এই বুকু, বুকু….
বুকু তো ঘুমিয়ে কাদা। ইঁদুরটা এসে কানের কাছে আবার ডাকল, এই বুকু... বুকু…
বুকু উঠে বসল ধড়মড় করে। খাটের উপর রাস্তা থেকে টুনি লাইটের আলো এসে পড়েছে। সারা রাস্তা জুড়ে লাইটিং হয়েছে তো!
বুকু বলল, কি রে এত রাতে?
ইঁদুর বলল, আরে প্যাণ্ডেলে আয় একবার।
বুকু বলল, এখন?
ইঁদুর বলল, আরে হ্যাঁ, হ্যাঁ… এখনই…..
বুকু লাইট জ্বালালো না। অন্ধকারে চুপি চুপি বাইরের দরজা খুলে এক দৌড়ে প্যাণ্ডেলে এসে হাজির।
একি রে বাবা! দেখে প্যাণ্ডেলে দুর্গা, অসুর, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক কেউ নেই। এমনকি মহাদেবের ছবিটাও নেই মাথার উপর। সব কোথায় গেল?
ইঁদুর বলল, ওরা সব নিকো পার্কে গেছে বুকু।
সিংহটা একপাশে শুয়ে শুয়ে ঝিমোচ্ছিল। বুকু জিজ্ঞাসা করল, ও ঝিমোচ্ছে কেন?
ইঁদুর বলল, আরে শুধু ও না, সবাই ঝিমোচ্ছে, দেখো, ওদের ধরে ধরে করোনার ভ্যাক্সিন দিয়ে দিয়েছে তো! সবার জ্বর এসে গেছে। তার মধ্যে পুরুত এত গঙ্গার জল 'ওম নমো... ওম নমো' করে ছিটিয়েছে যে ওদের সর্দি লেগে গেছে।
বুকু বলল, তোর কিছু হয়নি?
ইঁদুর বলল, আরে আমাকে তো আগেই দিয়েছে…. ওই গণেশ চতুর্থীতে এসেছিলাম না মুম্বাইতে… ওখানেই দিয়ে দিয়েছিল…
বুকু বলল, এখন?
ইঁদুর বলল, আরে প্যারাসিটামল খাওয়াতে হবে তো…. তোর কাছে আছে? ওরা আনছিল, রাস্তায় এত বৃষ্টি… সব ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে…..
বুকু বলল, আয় তুই আমার সঙ্গে... দাদুর ওষুধের ব্যাগে আছে…
ইঁদুর আর বুকু আবার বাড়ি এলো। দাদুর ঘরে চুপি চুপি ঢুকে ওষুধের ব্যাগটা নিয়েই ধাঁ করে আবার দৌড়।
সিংহ বলল, আমি কি করে গিলব? আমার তো গলায় ব্যথা…. যদি রসগোল্লা করে দেওয়া যায় আমি ভেবে দেখতে পারি…., নইলে কিন্তু আমি দুর্গাকে নিয়ে কাল দাঁড়াতে পারব না বলে রাখলুম…. ধমাস করে ফেলে দেব…. তারপর দশটা হাতে ব্যাণ্ডেজ বাঁধবে কে?
রসগোল্লা এত রাতে কোথায় পাওয়া যাবে?
হঠাৎ প্যাঁচা ঝিমোতে ঝিমোতে বলল, আমি জানি, ওই মণ্ডপের পিছনের দিকে একটা ফ্রিজ আছে, ওখানে এত্ত এত্ত রসগোল্লা আছে….. ওয়াক্... ইস্… এই জ্বরে কে ওসব গেলে বাবা….
বুকু তাড়াতাড়ি মণ্ডপের পিছনে গিয়ে ফ্রিজ খুলে একটা রসগোল্লা বার করতে যাবে…. দেখে প্যাঁচা, হাঁস, সিংহ, সাপ সব এসে গেছে…. এমনকি গলা কাটা মোষটাও গলা ডলতে ডলতে এসে দাঁড়িয়ে গেছে।
অগত্যা বুকু আর ইঁদুর সবাইকে রসগোল্লার মধ্যে একটা করে প্যারাসিটামল ভরে ভরে খাইয়ে দিল।
সবাই শুতে চলে গেল। বুকুও এসে ঘুমিয়ে পড়ল তার বিছানায়।
পরেরদিন সকালে মণ্ডপে গিয়ে দেখে হইচই পড়ে গেছে। রসগোল্লার হাঁড়ি থেকে সব রসগোল্লা গেল কোথায়?
