বিকেল হল, উঠানে বসল। গরমে ভেপসে যাচ্ছে বুক, পেট, বগল, থাই। কাজল গলবে আর বেশিক্ষণ হলে। গয়নাগুলো টিকটিকির মত গায়ের উপর বসে।
প্রথম যে এলো, শ্বশুরের বন্ধু।
ঘর অন্ধকার। পাঞ্জাবির বোতাম খুলতে খুলতে বলল, থাক থাক, আলো জ্বালতে হবে না…. তুমি বরং পুকুরের দিকের জানলার একটা পাল্লা খুলে দাও। বাতাস আসুক।
জোছনা জানলাটা অল্প খুলল। পুকুরের ওপাড়ে বাচ্চাগুলো খেলছে, কেউ কেউ বাসন মাজতে বসেছে। ঘরের ভিতরটা আলোছায়া।
রতন খালি গা, ধুতিটা থাই অবধি তুলে চৌকিতে পা দুটো ঝুলিয়ে, হাতদুটো পিছনে দিয়ে, মাথাটা পিছনে ঝুঁকিয়ে হা হা করে আওয়াজ করছে। যেন মাছ খাবি খাচ্ছে একটা। রতন ওভাবেই বলল, দাঁড়িয়ে কেন, বসো…. পাশে বসো….
জোছনা বসল। গায়ের গয়নাগুলো খুলে ফেলল। শাড়িটাও উপর থেকে সরিয়ে পাশে ফেলে রাখল। ব্লাউজের উপর দুটো নীল সুতোর ফুল আঁকা। তার উপর জানলা থেকে আলো এসে পড়েছে। জানলায় এসে বসল একটা চড়াই।
=====
রতন হাত রাখল জোছনার হাতের উপর। শীর্ণ উষ্ণ হাত। রতন বলল, আমার এ বয়সে ওসবের কোনো ক্ষমতা নেই। তবু আমাদের পাড়ায় তুমি প্রথম নও, জানোই তো… তুমি তো তাও অনেক দেরি করে আঁচল খসালে... কতজনের ঘর ভরে উঠল কম বয়সেই…
জোছনা জানলার বাইরে তাকিয়ে। ঘরের মধ্যে মন বসছে না। এ পাড়াতেই মন বসেনি কোনোদিন।
এ পাড়ার বেশিরভাগ বাড়িতে বউরা, মেয়েরা বাজি বানায়। পুরুষেরা বেশিরভাগ মাতাল। রিকশা নামমাত্র চালায় কেউ কেউ। কেউ কেউ মদের ঠেকে রাতদিন কাটিয়ে দেয়। যে ক'জন পুরুষমানুষ ব্যবসা করে, এদিক ওদিক করে টাকা করেছে তারাই এ চল শুরু করেছে। তবে কড়া নিয়ম, পাড়ায় অন্য পুরুষ ঢোকার নিয়ম নেই। যা হবে নিজেদের মধ্যেই।
=====
রতনের চালের ব্যবসা। তার বাড়িতে আসা যাওয়া শ্বশুরের আমল থেকেই। শ্বশুর ছিল জাত মাতাল। তার ছেলেও। আগে ভ্যান চালাত। গত দু'মাস আগে ভ্যান বিক্রি করে দেড় হাজার টাকাও পাওয়া গেল না। শাশুড়ি বলল, কাজে যখন নামবে তখন রতনদাকে বলি। ভালো মানুষ। আমায় বেশি খাটতে হয়নি। তবু হাবু কিন্তু তোমার শ্বশুরের। তুমি ও নিয়ে মনে সন্দেহ রেখো না। ও আসুক। তুমি বসো দাওয়ায়।
=====
রতন নাক ডাকছে। জোছনা শাড়িটা গুটিয়ে হাঁটুর উপরে তুলে, মাথাটা হাঁটুর উপর রেখে বসে। এ ঘরে পাখা নেই। পুকুরটা বড়। পুকুরের জল মাখা হাওয়া আসছে। বড় শরীরে অনেক জল। পুকুর, বারোভাতারি।
এ পাড়ায় এ চল দেখে জোছনা প্রতিজ্ঞা করেছিল সে যাই হোক, গলায় দড়ি দেবে, কিন্তু এ রাস্তায় নামবে না। কিন্তু সব গুলিয়ে দিল বেণী। স্কুলে যায়। ভালো পড়াশোনায়। নাইনে উঠল। মাধ্যমিকটা দেওয়াতেই হবে। যতদূর চায় পড়ুক। রতনকে সেই কথাটাই বলতে চায় জোছনা, সে যা চায় করুক, কিন্তু মেয়েটার ভার নিক। কিন্তু রতন।
রতন কুঁকড়ে শুয়ে। যেন মায়ের গর্ভের কথা মনে পড়ছে। বেণীকে বিয়ে দেবে না। বলবে চাকরি কর। তারপর এ পাড়া থেকে বার করে দিয়ে জোছনা মরবে। এ ঘরেই গলায় দড়ি দেবে। কিম্বা এই পুকুরেই ডুবে মরবে।
=====
শাশুড়ির শাঁখের আওয়াজে ঘুম ভাঙল রতনের। অন্ধকার হয়ে গেছে ঘর। রতন উঠেই বলল, আমি কোথায়… ওহ্… বড় শ্যামলের বাড়ি…. তুমি কোথায়….
