প্রভু, এসো, এসো, এসো।
এই তো এসেছে বৃষ্টি। তুমি এসো।
প্রাণ জুড়ালো সজল হাওয়ায়।
আমার আত্মা জুড়াক করুণায় তোমার।
এসো, এসো, এসো।
দেখো ছোটো ছোটো ঘাস, সেও ভিজছে
নদী, পাহাড় সমুদ্রের আর কি কথা!
আমার এ ক্ষুদ্র হৃদয়
ওগো প্রিয়, বঞ্চিত কোরো না
এসো এসো এসো…
আমার পায়ে অজ্ঞানের বেড়ি
ওগো জ্ঞানময়
প্রেমাঞ্জনে দেখো, আমায় প্রেমাঞ্জনে দেখো
ত্র্যম্বকেশ্বর মন্দিরের মাথায় মেঘ জমেছে। রামভক্ত কালীকেয় এই কবিতাটা বসে বসে রচনা করেছে। এত বৃষ্টিতে বেরোবে কি করে? অল্প অল্প সুর বানাতে পারে কালীকেয়। সেই সুর দিয়ে পদটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইছে। বৃষ্টি থামলে সে ফিরবে তার ইষ্টের কাছে, কালারাম মন্দিরে।
=====
কালীকেয় অনাথ। দু’বার অনাথ হয়েছে সে। একবার জন্মানোর কিছুদিন পরেই যখন বাবা-মা একসঙ্গে মারা গেল, বাজ পড়ে, ক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে। আরেকবার যে সাধু তার ভার নিয়েছিল, সেই আঞ্জনীবাবার দেহাবসানের পর।
কালীকেয়র বয়েস এখন কত কালীকেয় নিজেই জানে না। হিসাবও রাখে না। নিজেকে নি:সঙ্গ মনে হয় না। আবার সবার সঙ্গে খুব একটা ওঠাবসাও হয় না। কালীকেয় মন্দির ঝাঁট দেয়, মন্দিরের বাইরে ফুল-মালা বিক্রি করে। গোটা সংসার কালীকেয়কে নিয়ে মাথা ঘামায় না, কালীকেয়ও সংসারকে নিয়ে মাথা ঘামায় না। মানে এতদিন ঘামাত না। আজ কি হল যে, সে ত্র্যম্বকেশ্বর মন্দিরে এসেছে, এতটা রাস্তা হেঁটে?
======
কালীকেয় মন্দিরের জন্য ফুল তুলে, স্নান করতে নেমেছে এক বড় দীঘিতে। তার মনে হল, কেউ যেন তাকে ডাকল।
জলে ডুবেই ফিরে তাকালো। এক মেয়ে। পাড়ে রাখা ফুলের দিকে ইঙ্গিত করে বলছে, এ ফুল সব তোমার?
কালীকেয় যেন বলতে চাইল অন্য কিছু। মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ আমার।
মেয়েটা জিজ্ঞাসা করল, আমি নেব? একটা?
আবার কালীকেয় কি যে বলতে গেল, কিন্তু বলে ফেলল, না।
======
সেদিন মন্দিরে মালা গেঁথে প্রতিদিনের মত এসেছে কালীকেয়। কিন্তু দেখল বিগ্রহের গায়ে ইতিমধ্যেই অনেক মালা। কে আনল? পুরোহিতরা বলতে পারল না। তার মালা হল বাড়তি। মন্দিরের এদিক ওদিক সাজানোর কাজে লাগল।
কালীকেয় প্রভুকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কেন অপ্রসন্ন হলে? কি করলাম আমি?
প্রভু উত্তর দিল না।
=======
কালীকেয় ফিরছে বাড়ি। প্রচণ্ড মেঘ করে এসেছে। বৃষ্টি নামল বলে। বড় রাস্তা বদলে সরু রাস্তা ধরল। সেদিকে বাড়ির ছায়া আছে অনেক।
কালীকেয় ফিরছে। হঠাৎ মনে হল তার নাম ধরে ডাকছে কেউ। তাকালো কালীকেয়। একটা ছোটো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সেই মেয়েটা। বলল, উঠে এসো, ভিজছ তো!
কালীকেয় অবাক হল। তাকে কেউ খেয়াল করে? সত্যিই তো ভিজেছে সে। আপাদমস্তক ভিজেছে। কখন হল এত বৃষ্টি! কি যেন একটা বলতে চাইল। কিন্তু বলা হল না। এগিয়ে এলো বৃষ্টির চাদর ঝাপসা দূরত্বে। কেউ দেখতে পেল না কাউকে। কিন্তু কালীকেয়র মনে হল সে দাঁড়িয়ে আছে এখনও বাড়ির সামনে, ঢাকা বারান্দায়।
কালীকেয় বাড়ি ফিরল। দেখল ছাদের চার জায়গায় ধরেছে ফাটল। সারা ঘর গেছে ভেসে। কি এমন ছিল ঘরে? তবু কান্না পেল কালীকেয়র। পাশের বাড়ির লোক বলল হনুমান এসেছিল চারটে। তারাই ছিঁড়ে গেছে তার খড়ের চাল। কিন্তু কেন? প্রভু, কেন?
