ভাটার মালিকের ছেলে। সে ভাটার মালিকের নাকি অনেক জারজ সন্তান ছিল। সে মালিক মারা যাওয়ার পর তারা সব এসে হুজ্জুতি করে। ভাগ চায়। মামলামোকদ্দমায় ভাটা উঠে যায়।
ঢেলার মনে কাঁটা বিঁধল। তার বাবা কী তবে……
======
ডাক্তার বলল, অনেক দূর ছড়িয়েছে স্তনের ক্যান্সারটা। বাঁচানো যাবে না।
ঢেলা জানত সে সুখী হবে বলে জন্মায়নি। কিন্তু এত প্রতিশোধ কে নিতে চায় তার উপর? জগদীশকে দেখলে মায়া লাগে। ছেলেটাকে দেখলে মনে হয় এত তাড়াতাড়ি সব ছেড়ে যেতে হবে কেন? বড় রুগ্ন হয়েছে ছেলেটা। কেন?
সংসারে যেদিকগুলোয় এতদিন চোখ পড়েনি, এখন সে সব দিকে চোখ পড়তে শুরু করল ঢেলার। বড় অবহেলা করেছে সে সবকিছুকে। মা করেনি। বৈষ্ণবী করেনি। সে করেছে।
জগদীশ কাজ থেকে ফিরে মাথার কাছে বসে। মাথায় হাত বুলায়। ছেলেটা নিজে নিজে ভাত বেড়ে খায়। তাকে খাওয়ায়। স্কুলে যায়। দিনে অনেকটা সময় একা একা শুয়ে থাকে ঢেলা। কী ভাবে। ঘোর লাগে। যেন সে হিজল গাছের ছায়ার নীচে বসে আছে। কেউ কোত্থাও নেই। একটা পোঁটলা করে কেউ, একটা বাচ্চাকে এনে একজন বলছে, নেবে, না গঙ্গায় ফেলে দেব?
ঢেলা বলছে, দাও… আমায় দাও…..
ছেলেটা ডাকল, মা…. কী দেব?
ঢেলা চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে স্কুলের ড্রেস পরে ছেলে দাঁড়িয়ে, ফিরেছে কখন স্কুল থেকে বুঝতে পারেনি ঢেলা। সে দুটো হাত তার গালে ঠেকিয়ে বলেছে, কিছু না বাবা…. যা খেয়ে নে….
======
ঢেলা শেষদিনে ভীষণ শান্ত ছিল। তার মনে হয়েছিল ভাগ্যের যা যা প্রতিশোধ তার উপর নেওয়ার, সবটাই নেওয়া হয়ে গিয়েছে। এবার সে যাবে। কিন্তু কার কাছে যাবে? মায়ের কাছে, না বৈষ্ণবীর কাছে?
ঢেলার মনে হল সে যেন হিজল গাছের ছায়ায় বসে। তার পায়ের কাছে এসে ঠেকছে গঙ্গা। বলছে চল, চল।
ঢেলা সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে, ওপারে কে যেন দাঁড়িয়ে, তার মা কুসুম, না বৈষ্ণবী?
বৈষ্ণবী
======
বৈষ্ণবী একদিন ছিল মেয়ে। মাছের বাজারে যেত। মাছ বিক্রি করত। বাবা নেই। মা থেকেও নেই।
একদিন এক ভিখারি এসে দাঁড়ালো। ভিক্ষা করতে। মাছ বাজারে। বড় বেমানান। কিন্তু এই বেমানান ছবিটাই সেদিনের মেছুনীকে বৈষ্ণবী করে তুলল। বৈষ্ণবীর প্রাণে জন্মালো কৃষ্ণপ্রেমের আগুন। সে আগুন আপনিই তাপিয়ে তোলে। মেঘ করে আনে। বৃষ্টি ঢালে। শান্ত করে শীতল করে।
======
বৈষ্ণবী, মানে সন্ধ্যা, সেদিন মাছ বাজার থেকে ফিরে এসে সাইকেলটা নিয়ে খুঁজতে বেরোলো সে ভিখারিকে। বেশি খুঁজতে হল না। স্টেশানের পাশে একটা অশ্বত্থগাছের তলায় বসে। সন্ধ্যা সাইকেল থেকে নেমে জিজ্ঞাসা করল, তুমি মাছ খাও?
ভিখারি বলল, না তো মা। কেন?
তবে যে মাছ বাজারে দাঁড়িয়েছিলে গিয়ে? সেখানে তো কোনোদিন বৈষ্ণব কাউকে যেতে দেখি না….
ভিখারি হাসল। বলল, ভিখারির অত বাছবিচার করলে চলে? তোমাকে দেখলাম না মাছ বিক্রি করতে?
সন্ধ্যা আশা করেনি ভিখারি তাকে চিনবে। কিন্তু আবার আশাও করেছিল। কিন্তু যেই সে বলল, তাকে তার মনে আছে, সন্ধ্যার মনে হল, তবে কী এও আর পাঁচটা পুরুষের মত? শরীরে আঁশটে গন্ধ পায়?
ভিখারি তার চোখের দিকে তাকিয়ে। লজ্জা পেল সন্ধ্যা। এমন নিষ্পাপ চোখ দেখেনি তো সে। তাই দৌড়ে এসেছে। দেখতে। স্বাদ পেতে। রাস্তা পেতে।
======
ক্রমে সন্ধ্যা সে বৈষ্ণব ভিখারির আখড়াও যাওয়া শুরু করল। সন্ধ্যাকে আটকানোর মত সংসারে কেউ ছিল না, আবার উৎসাহ দেওয়ার মতও কেউ ছিল, এমন না। সন্ধ্যা মজতে শুরু করল। এ এক অদ্ভুত রস। এ জগতের ভেতরেই যে এমন একটা জগতের রাস্তা আছে সন্ধ্যা জানত কী? নাকি জানত? নইলে সব আপনা লাগে কেন?