জোছনা হাতটা বাড়িয়ে দিল। রতন হাতটা ধরে হাতড়াতে হাতড়াতে জোছনার বুকের উপর হাত রাখল। বলল, খোলোনি।
জোছনা বলল, আপনি ঘুমাচ্ছিলেন…খুলছি….
থাক থাক… সন্ধ্যে হল, বাড়ি গিয়ে আহ্নিক আছে…. তোমার শাশুড়িকে ডেকে দিয়ে তুমি যাও…. আমি ওর হাতেই টাকাটা দিয়ে দেব।
=====
জোছনা বসেনি এরপর ক'দিন দাওয়ায়। শাশুড়ির সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছে। বেণীর পড়াশোনা তার শাশুড়ির চোখে যেন বিষ। তাকে, তার মেয়েকে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগাল করে। জোছনা মেয়ে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে যায়। কোনো গাছতলায় বসে থাকে, কি শিবমন্দির তলায় বসে থাকে। সংসার চালানোর জন্য বাজি বানানো তো আছে, বড়জোর তার এই বাড়তি উপার্জনের সামান্য কিছু দিতে পারে, মাছ বা ডিমের জন্য সপ্তাহে একদিন কি দু'দিনের জন্য... কিন্তু সব টাকাটা কিছুতেই নয়।
শাশুড়ি রাজি হল অবশেষে। চারদিন ছেলে বাড়ি এলো না। শাশুড়ি বলল, থানায় যাব। জোছনা বলল, ওর জন্য শ্মশান ছাড়া কোথাও যাব না মা….
শাশুড়ি বলল, না ফিরলে বডি পাবি?….. আগে খুঁজি চল….
জোছনা বলল, বারো বছর না ফিরলে এমনিই মানুষ মরে গেছে ধরে নেয়…. কাজ করে নেব…. সবে তো চারদিন।
শাশুড়ি কথা বাড়ায়নি। রতন আর আসেনি। জোছনার বরও আর ফেরেনি। দু'সপ্তাহ হলে শাশুড়ি বলল, সব শর্তে রাজী।
জোছনা বসল দাওয়ায়। সেদিন এলো বগা। মোবাইল সারানোর দোকান করেছে চৌমাথায়। ভালো চলে। তার বয়েস বেণীর চাইতে পাঁচ কি ছ'বছর বড় হবে।
ঘরে ঢুকেই হামলে পড়ল। কোমর জড়িয়ে, গাল কামড়িয়ে বলল, কতবার স্বপ্ন দেখেছি তোকে…. ল্যাংটো….
বাইরের পুকুরে কেউ ঝাঁপ দিল গাছ থেকে। কোনো বাড়ির ছেলেই হবে। এ এক খেলা। কত খেলা সংসারে আছে। শরীর নিয়ে। মন তো ঝুলের মত, অল্প বাতাসে দোলে, বেশি বাতাসে ছেঁড়ে। জোছনার মন নেই। মেয়ে আছে। আর মেয়েকে বাঁচানো, নিজেকে বাঁচানো আছে। নিজেকে বাঁচানো মানে তো পেট। যেখানে জিভ বোলাচ্ছে ছেলেটা। জোছনা স্বপ্ন দেখছে তার বরকে পুড়িয়ে ফিরছে সে। ঘরে ঢুকে নিমের পাতা কাটছে মুখে। তিতা।
=====
বেণী পালালো। চিঠি লিখে। চিঠি পড়াতে জোছনা গেল রতনের দোকানে। কলেজের এক ছেলের কাকার সঙ্গে পালিয়েছে। সে ব্যবসা করে লক্ষ্মৌতে। জানে জোছনা ছাড়বে না, ছেলেটার বাড়িতেও রাজী নয়। তাই তারা পালিয়েছে।
জোছনা ক'দিন ধরে মরার কথা ভাবল। এর মধ্যে সত্যিই সে বিধবা হয়েছে। তার বরের পচা শরীর রেললাইনের ধার থেকে পাওয়া গেছে। কুকুর-শেয়ালে খাওয়া। শাশুড়ির মাথাটা খারাপ হয়েছে। বাড়ি ফেরে না। রতনের দোকানের সামনে বসে থাকে আর বিড়বিড় করে কি সব বলে যায়। রতনের বাড়ির লোক বাসি রুটি, ভাত দেয়, কখনও খায়, কখনো খায় না। জোছনার শাশুড়িকে দেখলে কান্না পায়।
একবার মুষলধারে বৃষ্টি। জোছনা ছাতা আর একটা শাড়ি নিয়ে ছুটল রতনের দোকানের দিকে। গিয়ে দেখে তার শাশুড়িকে রতন একটা বস্তা টাঙিয়ে বসার জায়গা করে দিয়েছে। কিন্তু সে রাস্তায় উবু হয়ে বিড়বিড় করে বকেই যাচ্ছে।
