কোনো এক দেশে, কোনো এক কালে এক হতদরিদ্র ভিখারি বাস করত। একদিন সে রাস্তা দিয়ে একা একা যাচ্ছে, এক গ্রামে ভিক্ষা সেরে আরেক গ্রামের দিকে, হঠাৎ চোখে পড়ল একখণ্ড হীরার টুকরো। রাস্তার এক পাশে পড়ে। কী তার ঔজ্জ্বল্য! দুপুরের সূর্যের আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে তার দ্যুতিতে।
সে দৌড়ে গিয়ে, কিছু না ভেবেই হীরেটা হাতে তুলে নিল। ভালো করে দেখল চারদিকে। সুনসান রাস্তা। কেউ দেখেনি তাকে। কিন্তু রাখবে কোথায়? তার সঙ্গে তো কিছুই নেই। কোমরে লজ্জা নিবারণের জন্য এক খণ্ড কাপড়, সেও শতচ্ছিন্ন। তবে?
হাতের মুঠোয় নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। দরদর করে ঘামছে। বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে। রাখবে কোথায়? লুকাবেই বা কোথায়? কী করবে সে?
কিছুটা গিয়ে সে চিন্তার ভারে রাস্তায় বসে পড়ল। দুই হাত মাটিতে রেখে, হীরাটা ধরেই মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে বলল, কী সংকটে পড়লাম গো ঠাকুর! যদি একে রেখে যাই মনে কষ্ট হয়। যদি নিয়ে যাই মনে ভয় হয়। যদি কেউ কেড়ে নেয় তবেও তো ভারী কষ্ট হবে। কী করব ঠাকুর?
কোনো উত্তর এলো না।
সে হীরাটা মাঝরাস্তায় রেখে, রাস্তার পাশে একটা আমগাছের তলায় বসল। চারদিকে খাঁ খাঁ করছে রোদ। রাস্তায় কুকুরটা অবধি নেই। তবু ওটা থাক রাস্তায়। কেউ আসুক। যদি তার না হয় তবে যে নিয়ে যাবে তারই না হয় হবে! সে মেনে নেবে।
দেখতে দেখতে এক ঘন্টা পার হয়ে গেল। কেউ এলো না। গরমে, ক্লান্তিতে, উৎকণ্ঠায় তার চোখ লেগে এলো। এমন সময় হঠাৎ শুনতে পেল কোলাহল। একদল মানুষ আসছে রাস্তা দিয়ে, গান গাইতে গাইতে। তার বুকের মধ্যে হাপর পিটতে লাগল। কী হবে? সে কাতর কণ্ঠে বলল, প্রভু আমার, রাস্তায় রেখে দিয়েছি, তুমি যাকে দেওয়ার দাও, আমার সামনেই দাও। আমি তোমার বিধান মাথা পেতে নেব। কষ্ট হলেও নেব।
কী আশ্চর্য! সে পথিকের দল আসার প্রাক্কালেই উঠল তুমুল ধুলো ঝড়। ধুলোয় ধুলোয় চারদিক ঢেকে গেল। পথিকরা উদভ্রান্তের মত দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিল। দেখতে দেখতে তারা চলেও গেল। সে উঠে দাঁড়ালো চরম উদ্বেগে। হীরেটা খুঁজতে গেল। কিন্তু হীরে কই? এ তো ধুলোর মণ্ড! হাতে তুলে নিল।
এমন সময় মেঘমন্দ্রিত স্বরে আকাশবাণী হল - আজ থেকে এ হীরা এমনই ধুলোর মণ্ড হয়ে থাকবে। সবাই জানবে এ ধুলোর তাল। তুই জানবি শুধু এ হীরার খণ্ড। এর ধুলো সরবে একমাত্র তোর চোখের জলে। যেদিন দেখতে চাইবি, চোখের জলে ধুয়ে দেখে নিস!
সে লুটিয়ে পড়ল রাস্তায়। বলল, ধন্য, ধন্য হলাম প্রভু!