Skip to main content

বয়ানের দুটো ছাগল চুরি হয়ে যাওয়ার পর বয়ানের সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেল। সকালে যা হোক কিছু একটা খেয়ে সারাটাদিন ঝোপেঝাড়ে খুঁজে বেড়ায়। রেললাইন ধরে প্রায় দশ কিলোমিটার হেঁটেছে পুবে পশ্চিমে। কোত্থাও পায়নি, প্রায় চারমাস হয়ে গেল।

=====

রোহিণী ভিজে কাপড় গায়ে পুকুর থেকে উঠে আসার সময় দেখল বয়ান অশ্বত্থগাছটার তলায় বসে আছে। রোহিণীর বিয়ে ঠিক হয়েছে সামনের আষাঢ়ে। ছেলে কলকাতায় ঠিকে কাজ করে। রোহিণীকে দেখতে এসেছে বাইকে করে, বন্ধুদের নিয়ে। ভালো লাগেনি রোহিণীর। খুঁটে খাওয়া চাহনি। বন্ধুদেরও তাই। এক-এক সময় মনে হয় পুকুর থেকে উঠবে না। এই পুকুরে ডুবে মরল কত কেউ… রোহিণী ডুব সাঁতার দিয়ে তাদের খোঁজে। মনে হয় যদি কেউ ডেকে নেয়। নিজেকে নিজে নিয়ে ডুবতে কেমন লাগে!

=====

বয়ানের চোখে ঝিম ধরে আছে। আজ সকালে একটা পাকা পেয়ারা খেয়ে বেরিয়েছে। প্রচণ্ড রোদের তেজ। মাথাটা মনে হচ্ছে মাটিতে টলে পড়বে, এমন ভার। গলাটা শুকিয়ে কাঠ। কে ও??

রোহিণী। তার থেকে বছর পনেরো ছোটো হবে। তাকে 'কাকা' বলে ডাকে। কিন্তু ডাকে কি আসে যায়?

রোহিণী বলল, কাকা এখানে?

তুই এত অবেলায়…. জ্বর এলে?

মরব……

=====

রোহিণী চলে গেল। 'মরব' কথাটা বুকে বিঁধল বয়ানের। বয়ান মনে মনে আওড়ালো…. আমি… আমি আমিও।

বয়ান পুকুরে নামল। সারা পুকুরের জলে রোহিণীর গন্ধ। ডুবে গেলেই হয়। রোহিণীকে ডেকে নেবে।

=====

শিবমন্দিরে বসে বয়ান। এখন মাথায় তিনটে চিন্তা সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। ছাগল, রোহিণী আর মরণ। কোনটা আগে আসবে?

বাইরে কারোর পায়ের আওয়াজ। ঝিমটা কেটে গেল বয়ানের। নিজেকে গুটিয়ে বসল।

রোহিণী ঢুকল।

বয়ানের মাথাটায় রক্ত চলকে উঠল। দাঁড়িয়ে উঠে বলল, তুই….

রোহিণী বলল, তোমার কাছে এলাম…..

=====

বয়ান রাতে দু'দিন ঘুমালো না। শরীরটা কামড়ে বসে আছে একটা বাঘ। ক্ষুধার্ত। সারাটাদিন মনে হয় জ্বর হয়ে আছে। পুড়ে যাবে। মরে যাবে। রোহিণী তুমি দীঘি, না রোদে তেতেপুড়ে থাকা রেললাইন?

রোহিণী স্নান করে জল থেকে ছাগলদুটো তুলে বলল, নাও। বয়ান কাছে গিয়ে দেখে রোহিণীর হাতে দুটো ছাগল, তারই। মড়া। বয়ান রোহীনিকে জড়িয়ে, রোহিণীর ঠোঁটে নিজেকে আটকে দিল। বয়ানের চোখ বন্ধ। তাও বুঝছে তার কোমর থেকে জল গলা অবধি আসছে। ক্রমে নাক, চোখ…..

ধড়ফড় করে উঠল বয়ান। বারান্দায় বসে বসেই চোখ লেগে গিয়েছিল। কিন্তু রোহিণী যা বলল, তা কি করে হয়… সম্ভব?

