সূর্য তো পুবাকাশে ওঠে, তাই বলে কি সূয্যি পুবাকাশের হয়ে যায়?
কবি বললেন, শ্রীরাধা জন্মালেন বরসনায়। সে বরসনায় গেলাম আজ। সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে উঠলাম। টিলার উপরে মন্দির। বেশ চড়াই। কবির হৃদয়ে যিনি জন্মালেন তাঁকে কি বাইরের মন্দিরে পাওয়া যায়? তবু মন্দিরে গেলে সুখ হল। কেন বলো তো?
এই যেমন ধরো স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। কেউ এসে জিজ্ঞাসা করল, হ্যাঁ গা, ওই যে দুটো কাঠের পাটাতন হাতে দাঁড়িয়ে, ওরাই কি ক্রিকেট? তুমি বললে, না। সে বলল, তবে ওই যে এদিক ওদিক কিছু লোক গোল হয়ে, মাঠের কেন্দ্রে দুপাশে তিনটে করে কাঠি পোঁতা ফাঁকা জায়গার দিকে তাকিয়ে, ওই ক্রিকেট? তুমি আবার বলবে, না না। সে বলবে, তবে এই যে এতলোক ভিড় করে মাঠের চারদিকে বসে, ওই যে একটা লোক টুপি পরে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে মাঠের মাঝখানে, হাতের অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করছে, ওই তবে ক্রিকেট? তুমি হাল ছেড়ে বলবে, আরে ভাই না না...সবটা মিলিয়েই ক্রিকেট।
শ্রীরাধার মন্দির, রাধারমণের মন্দির সেইরকম স্টেডিয়ামের মত। মিলনক্ষেত্র। রামকৃষ্ণদেব বলেন মাধুর্য আর ঐশ্বর্যের কথা। ঐশ্বর্যের অনেক হিসাবনিকাশ, তর্কবিতর্ক। মাধুর্যের সে দায় নেই। আকাশে কালো মেঘ করে এলে, ঝোড়ো বাতাসে গাছপালা দুলে দুলে আসন্ন বর্ষাকে অভিনন্দিত করলে তোমায় প্রাণে যদি মিঞামল্লার কি গৌড়মল্লারের তান ওঠে, তবে কেন উঠল এ তর্ক উত্থাপনের কোনো মানে হয় না।
রাধারমণের মন্দিরে গান হচ্ছে। "সব হর লিও মেরে মোহনা"। এক যুবতী মন্দিরের কোণে বসে নিজের মুখটা ওড়নার আড়ালে রেখে কাঁদছে। জানি না তার বৃন্দাবন কোথায়? তবে কাঁটা যে ফুটেছে সে তো বোঝাই যাচ্ছে। বৃন্দাবন আসার আগে দিল্লির নিজামুদ্দিনের দরগায় গিয়েছিলাম। আমির খসরুও আছেন পাশাপাশি। নিজামুদ্দিনকে দেখে লিখেছিলেন শুনেছি, "ছাপ তিলক সব ছিনি মো সে নয়না মিলাইকে।" বৈষ্ণব কবি গেয়েছিলেন, "আমা হইতে জাতিকূল নাহি গেল রাখা.... দেখে এলেম তারে সখী..... দেখে এলেম তারে...."।
ভাবুক ভক্ত বলে রাধারমণের দিকে চেয়ে থাকলে তাকে নিত্য নতুন ভাবে লাগে। এ সত্য। ভালোবাসার মানুষকে নিত্য নতুন তো লাগেই। যদি ভালোবাসা মাধুর্যের মকরন্দ হয়। যদি না সে সুগন্ধি মোড়কে স্বার্থের আঁশটে গন্ধ হয়।
মন্দিরে ধুপ জ্বলে। দীপ জ্বলে। ভালোবাসা সুগন্ধী আর উজ্জ্বল বলেই যে না। বুদ্ধ রহস্য করে বলেন, ফুলের গন্ধ হাওয়ার দিকেই শুধু বয়, শুদ্ধ হৃদয়ের সুবাস বাতাসের বিপরীতেও বয়।
রাধাকুণ্ডের পাশে সিঁড়ি ঝাঁট দিচ্ছেন তিনি প্রায় চল্লিশ বছর হল। স্বামী মারা যাওয়ার পর, না শ্বশুরবাড়ি নিয়েছে, না বাপের বাড়ি। ময়লা সাদা শাড়ি, ময়লা একটা সোয়েটার, গলা মাথা প্যাঁচানো শতচ্ছিন্ন মাফলার। বলল, এই বেশ আছি। একজন অল্প বয়েসী ছেলে হঠাৎ তার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। বলল, তীর্থে যাচ্ছি ঠাকুমা। আশীর্বাদ করো। বাবার সঙ্গে আসতাম যখন তখন থেকে তোমায় দেখছি।