======
একদিন পূর্ণিমা। কালীকেয় গিয়েছিল শিরডি। অনেকটা রাস্তা। ফিরতে ফিরতে হয়েছে অনেক রাত। বড় রাস্তায় লোক নেই প্রায়। চাঁদের আলো রাস্তার উপর পড়ে আছে যেন দুধের সর।
কালীকেয় হাঁটছে। ক্লান্ত অবসন্ন পা। হঠাৎ দেখল সেই মেয়েটাকে। অনেক সেজেগুজে দাঁড়িয়ে রাস্তার ধারে। এদিক ওদিক আরো কয়েকজন মেয়ে। তারা অন্যরকম। মেয়েটা ডাকল না তাকে। মাথা নীচু করল।
কালীকেয় কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। তার হাতে একটা ফল, আর কিছু ফুল দিয়ে বলল, এই নাও, সাঁইয়ের প্রসাদ। আজ গিয়েছিলাম শিরডি। আসি তবে।
কালীকেয় বন্ধ মন্দিরের বাইরে দাঁড়িয়ে প্রভু রামচন্দ্রকে প্রণাম করে এগোতে যাবে বাড়ির দিকে। হঠাৎ শুনল নূপুরের আওয়াজ। এত রাতে মন্দিরের ভিতরে নূপুর পায়ে কে? কালীকেয় দরজার গায়ে কান পাতল। কোনো আওয়াজ নেই। এবার রাস্তা থেকে যেন এলো আওয়াজটা।
কালীকেয় বাড়ির দিকে হাঁটল। নূপুরের শব্দ কখনও তার সামনে, কখনও পিছনে। এমন ধবধবে জ্যোৎস্না, অথচ কাউকে তো দেখা যায় না।
বাড়ি ঢুকল। দেখল একটা মাটির সরায় কেউ পায়েস আর দুটো বড় লাড্ডু, আর দুটো আম রেখে গেছে। কে রাখল?
পরেরদিন পাশের বাড়ি জিজ্ঞাসা করল। তারা বলল, কেউ যেন এসেছিল। তার গায়ের গন্ধ কি স্নিগ্ধ। তার পায়ের নূপুরের আওয়াজ কি মিষ্টি।
কালীকেয় বলল, দেখো তো এই রকম সৌরভ কি? এই বলে সে একগুচ্ছ ফুল এগিয়ে দিল।
তারা বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, এই তো এই তো।
কালীকেয় বলল, আচ্ছা।
মনে জানল, এ সুবাস তো চন্দনের। যে চন্দন সে মালায় মাখায়।
=======
দিন যায়। মাস যায়। আর সে মেয়েটাকে দেখে না কালীকেয়। তার বাড়ির সামনে দিয়েও গেল কতবার। দরজা বন্ধ। কাউকে জিজ্ঞাসা করতে সঙ্কোচ।
একদিন দেখল সে বাড়ির জানলা খোলা। ভিতর থেকে আসছে নূপুরের আওয়াজ।
সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠে দরজায় দাঁড়িয়ে কালীকেয় জিজ্ঞাসা করতে চাইছিল না, এতদিন কোথায় ছিলে?
তবু জিজ্ঞাসা করল। কিন্তু এ তো সে নয়?
সে কোথায় তবে?
অম্বা? সে তো মারা গেছে কতদিন হল। তার হল জ্বর। সারলই না। বুকের উপর সাঁইয়ের ফুল নিয়ে গেল মারা। সে ফুল সে এক মুহূর্ত করেনি কাছ ছাড়া। কে যেন তার ভীষণ আপন, সে এনে দিয়েছে সে ফুল। তুমি কি সেই?
