ন্যারেটিভের বাংলা করি ব্যাখ্যাপট। জীবনটাকে কী ব্যাখ্যাপটে দেখছি? আনন্দে, না বিষাদে? আনন্দ বলতেই কি হাসি হাসি, ঢলো ঢলো মুখ? আর বিষাদ মানেই কি গম্ভীর, খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা ঝুলে পড়া মুখ? উঁহু। এগুলো থিয়েটারি এক্সপ্রেশান। বাস্তবিক না। অভিনয়ে বোঝাবার জন্য ওসব। জীবন বাঁচার জন্য। বাঁচতে গেলে কাকে আর কী বোঝাব? নিজেই কিছু বুঝে উঠতে পারা যাচ্ছে না, আবার অন্যকে নাকি বোঝাব!
তবে আনন্দ আর বিষাদকে কি বাইরে থেকে জানা যায়? সাধারণভাবে এর উত্তর - না। হাসিমুখের আড়ালে বিষাদ লুকিয়ে থাকে। আবার গম্ভীর মুখের আড়ালে আনন্দ পেঁজা পেঁজা জমে থাকে। পাহাড়ের কোলে কোলে কুয়াশার মত।
এই আনন্দ আর বিষাদ কি ব্যাখ্যাপটের উপর নির্ভর করছে? সাধারণভাবে উত্তর দিলে, করছে। আমি আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে কী আঙ্গিকে দেখছি? অতি-মূল্যায়ন করছি, না অব-মূল্যায়ন করছি? কিম্বা আদৌ মূল্যায়নই বা করতে চাইছি কেন? যা ঘটেছে তার যদি কোনো মূল্যায়নই না করি, খুব কি অসুবিধা হবে? মূল্যায়ন করতে গেলেই কোনো না কোনো একটা ব্যাখ্যাপট তো এসেই যাবে। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির জগতে কোনো ব্যাখ্যাপটই কি নির্ভুল, সামঞ্জস্যপূর্ণ? জীবনটাকে যদি সব ধরণের ব্যাখ্যাপট থেকে সরিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করি, কেমন হবে? যা ঘটেছে, ঘটেছে। যা লাভক্ষতি হওয়ার, হয়েছে। ব্যস। সুখ-দুঃখ যা পাওয়ার পেয়ে চলেছি। এরপর আবার কী? এর জন্য নিত্যনতুন ব্যাখ্যাপট আমদানি করে কী হবে?
যদি সব ব্যাখ্যাপট সরিয়ে দিই তখন কী হবে? মন জেটির মত শান্ত হবে। দুলবে, কিন্তু ছিঁড়ে ভেসে যাবে না। একটা দাঁড়ানোর জায়গা হবে।
অ-সাধারণ জীবন নিয়ে হবেটা কী? তার চাইতে একটা সাধারণ জীবনের সুখ তো ঢের। চিন্তা সব সময় নিজেকে অসাধারণ, ব্যতিক্রমী ভাবতে চায়। নইলে তার গুমোর থাকে না। এই চিন্তার দোসর হল নানা অনুভব আর তার অভিজ্ঞতার মালা। মুখে বলছে আমি অতি সাধারণ, কিন্তু মনে মনে ঠিক জেনে বসে আছে এমন চিন্তা, এমন অনুভব এ শুধু আমারই হচ্ছে। কারণ আমি কোথাও সবার থেকে একটু আলাদা!
এই এক মজাদার ব্যাখ্যাপট। আমি নিজেকে অসাধারণ বলছি না, আমি নিজেকে বলছি, আমি একটু আলাদা। সবার মত ঠিক নই। ব্যস, ইঁদুর কলে ঢুকেও পড়েছে আর কল বন্ধও হয়ে গেছে। এবার ঠেলা সামলাও।
কিন্তু আমি যদি আমার চিন্তাজাত, মনের দীর্ঘদিনের অভ্যাসগত ঝোঁকজাত নানা ব্যাখ্যাপটকে আমল না দিই? সে সব আসবে আসুক, কিন্তু আমি যদি আমল না দিই? একটা ম্যাজিক ঘটে যাবে অন্তঃকরণে। জেটির উপর সাদা পায়রা এসে বসবে। মন শান্ত হবে।
জেটি কেন বলছি? তা জেটি বলব না তো কী বলি? কত মানুষ এলো গেলো। কার নৌকা, কি জাহাজ, কি ডিঙি কদ্দিন আমার কূলে বাঁধা থাকবে আমি কি জানি? সুখদুঃখের ডেলিভারি আমার জেটিতে কখন কোন জাহাজে আসবে আমি আগে থেকে জানতে পারি? কিচ্ছু জানতে পারি না। যা ডেলিভারি আসবে কাগজে সই করে সে নিতেই হবে। আর যে চলে যাওয়ার তার নৌকার বাঁধন আলগা করে তাকে বিদায় দিতেই হবে। তার নৌকার বাঁধনের ফেলে যাওয়া রশির টান বুকে মোচড় দেবে ঠিকই, কিন্তু কতদিন? একদিন না একদিন তো মেনে নিতেই হবে!
সেই জন্যেই বললাম, জেটি। জেটি থাকুক। কিন্তু কোনো নৌকার আসা যাওয়ার ব্যাখ্যাপট না থাকুক। মন এক অসীম শূন্যের প্রেক্ষাপটে সব দেখুক। সে শূন্যকে সে ঈশ্বর, মহাকাল, কি শুধুই শূন্য বলুক না হয়। কিন্তু একটা কথা সত্য, সে আকাশের মত নির্বিকার। বাতাসের মত অনাসক্ত। জীবনটাকে সাধারণ থেকে অসাধারণ বানানোর চক্করে তো এতগুলো দিন নষ্ট হল। কী হল? শেষে বাঁশ আর কাদা কাদা ঘরময়। বিসর্জনের বাজনাও গেছে থেমে। থাক থাক ওসব। সব ব্যাখ্যাপট মহাশূন্যে হোক লীন। যা আছে, এই তো সামনে আছে। যা ঘটছে, এই তো সামনে ঘটছে, স্পষ্ট। সুখদুঃখ, লাভক্ষতি সব তো স্পষ্ট। এর ওর সঙ্গে তুলনা করে, এর ওর ব্যাখ্যাপটে নিজের জীবনের ঘটনাবলীর সারাংশ খুঁজে লাভ কী? কিস্যু মিলবে না। শেষে সব ফাঁকি মনে হবে।
যখন সেই শূন্যের ব্যাখ্যাহীন প্রেক্ষাপটে নিজেকে দেখব, তখন কি সে বিষাদের ধুন বাজাবে অবিরাম জীবনে? একদম না। বাউলের একতারার মধ্যে একটা ভীষণ সহজ সুর আছে। সে আর কিছু না, প্রতিদিন সকালে এই ধুলোকাদা মাখা পৃথিবীর উপর এসে পড়া আলোর মত, সহজ আনন্দ। সেটুকু থাকবেই। যদি না চিন্তাকে লোলুপ হাঙরের মত আবার মাথার মধ্যে ছেড়ে দিয়ে বলি, বল তো চিন্তা আমি অসাধারণ নই?