Skip to main content

 

বামুনের ঘরে জন্মেছি, গণেশ পুজো নতুন দেখছি এ তো বলতে পারি না। বাড়িতে কোনো অসুবিধা থাকলেই পুজোর ভার এসে পড়েছে। করেছি। ঠাকুর্দা শিখিয়েছেন সব পুজোর আগে গণেশ পুজো করতে হয়। ঠাকুমা তার কারণ হিসাবে পৌরাণিক গল্প বলেছেন। শুনেছি এবং করেওছি। তদ্দিন বাড়িতে লক্ষ্মী, সরস্বতী পুজো করেছি যদ্দিন না মনে হয়েছে এসব পুজো-আচ্চা করলে লোকে নন-ইন্টেলেকচুয়াল বলে। যা হোক সে সব পুজো-আচ্চার পাট চুকিয়ে ইন্টেলেকচুয়াল সেজেছি। তখন কলেজে পড়ি। বাংলার বাতাসে তখন ধর্ম, ঈশ্বর ইত্যাদি নিয়ে ফুৎকারে সব উড়িয়ে আলোচনা করা, খিল্লি করা অবশ্য কর্তব্য। এবং বাঙালি ছাড়া বাকি উত্তরভারতের লোকেরা যে একদম মনুষ্যপদবাচ্যই নয়, তাদের ওইসব টাকাপয়সা ছাড়া কোনো উন্নতিই হয়নি, সে নিয়েও কোনো সংশয় রাখার দরকার মনে করিনি। বাঙালিই একমাত্র অস্কার, গ্র‍্যামি, নোবেল শোভিত, পাতে দেওয়ার মত প্রাণী। বাকি সব এলেবেলে। অনেকটা সেই আমাদের পৌরাণিক গল্পের মত, ব্রহ্মার কোথা থেকে কোন বর্ণ জন্মেছে-টন্মেছে আর কী। বাঙালি অবশ্যই সর্বোচ্চ মার্গীয় সেখানে।

এরপর মোহভঙ্গের পালা শুরু হল। বুঝলাম বাতাসে যা ভেসে বেড়ায় তার চাইতে অনেক দামী সত্য মাটির তলায় চাপা পড়ে থাকে। অবহেলার আকরিকে মিশে। বুঝলাম পুরাণ মানে মিথ্যাও না সত্যিও না। ইতিহাস ঐতিহাসিকের ছায়া ছাড়া হয় না। এবং বাঙালি কয়েকটা ব্যতিক্রমী চরিত্র জন্ম দিলেও গোটা ভারত থেকে খুব আলাদা কিছু না। সেইসব রথীমহারথীদের সেদিনের বাঙালি সমাজের সঙ্গেই বিরোধ বেধেছিল সব চাইতে বেশি। অপমানিত, লাঞ্ছিত হয়েছে সেদিনের বাঙালিদের থেকেই সব চাইতে বেশি। তবু কিছু ক্ষেত্রে সুবিধা ছিল। ইংরেজের রাজধানী হওয়ার সুবাদে, ইংরেজি শিক্ষার অনেক আগে প্রচলন ইত্যাদি ইত্যাদি এইসবের কারণে কিছুটা সুবিধাপ্রাপ্ত ছিল। রবীন্দ্রনাথের ভাষণে যেমন জানা যায় তার সময়েও বাঙালির ইংরেজিপ্রীতি বাংলাকে তুচ্ছজ্ঞানের কারণ ঘটিয়েছিল। এবং বঙ্কিমের পর থেকে বাংলা ভাষা যে ডালপালা মেলল, তার সুবাদেই বাংলা ভাষার সুদিন সেদিন ফিরেছিল।

ইদানীং বাঙালি যেভাবে বাংলাকে অপমান করে তা নিয়ে ভাষাটার উপর ভালোবাসা থাকলে লজ্জা পাওয়া আর দুঃখ পাওয়া ছাড়া আর কীই বা করার আছে। আমাকে কেউ যখন জিজ্ঞাসা করে বাচ্চাটাকে কী মিডিয়ামে পড়াব, আমি তো নির্দ্বিধায় ইংরেজি মিডিয়াম বলেই ক্ষান্ত হই না, সিবিএসই বা আইসিএসই বোর্ডের দিকে ঝুঁকেও কথা বলি। বাস্তবের দিকে তাকিয়ে নিজের ইচ্ছা, আদর্শর ডানা ছাঁটার ঘটনা ছাড়া আর কী এটা!

কিন্তু এই যে গণেশ পুজোর হিড়িক উঠেছে চারদিকে, একে কী বলব? আসলে বাঙালির ভাষার আর জীবনশৈলীর টোনটা বদলে যাচ্ছে ভীষণ দ্রুত। উচ্চারিত শব্দ মিশ্রিত বাংলা। টোন আর ভাবটা বাংলার মত না। বাঙালির মত না। প্রশ্ন হবে বাঙালি বলে কোনো ধ্রুব, অচলায়তন তো নেই। তবে? পরিবর্তন হবে না?