বুকু চুপ করে বসে আছে। কাউকে কিছু বলছে না। একটু পরে মণ্ডপে উঠে ইঁদুরের পাশে গিয়ে বসল। ইঁদুরকে চুপিচুপি বলল, ব্যাপারটা কিরে?
ইঁদুর বলল, আর বলিস না। ওই অসুর আর গণেশ মিলে... যা হোক, আজ রাতে আয়... পিকনিক হবে……
বুকু দুপুরটা ভালো করে ঘুমিয়ে নিল। রাতে পিকনিক মানেই প্রচুর হুল্লোড়।
রাত দেড়টা নাগাদ বুকু প্যাণ্ডেলে গিয়ে দেখে প্যাণ্ডেল পুরো ফাঁকা। শুধু একটা প্রদীপ জ্বলছে, আর ফুলমালা সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বুকু ভাবল, যাঃ! এরা সব নিজেরাই বিজয়া করে চলে গেল নাকি?
মাথায় গোঁত্তা মারল কে একটা। বুকু কাউকে দেখতে পেল না। কেউ যেন হাওয়ায় বলে গেল, পিছনে মাঠে আয়।
বুকুর মাঠে গিয়ে তো চক্ষু ছানাবড়া। সারা মাঠ গিজগিজ করছে পাড়ার সব নেড়ি, বেড়াল, চড়াই, কাক, ব্যাঙ, সাপ ইত্যাদি ইত্যাদি। এরা তো আছেই ওদিকে সিংহ, ময়ূর, প্যাঁচাকেও দেখল। লক্ষ্মীর প্যাঁচা আবার পাড়ার প্যাঁচাদের সঙ্গে সেল্ফি তুলছে। সিংহ একটা ষাঁড়ের পিঠে হাত দিয়ে গেম খেলছে মোবাইলে। ময়ূর টিকটক করছে। হাঁস আর ইঁদুর খালি মাঠের ওদিকে গিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসছে দৌড় দিয়ে।
বুকুকে দেখেই ইঁদুর দৌড়ে এগিয়ে এসে বলল, এদিকে আয় বুকু।
বুকু ওদের সঙ্গে যাচ্ছে, হঠাৎ হাঁসটা কাঁধের উপর চেপে বলল, তুই ভয় পাবি না তো?
বুকু কিছু বোঝার আগেই দেখে তারা মাঠের শেষের দিকে এসে গেছে। মহাদেব বসে বসে চুরুট খাচ্ছে আর তার চারদিকে ভূতে ভূতে ছয়লাপ। স্কন্ধকাটা, কারোর চারটে হাত, পাঁচটা মুখ, ছটা জিভ, বারোটা চোখ, সারা গায়ে লোম। কেউ কংকাল। কারোর পেটের নীচ থেকে নেই। বুকুর ভয় লাগল না। বুকু বলল, কে রাঁধছে রে?
একটা ভূত এগিয়ে এসে বলল, কেন আমাদের মা ঠাকুরন। এই বলে সে একটা কাঁচের ফুটবল বার করল, তাতে ড্রোনের মত সারা মাঠের ছবি দেখা যাচ্ছে। দুর্গা রাঁধছে। কার্তিক আর লক্ষ্মী টিকটক করছে। গণেশ আর সরস্বতী গেম খেলছে। হঠাৎ চোখে পড়ল বুকুর, একি! একদল লোক ব্যাঙ্কের গেট ভাঙছে। মানে ডাকাত?
বুকু অমনি চীৎকার করে বলল, আরে শোনো শোনো... আমাদের পাড়ার ব্যাঙ্কে ডাকাত ঢুকে গেছে, আমাদের যেতে হবে এক্ষুণি।
অমনি মাঠে হইচই পড়ে গেল। দুর্গা সব শুনে মহাদেবকে বলল, তুমি যাও, আমি এদিকটা সামলাই।
বুকু দেখল মহাদেব উঠে দাঁড়িয়ে কি জোরে শিঙা ফুঁকল। অমনি সব পশুপাখি সার দিয়ে প্যারেড করার মত দাঁড়িয়ে পড়ল। ভূতেরা সবার আগে। মহাদেব সবার পিছনে। মহাদেব বলল, চলো এবার!!