=====

রোহিণী এলো। মধ্যরাতে। বসল। বয়ান দূর থেকে পাচ্ছে বাঘের গর্জন। সে আসছে। যে রাস্তাটা বড় রাস্তা হয়ে ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে, স্কুলের পাশ দিয়ে আসে, সেই রাস্তা দিয়ে আসছে। গজরাতে গজরাতে আসছে।

বাঘ না। বাইক। হরেন আসছে। বয়ানের শরীরের উপর শিকল পরানো বাঘ। অন্ধকারে বসে দু'জনে। বয়ানে পাশের ঘরে গিয়ে দা-টা বার করে চৌকির উপর রাখল। অমাবস্যা আজ।

=====

বয়ানকে পুলিশ জিজ্ঞাসা করল। রোহীনি গ্রামের লোকের সঙ্গে এসে দাঁড়ালো ভিড়ের মধ্যে। রোহিণীকেও জিজ্ঞাসা করা হল। কিন্তু বয়ান বারবার বলল, সে হরেনকে চিনত আগে থেকেই। রোহিণীকে ভালোবাসত বয়ান, ঈর্ষায় মেরে ফেলেছে।

=====

রোহিণী পুকুরপাড়ে বসে। স্নানে নামবে। বছর ঘুরে গেছে। আশছে শ্রাবণে তার বিয়ে। ছেলের মোবাইল সারানোর দোকান। বড় সুন্দর দেখতে। রোহিণীকে মোবাইল দিয়েছে একটা। পলাশ, নামটাও তো বেশ। সুখের মত লাল।

সুখ আসছে। কিন্তু জন্মাচ্ছে না মনের মধ্যে। বয়ানের বাড়ির পাশ দিয়ে গেলে বুক ভারী হয়ে যায়। বয়ানের ছাগলদুটোকে তার দাদাই বেচে এসেছে শহরে। নেশার ঘোরে করেছে। করতেই পারে। নেশার ঘোরে তার শরীরেও হাত দিতে গেছে, আর এ তো ছাগল!

=====

রোহিণী খবরটা পেলো পুকুরপাড়েই। জানত তো এরকম কিছু একটা হবে। পলাশ বাইক চালিয়ে আসছিল, সামনে একটা ছাগল চলে আসে, তাকে পাশ কাটাতে ব্যালেন্স হারিয়ে যায়, পড়ে যায়, একটা লরি চাপা দিয়ে……

রোহিণী হিসাব করে। যুক্তি সাজায় মাঝরাতে শুয়ে শুয়ে। বয়ান, না হরেন…. কার কাছে বেশি দোষী সে? একদিন ভোরে স্বপ্ন দেখল বয়ান ফিরে এসেছে, কোলে দুটো ছাগল। বয়ান তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তাকে ডাকছে। রোহিণী গেল। বাড়ির দরজা খুলল বয়ান। দরজা খুলতেই ঘরের মধ্যে পুকুর। বয়ানের কোমর জড়িয়ে নামছে। জল ক্রমে বুক, মাথা ছাপিয়ে যাচ্ছে….

উঠে বসল রোহিণী। দাদা বলল, পুলিশ এসেছে।

=====

বয়ান গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে জেলে। মারা যাওয়ার আগে চিরকুটে লিখে গেছে, রোহিণী, তুই পুকুরঘাটে যাস না।

পুলিশ এর মানে জানতে চেয়েছে। রোহিণী বলেছে সে জানে না। পুকুর তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ। একটা দা পাওয়া গেছে।

=====

রোহিণীর বিয়ে হয়ে গেছে। বর মুদির দোকান চালায়। রোহিণী শ্বশুরবাড়ির পুকুরঘাটে বসে। বর্ষাকাল। খগেন শহরে গেছে মাল আনতে। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। রোহিণী বসে বসে হাঁসের মত সুখের সাঁতার দেখছে মনে। এতগুলো সাদা হাঁস, কিন্তু একটাও যেন তার নয়। যে কোনোদিন চুরি হয়ে যাবে। যে কোনোদিন। প্রায়ই স্বপ্ন দেখে সাদা হাঁসগুলো বঁটি দিয়ে কাটছে তার অবিবাহিত ননদ। কথায় কথায় অশান্তি বাধায় ননদের সঙ্গে।

=====

ননদের মাথা খারাপ। দাদা আর বোন একরকম ছিল। রোহিণী আসার পর থেকে মৌয়ের অস্বাভাবিকতা আরো বেড়ে গেছে। রোহিণী কথায় কথায় বলে, তুই আমার খাবারে বিষ মেশাবি… জানি জানি…. আমার হাঁসগুলো কাটবি…. রক্ত খাবি…

মৌ ভালো করে কথা বলতে পারত না। তোতলাতো। খগেন বুঝত বোনের অস্বাভাবিকতা বাড়ছে, কিন্তু কেন ঠাহর করতে পারত না। রোহিণী খগেন থাকলে সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। রোহিণী পাপ সহ্য করতে পারে, কিন্তু ম্যাদাটেভাব সহ্য করতে পারে না। হরেনের চোখে পাপ ছিল, সেটা ঘেন্না লাগেনি, লেগেছিল হরেনের ম্যাদাটে ভাব। কোনো উচ্চাকাঙ্খা নেই এমন পুরুষ দু'চক্ষের বিষ রোহিণীর। বয়ানের তো পাপের মুরদও ছিল না। শুধু লোভের ঘা ছিল সারা গায়ে।