পরিবর্তন আর ভোলবদলের মধ্যে একটা মূলগত পার্থক্য থাকে। পরিবর্তনে ভিত্তিগত কাঠামোটা একই থাকে। তাকে কেন্দ্র করে যুগোপযোগী বদল আসে। আর ভোলবদলে সবটাই বদলে যায়। বাঙালির যে পরিবর্তনটা চোখে পড়ছে তা হল ওই যে বললাম, একটা টোনাল পরিবর্তন হচ্ছে।

তার হয় তো একটা কারণ আছে। বাঙালির জাত্যাভিমান অস্কার, নোবেল, গ্র‍্যামির চক্করে, এবং আরো ক্ষণজন্মা নারীপুরুষদের আলোতে অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছিল। সময় বদলালো। ক্রমে সে ছটার আলো দুর্বল হতে শুরু করল। বাঙালি হঠাৎ খেয়াল করল, তার ইন্টেলেকচুয়াল ইমেজটা আর হাটে বিকোচ্ছে না। ইতিমধ্যে লক্ষ্মীর দিক থেকেও অনুগ্রহ পাওয়ার সাধনায় সে অনেক পিছিয়ে। তখন তার ক্ষণে ক্ষণে অভিমান হওয়া শুরু হল। সবাই তাকে বঞ্চিত করছে, অপমান করছে ইত্যাদি। সে সবের মধ্যে যে একদমই সত্য ছিল না, তা নয়। কিন্তু বাস্তবের চেয়ে অভিমান বেশি লাগত। লাগার যুক্তিসঙ্গত কারণও ছিল। যে চিরকালের হাভাতে তার সংবেদনশীলতাটা অত তীক্ষ্ম হয় না। কিন্তু যার এককালে সত্যিই কিছু ছিল, তার নিজের দৈন্যদশাটা বড় তীক্ষ্ম হয়ে বেঁধে।

তবে আজকের বাঙালি সমাজের সামনে আদর্শ কী? তার রোলমডেল কী? তার লক্ষ্য কী? তার উপজীব্য কী? তার নীতি কী?

অর্থ, মেধা আর সৃষ্টিশীলতায় সব দিকে সে যখন মধ্যমের দলে এসে পড়েছে, কিম্বা আরেকটু পিছিয়ে, তখন সে নিজেকে স্বীকার করবে কোন প্রতিশ্রুতিতে? রাজনীতিতে, সমাজে, শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে তার শতছিদ্র নৌকা। এদিক ঠেকাতে ওদিক দিয়ে জল ঢুকে পড়ছে। বাঙালি নিজেকে কী দিয়ে আশ্বস্ত করবে? বর্তমানকে সে সহ্য করছে নিরুপায় হয়ে, ভবিষ্যৎ লটারির টিকিটের মত অসম্ভব দোলাচালে। তবে? তার অতীত ভাঙা রাজবাড়ির মত গৌরব হারিয়ে অসহায় তার মুখের দিকে তাকিয়ে। তার ভবিষ্যৎ শতধারায় ছিন্নভিন্ন হয়ে অনিশ্চয়তার ধুলোয় ঢাকা পড়ে আছে।

এ দিন হয় তো কাটবে। একটা জাত শুধু নস্টালজিয়াকে সম্বল করে তো বাঁচতে পারে না। শুধু অতীতের গৌরবময় সময়ের নকল পুনরাবৃত্তি করেও বাঁচতে পারে না। রাস্তা তো বেরোবেই আজ না হয় কাল। কিন্তু সে রাস্তা কোন পথে বেরোবে?

মানুষ যা কিছু খাঁটি পায় তা সত্যের মধ্যে দিয়েই পায়। বাঙালিকে নিজেকে খুঁজে বার করতে হবে নিজের সত্যের মধ্যে। যে সত্য রাজনৈতিক মতাদর্শে না, রবীন্দ্রনাথের মত কোনো কৃতী মহাপুরুষের কর্মকাণ্ডে না। যে সত্য এ দেশের মাটির সঙ্গে তার প্রাচীনকালের যোগসূত্রের মধ্যে রয়ে আছে, সেই সূত্রে। আমার পরিবারের সঙ্গে আমার সত্য সম্পর্ক যেমন আমার পরিবারের শুধু কয়েকজন কৃতী মানুষের গৌরবছটাতেই নেই, অতীতের অতীতে সে বিস্তৃত, এও তেমন। অর্জুন যখন দুর্বল হয়ে নিজের পায়ের তলার মাটি হারিয়েছিল, শ্রীকৃষ্ণ তখন তাকে শুধু সামাজিক কর্তব্য না, তার আত্মিক পরিচয় গোটা সৃষ্টির সঙ্গে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। সেই পরিচয়ের আলোতেই অর্জুন নিজের প্রতি হৃতবিশ্বাস ফিরে পেয়েছিল।

আমাদের সত্য হতে হবে। সে সত্য শুধু নিজের মধ্যে নিজেকে নিয়ে নয়, অনুকরণের মাধ্যমেও নয়। সে একমাত্র নিজের সঙ্গে এ মাটির যোগসূত্রটা আবার খুঁজে পেয়ে। গাছের সত্য যেমন তার শিকড়ে থাকে, ঠিক তেমন। বাইরে থেকে পরিচর্যা করে, বাইরে থেকে নকল সাজে সাজিয়ে কোনো সার্থকতা নেই। শিকড়টাকে আবার খুঁচিয়ে তাকে সজীব করতে হবে। আলো বাতাসের সামনে আনতে হবে। তবেই বাঁচব শুধু না, সার্থকতার সঙ্গে বাঁচব। এ কাজের জন্য ধৈর্য লাগে। আপাত লাভের লোভ ছাড়া লাগে। আশু ফলের অস্থিরতা ছাড়া লাগে। সত্যের সামনে নগ্ন হয়ে দাঁড়ানো লাগে। এ দেশের সঙ্গে, অতীতের সঙ্গে যে সত্য নিবিড় হয়ে তাকে গড়ে তুলেছিল, তার কাছে আবার ফিরে যাওয়ার ব্যাকুলতাটা লাগে।