সবাই কুচকাওয়াজ করতে করতে এগোলো। বুকু বুঝল এই জন্যেই মহাদেবকে সবাই পশুপতি বলে।
ওদিকে ওরা তো ব্যাঙ্কের দরজা ভেঙেটেঙে ঢুকে পড়েছে। ব্যাঙ্কের যে পাহারাদার ছিল, সে এতগুলো ডাকাত দেখে এমন দাঁতকপাটি লেগে পড়ে গেছে চিত্তির খেয়ে যে ডাকাতেরা তাকে কিছুই না করে একপাশে শুইয়ে ঢুকে পড়েছে। তার একটু জ্ঞান ফিরেছে কি ফেরেনি, সে যেই তাকিয়ে দেখে সামনে এতগুলো স্কন্ধকাটা, হাত-পা কাটা হেঁটে হেঁটে ব্যাঙ্কে ঢুকছে, তার সেই যে আবার দাঁতকপাটি লেগে চিত্তির লাগল, খুলল দশমীর দিন রাতে।
ডাকাতের সর্দার, ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের চেয়ারে বসে যেই না বলেছে, লাও... সোনা, রুপেয়া যো ভি হ্যায়, ভেট লাও।
অমনি মাথায় একটা গাঁট্টা মারল কে। হাওয়ায় খ্যানখেনে গলায় কে যেন বলে উঠল, মামাবাড়ি পায়া হ্যায়... যা পুলিশ স্টেশান যা কে জেল মে সো জা….
ম্যানেজারের সিটে বসা ডাকাতের সর্দার বলল, কেন আমি জেলে যাব রে আপদ... তুই কে রে?
আবার খ্যানখেনে গলা বলে উঠল, মহাদেব কা চেলা রে….
যেই না মহাদেবের নাম শোনা, অমনি সর্দার চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, আহা, কাঁহা হ্যায় প্রভু….
বলতে না বলতেই হুড়মুড়িয়ে সব পশুপাখি ব্যাঙ্কে ঢুকে গেল। সে এক হুলুস্থুলু ব্যাপার। ডাকাতেরা সিঁটিয়ে দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে। কেউ ঠোকরাচ্ছে তাদের, কেউ কান মুলে দিচ্ছে, কেউ নাক কামড়ে দিচ্ছে, কেউ লোফালুফি খেলছে, কেউ কাতুকুতু দিচ্ছে।
ওদিকে সর্দার তো মহাদেবকে দেখে পায়ের তলায় লুটোপুটি খাচ্ছে। আর মহাদেব বলছে, 'ওরে ছাড়, ছাড়! আমার পায়ে সুড়সুড়ি লাগছে'। কিন্তু কে শোনে কার কথা! শেষে একটা মামদো বলল, আচ্ছা, সর্দারের ঘাড়টা মটকে দিয়ে আমাদের দলে নিয়ে নিই প্রভু?
এই কথা শুনে অমনি সর্দার উঠে বসে পড়ল সটান। মহাদেব বলল, যা এসব বাজে কাজ না করে বাড়ি যা। কাল ভোরে উঠে ভালো কাজ খুঁজতে বেরো। পেয়ে যাবি।
ব্যাঙ্ক ডাকাতি আটকে সব আবার মাঠে ফিরল। হইহই করে পিকনিক হল। কি মজা যে হল!
দু'দিন পরে বুকু দেখল সর্দার একটা বড় ঠেলাগাড়ি নিয়ে শাকসব্জী বিক্রি করতে করতে যাচ্ছে। বুকু ঠাকুর্দার সঙ্গে ব্যাঙ্কে যাচ্ছিল। সর্দারকে বলল, তুমি আমাদের বাড়ি এক কিলো টমেটো আর পিঁয়াজ দিয়ে এসো, আমি মাকে ফোন করে দিচ্ছি। আর বাকিরা কোথায়?
সর্দার একগাল হেসে বলল, ওরাই সব চাষ করছে এখন ক্ষেতে।
বুকু বলল, আচ্ছা। এই বলে সে ব্যাঙ্কে ঢুকল ঠাকুর্দার হাত ধরে। ঠাকুর্দা বলল, ওরা মানে কারা বুকু?
বুকু গম্ভীর হয়ে বলল, সে আছে।
(ছবি: Suman)