সাধন নিল সন্ধ্যা। সংসার ছাড়ল। বৃন্দাবন এলো। গুরুদেবের সন্ধান দিয়েছিল সে ভিখারি বৈষ্ণবই। বৃন্দাবনে এসে দীক্ষা শিক্ষা দুইই হল।
======
বৈষ্ণবীর রূপ ছিল। যৌবন ছিল। সাধন ছিল। তার প্রাণে কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। কিন্তু কোথাও জীবনের স্বাদের উপর একটা কৌতুহল তো ছিলই। নইলে অমৃত'র চোখে চোখ আটকাবে কেন?
বাইরে থেকে কেউ বোঝেনি। বুঝেছিল অমৃত আর সে। তারা বাঁধা পড়ছে। অমৃতের ফুলের ব্যবসা। তাদের আশ্রমে আসত ফুল দিতে। সে না এলে বৈষ্ণবীর মন উতলা হত। একা হত। সাধন এলোমেলো হত। বেলা যত বাড়ত ক্ষুব্ধ হত।
একদিন সন্ধ্যেবেলা ফিরছে বৈষ্ণবী। ফাঁকা রাস্তা। শীতের দিন। কুয়াশা ঘেরা চারদিক। হঠাৎ রাস্তা আটকে দাঁড়ালো অমৃত। বৈষ্ণবীর শ্বাস দ্রুত হল। যে পাখি দীর্ঘদিন খাঁচায় আটকে, তার খোলা দরজা দেখলে প্রথমেই জম্মায় ভয়। যে ভয়কে ভয় পেয়ে দূরে সরার ক্ষমতাও নেই, আবার তাকে সরিয়ে খোলা আকাশকে আলিঙ্গন করতেও বাধা।
বৈষ্ণবীকে জড়িয়ে ধরল অমৃত। অমৃতের সোয়েটারে ফুলের গন্ধ। অমৃতের কাছে অবশ হয়ে আসছে শরীর। কিন্তু আত্মা? সে তো সাড়া দিচ্ছে না! সে তো মেঘের আড়ালে চাঁদের মত ঢেকে যাচ্ছে তার সব কিছুকে অন্ধকার করে। তবে? ততক্ষণে অমৃতের দুটো ঠোঁট চেপে বসেছে তার কৃষ্ণনামামৃতে ডোবা ঠোঁটে।
হঠাৎ ভীষণ শান্ত হয়ে গেল বৈষ্ণবী। মেঘ সরে চাঁদ উঠল আকাশে। পূর্ণচন্দ্র। এই সুখ! এইটুকু! শুধু এই! তার চোখের কোল বেয়ে জল নামল। অপেক্ষা করল চুম্বনের শেষ ধাপ অবধি। অমৃতের হাতটা সরালো তার বুকের উপর থেকে। শান্ত চোখে অমৃতের দিকে তাকিয়ে বলল, দোষ আমারই…. আমি ভুল বোঝার সুযোগ দিয়েছি।
======
গুরুদেব নিষেধ করলেন না। শুধু বললেন, একা মেয়েদের সংসারে থাকা অসুবিধা অনেক। কিন্তু বৈষ্ণবী চায় এখান থেকে যেতে। কোনো আশ্রমে না। একা থাকতে।
গুরুদেব শুনলেন না। রাজগীরে এক গৃহস্থের বাড়ি পাঠালেন। তাদের বাড়িতে কেউ নেই। গোবিন্দসেবার অসুবিধা। সেবার দায়িত্ব নিয়েই বৈষ্ণবী এলো রাজগীরে।
আমাদের গল্পের ঢেলা যখন রাজগীরে এসে পৌঁছেছে ততদিনে বৈষ্ণবীর জীবনের ছত্রিশটা দোলপূর্ণিমা উৎসব পেরিয়ে গেছে। বৈষ্ণবী পোড় খেতে খেতে শিখেছে সংসারে কোন রঙ পাকা আর কোন রঙ কাঁচা। সংসার এক নাটক। সে নাটকীয়তার কেন্দ্রে আছে নাটকের চালক, তার চরণে সবটা সঁপে দিয়ে বলেছে, মানুষের দোষগুণের বিচার যেন আমার মনে না আসে গোবিন্দ। তোমার জ্যোতিতে ঢাকা পড়ে যায় যেন সব।
গোবিন্দ শুনেছেন। তাই ঢেলা যখন স্বামী পরিত্যক্ত, গর্ভমৃত সন্তানের মা হয়ে ঘরে ফিরল, বৈষ্ণবী তাকে গোবিন্দের কাছে আনতে চেয়েছিল। কিন্তু কোথাও জানত, এ আসা ক্ষণিকের। তার মনে এখনও অনেক কাঁচা রঙের মজুত। কাঁদবে কাঁদাবে অনেক। নইলে সংসারের কোটা পূর্ণ হবে না যে!
বৈষ্ণবীর মৃত্যু হল আচমকা। স্নান সেরে চন্দন বাটতে বাটতে ঢলে পড়ল মাটিতে। চন্দনের বাটি গেল উলটে। সারা কপালে লাগল চন্দন। সবাই বলল, প্রভু নিজের হাতে সাজিয়ে নিলেন আজ নিজের সেবিকাকে। নিজের ঘরে নিলেন।
ঢেলা অদূরে দাঁড়িয়ে প্রথমেই দেখল খোলা দরজা। এই সুযোগ। পালাবার। বাঁচার।
[15 June 2024]