=====

রোহিণী দুপুরে ভাতঘুমের মধ্যেই আন্দাজ করতে পেরেছিল পুকুরে কিসের আওয়াজ হল। আজ যে কথাটা বেরিয়ে গেছে মুখ থেকে সেটা বুকের পাঁজরে মাকড়ার মত কত যুগ ধরে যে আটকে ছিল।

মৌ দাওয়ায় বসে বসে মুড়ি খাচ্ছিল। যত না খাচ্ছিল ছড়াচ্ছিল তার বেশি। আচমকা মাথাটা গরম হয়ে গেল রোহিণীর। চীৎকার করতে শুরু করল। আগেও দেখেছে, বেশি জোরে চীৎকার করলে নাইটিতেই হিসি করে দেয় মৌ। সিঁটিয়ে যায়।

আজ হঠাৎ বলে ফেলল রোহিণী, আমি কি জানি না দাদার সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক ছিল…. জানি না আমি…..

কথাটা নিজের কানেও বড্ড বেজেছিল। কিন্তু বলার সঙ্গে সঙ্গে যেন কতদিনের জমানো পুরোনো বিষ বেরিয়ে গেল মনে হল। মাটিতে বসে পড়ল রোহিণী। তার জমানো বিষ বাইরে এসে যে কি কি জ্বালিয়ে গেল খেয়াল করার মানসিক অবস্থা ছিল না তার তখন।

মৌ দুপুরে খেতে এলো না। খগেনের নেমন্তন্ন, বাজার কমিটির খাওয় দাওয়া, আজ আসবে না। রোহিণী মৌয়ের ঘরের সামনে দিয়ে যেতে গিয়ে দেখল দরজা দেওয়া। থাক, ডাকেনি আর।

=====

বছর গেল। কিন্তু সেই বিষের তেজ আর কমল না। খগেনের সঙ্গে তার ভালোবাসা না থাকলেও বোঝাপড়া ছিল। সেটাতে চিড় ধরল। রোহিণী উপেক্ষা নিতে পারে না। রাগের উপেক্ষায় আমোদ পায়। কিন্তু স্বাভাবিক স্বভাবের উপেক্ষা নিতে পারে না রোহিণী। অসহ্য লাগে। দিন যত যেতে লাগল খগেন তত বারমুখী হতে শুরু করল। সংসারটা যেন দায়। রোহিণী যেন বাড়ির আসবাব। কাজে লাগে, কিন্তু অপরিহার্য কিছু নয়।

রোহিণী জানত কি করতে হবে। রোহিণী জন্ম থেকেই জানে কি করে নিজের রাস্তা বার করে নিতে হয়। কেউ শেখায়নি, এমনিই জানে। কিন্তু এইবারে ভয় করছে। আজকাল বয়ানের বাড়িটা, গ্রামের পুকুরটা বড় বেশি স্বপ্নে আসছে। ঘাম হয়ে ঘুম ভাঙছে। কিন্তু তবু, কোনো দোটানায় বাঁচা রোহিণীর স্বভাবে নেই। যেটা করতে হবে, করতেই হবে।

খগেনের খাবারে বিষ মেশানো বড় কথা নয়, ওকে খাওয়ানোও নয়, বড় কথা হল তারপর কি করবে? এই দোটানায় নিজেকে বড় অসহায় লাগতে শুরু করল রোহিণীর। এতদিন তার প্রতিপক্ষ ছিল বাইরের কেউ। একদিকের সুতো নির্মমভাবে ছিঁড়ে দোটানার হাত থেকে নিস্তার পেয়েছে। কিন্তু এইবারে সে নিজেই যেন নিজের প্রতিপক্ষ। কিন্তু দোটানায় বাঁচা তো তার স্বভাব নয়।

রোহিণীকে পাওয়া গেল তার বাপের বাড়ির গ্রামের পুকুরেই। কেউ জলের তলা থেকে হাত ধরেনি রোহিণীর। নিজেই নিজের হাত ছেড়ে দিল। সেদিন ভীষণ ঝড়। বয়ানের বাড়ির সামনে ঝোপেঝাড়ে জঙ্গল হয়ে রয়েছে। ঝড়ে বয়ানের বাড়ির দুটো দেওয়াল দুমড়ে গেল। পরেরদিন সকালে যখন সবাই গ্রামের অবস্থা দেখতে বেরিয়েছে, দেখে বয়ানের বাড়ির ছাউনি পুকুরপাড়ে এসে উড়ে পড়েছে। দেওয়ালগুলোও যেন এদিকেই উড়ে আসছিল। সবাই বলল, হাওয়ার বেগ এবার ভীষণ ছিল। ভাঙা ঘরবাড়ি দেখতে দেখতেই রোহিণীর ভেসে থাকা শরীরটা চোখে পড়ল গ্রামের নাপিত ফুলুর। সে চীৎকার করে বলল, লাশ!!