বৃদ্ধা রাধাকুণ্ডের সিঁড়িতে বসে পড়লেন। "এত অল্প বয়সে এসব কেন? বিয়ে করো, সংসার করো।"
যুবক বলল, এই বয়সেই করে নিই, বয়েস হলে পারব না।
যুবক হাসল। প্রণাম করে চলে গেল। বৃদ্ধা ঝাঁটা আর বালতি হাতে বসে রইল সিঁড়ির উপর। মুখের উপর বিকেলের আলো। এমনভাবে বসে যেন যুগযুগান্ত আর কোনোদিন উঠবে না। উঠে কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে? সব সম্পর্কের শান্তি ভিত হয় না তো। যে সম্পর্ক শান্তির ভিতে জন্মায় না, জল পায় না সাহচর্যের সে সম্পর্ক থাকে কতদিন? অল্প ঝড়েই উপড়ে যায়। সব উপড়ে ছিন্নভিন্ন।
যমুনার তীরে এলাম আবার বৃন্দাবনে ফিরে। হাতের পাঁচ আঙুলে সেঁকছি গরম চায়ের কাপের তাপ। ফেরার সময় আসছে। একজন এসে দাঁড়ালো পাশে। জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু বলবেন? সে বলল, হ্যাঁ দাদা, বাঁদরে চশমা নিয়ে গেছে। দেখছি না চোখে। আপনি একটা ফ্রুটি কিনে ওকে দিলেই ও দিয়ে দেবে। এই নিন টাকার ব্যাগ। এখান থেকে টাকাটা নিয়ে নিন।
বৃন্দাবনে এ এক বিরাট সমস্যা। হাজার হাজার বাঁদর সর্বত্র। টুপি, মাফ্লার, ফোন আর সর্বোপরি চশমা, ক্ষণমাত্র অসতর্ক হলেই ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। এখানে সব বাড়ির ছাদে জাল দেওয়া। বাগান সব লোহার জালে ঘেরা। স্থানীয় লোকের জীবন বাঁদরের বাঁদরামিতে নাজেহাল। কিন্তু কোনো কিছুই কেউ করছে না। উদাসীন সব। আমি নিজেই চশমা পকেটে নিয়ে ঘুরছি। চোখে রাখা যাচ্ছে না রাস্তায় বেরোলে। এখানের লোক যার জন্য সব সময় এক্সট্রা চশমা বানিয়ে রাখে। আর শুধুমাত্র ফ্রুটি দিলেই ফেরত দেবে, নইলে নয়। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও হয়ে গেছে বৃন্দাবনে এসেই পরেরদিন সকালে।
ভদ্রলোক চশমা পেলেন ফ্রুটির বিনিময়ে।
একাই আসেন?
হ্যাঁ, আমাদের পারিবারিক বিগ্রহ আছে, গোপালের। আমাদের বাড়ি এমনিতে শিয়ালদার পাশে। আমাদের অনেক আগের প্রজন্মের একজন স্বপ্ন পেয়েছিলেন, এখানে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করতে। তখন রেল ছিল না। নৌকা করে আনা হয়েছিল। আমরা গোপালেরই সেবায়েত।
"রাধে রাধে" বলে যমুনার তীর ধরে হাঁটতে শুরু করলেন। আমার ইচ্ছা হল একবার যাই। জিজ্ঞাসা করি, দেখতে দেবেন?
জিজ্ঞাসা করলাম না। আসলে চার দেওয়ালের মধ্যে দেখার ইচ্ছা হচ্ছে না। এ যমুনার তীরেই আসুক সে। এসেছিল তো। জোড়াসাঁকোর ঘরে। মেঘলা দিনে উপুড় হয়ে শুয়ে এক বালক লিখেছিল তো "গহন কুসুমকুঞ্জ মাঝে"। গোটা বাংলা ভেসে গেল সুরে। আজও ভাসছে। রবীন্দ্রনাথ শেখান কিভাবে বরসনা খুঁজতে হয়। আজও শেখাচ্ছেন।
(কেউ কেউ যমুনার ছবি চেয়েছেন। দিলাম এখানে। আর দিলাম বরসনার মহলের দেওয়ালে আঁকা কিছু ছবি। আমি ছবি তুলি না। আসলে আমার বাইরে এলে মোবাইলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকে না। তাই হেলায় তোলা কিছু ছবি দিয়ে রাখলাম। ক্ষমা করবেন আমার এই সাদামাটা ছবি পোস্ট করার জন্য। যদিও আশা করছি ভালো কিছু ছবি পাব, আমার কয়েকজন চিত্রগ্রাহক অনুজ সঙ্গে এসেছেন যে। রাধে রাধে!)