কালীকেয় চায়নি, তবু তার গাল গড়িয়ে নামছে জলের ধারা।
বাড়ি ফিরল। বেরোলো না কতদিন। খেল না কিছু। সে মেয়ে একদিন স্বপ্নে এসে বলল, তুমি এসো ত্র্যম্বকেশ্বর মন্দিরে। আমি অপেক্ষায় আছি।
=======
বেলা হল। মন্দির থেকে তাকে প্রসাদ নেওয়ার জন্য বলে গেল। সে বলল, না। আমার এক ব্রত আছে।
প্রধান পুরোহিত, অনেক বয়েস, বলল, বেশ, আজ এ দুর্যোগে ফিরতে হবে না। রাতটুকু থাকো আমার বাড়ি।
কালীকেয় বলল, বেশ।
রাত অনেক। পুরোহিত আর কালীকেয় বসে মুখোমুখি। পাশে মাটির প্রদীপ, সজল হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। সিংহাসন থেকে প্রভু শ্রীরামচন্দ্রের মূর্তির গায়ে লেপিত চন্দনের সুবাস আসছে। পুরোহিত তাকে শোনালো জ্ঞানেশ্বরীর ব্যাখ্যা। কালীকেয় শোনালো তার রচিত পদ।
পুরোহিতের আহারের সময় হল। কালীকেয়কে আমন্ত্রণ জানানো হল আহারের, সে বলল, আমার ব্রত আছে।
পুরোহিত বলল, আমি তোমার পিতার মত। কি এমন ব্রত আছে আমায় জানাতে পারো। বলো।
কালীকেয়র মনে হল তার কথা এমনভাবে তো শুনতে চায়নি কেউ কোনোদিন। মন নরম হল। চোখে জল এলো। কালীকেয় অম্বার সব ঘটনা বলল পুরোহিতকে।
পুরোহিত নি:শব্দে সবটা শুনলেন। তারপর উঠে গিয়ে খানিকবাদেই একটা ছবি এনে বললেন, এই কি সে?
কালীকেয় চমকে গেল। একটা আঁকা ছবি। এই তো অম্বা। অল্প বয়েসের ছবি, কিন্তু চোখ আর নাক দেখেই চেনা যায়, সে-ই তো। কিন্তু আপনার কাছে?
=======
অম্বা ভীষণ মেধাবী ছিল। সংস্কৃত শ্লোক আবৃত্তি করত যেন মধু মাখানো মিছরি দানা।
কিন্তু কপালের দুর্ভোগ। এক লম্পট পুরুষকে দিয়ে বসল সে হৃদয়। সে ছিল ব্যবসায়ী। পুণের ওদিকে নিবাস। ব্যবসার কাজে আসত এদিকে। মন্দিরে পুজো দিত। তার কুনজর পড়ল অম্বার দিকে। ক্রমে অম্বার মন দুর্বল হল। বিয়েতে ছিল সমাজের বাধা। তাই তারা পালালো একদিন।
পুরোহিত অভিমানে নাওয়া খাওয়া ছাড়লেন। মা ছিল না মেয়ের। তাই নিজেই মা আর বাবার কাজ একই সঙ্গে করেছেন। সবাই বলল, বাবা বোধহয় আর থাকল না এই মরলোকে।
কিন্তু যা ভাবা হয় তার কতটাই বা সত্যি হয়। পুরোহিত নিজের মনকে ক্রমে প্রবোধ দিয়ে আবার প্রভু মহাদেবের সেবায় লাগলেন। শ্রীরাম তার ইষ্ট, সে সেবাতেও হল না আর কোনো ত্রুটি। সবই চলছিল, হঠাৎ জানলেন তার মেয়েকে জামাই ছেড়ে গেছে দীর্ঘদিন হল, তাকে বিক্রি করেছে খারাপ পাড়ায়।
পুরোহিত সমস্ত জগত শূন্যময় দেখলেন। এত বড় অন্যায় তারই সঙ্গে কেন? তিনি তো জ্ঞানত কোনো পাপ করেননি। তবে?
পুরোহিত মেয়ের সঙ্গে অনেকভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেন, পারলেন না। সামাজিক লজ্জা তো আছেই, তাছাড়া মেয়েও আর চায় না।
======
পুরোহিতের সমস্ত মন গোটা সংসারে উদাস হয়ে গেল। চরম বৈরাগ্যে শুধু মন্দিরের প্রভুর সেবা ছাড়া সব দিক থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন।
আজ যখন কালীকেয়র মুখে সবটা শুনলেন, এতদিনের সমস্ত দরদ, স্নেহ উপচে এসে হৃদয়ের যন্ত্রটা চেপে ধরল। পুরোহিত কালীকেয়র কোলে মাথা রেখে শেষ শ্বাসটুকু সম্বল করে বললেন, তবে সে প্রভুর আশ্রয় ছাড়া হয়নি….
কালীকেয়, বলল, না না এক মুহূর্তের জন্য সে প্রভুর কাছ ছাড়া হয়নি… বরং তাকে দূরে ঠেলতে গিয়ে আমিই হয়েছি প্রভুর বিরাগভাজন।
সে কথা পুরোহিতের কানে গেল কি গেল না কালীকেয় বুঝতে পারল না। কালীকেয় শুধু পুরোহিতের ডানহাতের আঙুলের ফাঁকে আটকে থাকা অম্বার ছবিটা নিয়ে একবার বুকে ঠেকালো, বলল প্রভুর কৃপায়, প্রভুর আঙিনায় মিলন হবে আমাদের।
আকাশে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। কালীকেয়র মনে হল অম্বা যেন এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। কালীকেয় ডাকল, অম্বা!
মনে হল বৃষ্টির শব্দে নূপুর বেজে উঠল কোথাও, অদূরে।