জোছনা ছাতা মাথায় শাশুড়ির সামনে দাঁড়ালো। রতন ইশারা করে দেখালো, মাথাটা পুরো গেছে, তুমি বাড়ি যাও, আমি আছি।
সবটা ইশারায় বলল রতন। জোছনা বুঝল। সংসারের সব আসল কথা ইশারাতেই তো হয়। ঈশ্বর মানেও তো ইশারা।
=====
জোছনা মরবার কথা আর ভাবে না। একদিন গভীর রাতে হিসি করতে উঠে তার মনে হল সে বাঁচবে। এক আকাশ তারার সামনে যখন সে পুকুরধারে বসে, পুকুরের উপর পূর্ণিমার চাঁদের ছায়া, তারার ছায়া, এরা সবাই বসে তার মরণ দেখবে বলে? সে বাঁচবে।
ক'দিন রোজ বাজারে গেল। প্রথমে ভেবেছিল কাজ চাইবে। কিন্তু দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই মন বলত, না না, অন্য কিছু ভাব জোছনা। কি করবে? বড়ি বানাবে? বিড়ি বাঁধবে? স্টেশানে বসে বসে চা আর একটা বাপুজী কেক খেতে খেতে মাথায় হাজার একটা ভাবনা আসছে। কি করবে? হঠাৎ পাশে দেখে তার মত একজন বউ ফুচকা বিক্রি করছে। ব্যস, মাথায় গিঁথে গেল। সে বউয়ের নাম রমা। তার বরের শরীর একদিক পড়ে গেছে। আগে সে-ই বেচত। এখন সে ভার নিয়েছে। জোছনা রমার বাড়ি যাতায়াত শুরু করল। ফুচকা বানানো শিখল। রমা তাকে টাকা ধার দিল। বলল, দিদি তুমি নিজে দোকান করো।
=====
বাড়ির সামনে ফুচকার দোকান করেছে। তিন বছর শরীরের উপর যারা রগড়েছে তারা আসে না। এ পাড়ারই সব। তবু আসে না। তাদের বাড়ির লোকেরা আসে। ফাউ ফুচকা চায়। জোছনা দেয়। আবার দেয়ও না। তার দেখাদেখি আরো কয়েক বাড়ি ফুচকার দোকান দিয়েছে। লাভের মুখ দেখছে পরিবারগুলো। বউগুলো সুখী হোক। মেয়েগুলো সুখী হোক। প্রতি বছর শিবরাত্রিতে আগে তার ডাক পড়ে এখন এ পাড়ায়। রমাও আসে।
জোছনা এখন অনেক কিছু ভাবে। বেণীর কথা ভাবে। বেণী ফোন করে। জোছনা স্মার্টফোন কিনেছে। বেণীর ছেলের সঙ্গে কথা বলে। নাতি বলে, নাচ দিখাও। জোছনা বলে ওরে মিনসে। নাতি হেসে লুটিয়ে পড়ে। জোছনা গান চালিয়ে নাচ প্র্যাক্টিস করে। নাতিকে দেখায়। মেয়ে বলে, তোমার বয়েস কমছে, না বাড়ছে মা!
=====
শাশুড়ি মারা গেল রাস্তাতেই। রাতে। জোছনা দাহ করে এসে এমন কাঁদল, সারা পাড়ার মেয়ে-বউ কেউ সান্ত্বনা দিতে পারল না। জোছনা সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দরজা দিয়ে শাশুড়ির ঘরে শুয়ে ছটফট করে কাঁদল। যেন এ পাড়ার সব বউ, মা, শাশুড়ির জন্মজন্মান্তরের কান্না সে একা কাঁদছে।
সেদিন অনেক রাতে রতন এলো। জোছনার হাতদুটো ধরে বসে থাকল। ফোঁপালো। কিন্তু শরীরে কান্নার শক্তি নেই।
জোছনা ভোরবেলা রতনকে বাড়ি পৌঁছিয়ে দিতে গেল। রতন কাঁপা কাঁপা হাতটা তার বাড়ির সামনে এসে জোছনার মাথায় রেখে বলল, আমার আশীর্বাদ করার অধিকার নেই মা…. তবু বলি তোমার মাকে আমি সত্যিই ভালোবাসতাম…. আর….
জোছনা বলল, আমি জানি, মা পাগল হয়ে সবাইকে ভুলল… আপনাকে না…. এ ভালোবাসা না থাকলে….
জোছনা কথা শেষ করতে পারল না। কান্নার তোড়ে গলা চেপে গেল। মাথাটা নীচু করে বলল, আমি আসি বাবা…..
পিছন ফিরে তাকালো না আর। মানুষের পাপপুণ্যর হিসাব জোছনা করে না। সবাই ভালো থাকুক। এর বেশি কিছু চায় না। ঈশ্বর সে অধিকার দেয়নি কাউকে। জোছনা জানে। ইশারায় বলেছেন তাকে, মহাদেব।