সৌরভ ভট্টাচার্য
11 April 2020
১
---
বাঘের গল্প কেউ বলতে পারে না। কেউ না। কেউ না। কেউ না। সবাই বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা কথা বলে।
তাই হল কি বুকু রেগেমেগে ঠিক করল জঙ্গলে গিয়ে এক্কেবারে বাঘের মুখ থেকেই বাঘের গল্প শুনবে। বুকু বাড়ি থেকে জঙ্গলে যাবে কি করে? এই এক ভাবনা। বুকুর বাড়িতে বুকুর ঠাকুমা, ঠাকুর্দা, বাবা, মা, পিসি, কাকা, কাকি --- কত্তো লোক! কিন্তু এরা কেউ তাকে জঙ্গলে নিয়ে যাবে? কেউ না। বুকু ক্লাস থ্রিতে পড়ে। এমন কিছু ছোটোও নয় যে তাকে জঙ্গলে নিয়ে যেতে হবে কাউকে হাতে ধরে। সে গাছে চড়তে পারে, সাঁতার কাটতে পারে, দৌড়াতে পারে, ঝাঁপ দিতে পারে। তবে? আর কি চাই? জঙ্গলে গিয়ে এগুলোরই দরকার বেশি।
বুকুর বাড়ি থেকে জঙ্গলের রাস্তাটা সোজা। কিন্তু অনেকটা সময় লাগে। বাস যায়। রাতে একটা বাস, দিনে একটা বাস। বুকু ঠিক করল সে দিনের বেলার বাসেই যাবে। কিন্তু বাসে উঠতে গেলেই তো নানা লোকে নানা প্রশ্ন করবে। এত ছোটো বাচ্চা কোথায় যাচ্ছে? কেন যাচ্ছে? সাথে কে? উফ্..., কেন যে বড়রা এত প্রশ্ন করে! তবে কি ভাবে যাবে?
বুকু বাড়িতে দু’দিন কোনো দুষ্টুমি করল না। এখন শান্ত হয়ে থাকতে হবে। কেউ যাতে বেশি নজরে না রাখে তাকে। বুকুর একটা নিজের ঘর আছে। সেখানে সে ধীরে ধীরে, সবাইকে লুকিয়ে ব্যাগপত্তর গুছিয়ে রাখতে শুরু করল। এখন শুধু সুযোগের অপেক্ষা।
সুযোগ এসেও গেল, একদিন সকালে বাড়িতে পাড়ার অনেক লোক এসেছে, সবাই ব্যস্ত। বুকু চুপিচুপি তার ব্যাগটা নিয়ে বাড়ির দরজাটা খুলে গলি দিয়ে বেরিয়েই দে ছুট। বাড়িতে পুজোর মিটিং হচ্ছে। পাড়ার সবাই এখন অনেকক্ষণ হইচই করবে। কেউ তার দিকে খেয়ালই রাখবে না। আর জঙ্গলে পৌঁছাতে তার বড় জোর দু-ঘন্টা লাগবে। তারপর আর তাকে পায় কে!
বড় রাস্তায় আসতেই একটা মোটা লোক বাইকে করে আসছে দেখল বুকু। বুকু লোকটাকে হাত দেখিয়ে থামতে বলল। লোকটা দাঁড়িয়ে ভুরু কুঁচকে তাকে জিজ্ঞাসা করল, কেয়া হ্যায়?
বুকু বলল, আপ মুঝে মৌসিকে ঘর মে ছোড় দেগা?
লোকটা আশেপাশে আর কাউকে না দেখতে পেয়ে বলল, তুম আকেলি হো?
বুকু বলল, হাঁ, মেরে বাস ছুট গেয়ি, মুঝে উহা জানা হি হ্যায়..., এই বলে বুকু একটু হাত পা ছুঁড়ে রাস্তাতেই দাপাদাপি করে নিল। প্রায় কেঁদেই ফেলে আরকি।
লোকটা ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, ঠিক হ্যায়। আ যাও।
বুকু এক গাল হেসে, ‘ঠিক হ্যায়’, বলে বাইকের পিছনে বসে পড়ল।
বাইক চলতে শুরু করল। লোকটা গান গাইছে, ইয়ে দোস্তি হম নেহি ছোড়েঙ্গে... বুকুর লাল ফ্রকের সবুজ ফুলগুলো হাওয়ায় ফুরফুর করে উড়ছে। তার পিঠের ব্যাগটা যেন হাওয়ার টানে পিছনে চলে যেতে চাইছে বুকুকে নিয়ে। বুকু শক্ত করে বাইক আঙ্কেলকে জড়িয়ে ধরল। তার ব্যাগে একটা ছুরি, চার প্যাকেট বিস্কুট, একটা জলের বোতল, চারটে ফ্রক, একটা বোরোলিন আর একটা চাদর আছে।
চারদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়। ফাঁকা ফাঁকা রাস্তা। এ রাস্তাটা খুব চেনা বুকুর। তার মনটা কি আনন্দে ভরে উঠছে। মায়ের মুখটা একবার মনে পড়ল। কিন্তু খারাপ লাগল না, সে তো একটা চিঠি লিখেই রেখে এসেছে তার বালিশের তলায়।
মা,
তোমরা ভেবো না। আমি জঙ্গলে যাচ্ছি। সত্যি বাঘের গল্প শুনেই চলে আসব। বাবাকে, ঠাম্মিকে, ঠা’দাকে বোলো যেন আমায় নিয়ে চিন্তা না করে। আমি ভালো বাঘ চিনি। তার সাথেই থাকব। কয়েকদিন থেকেই ফিরে আসব।
ইতি বুকু
বাইকটা জঙ্গলের সামনে আসতেই বুকু বলল, ইহা ইহা, রুকিয়ে, হমে উতর না হ্যায়।
বাইকটা দাঁড়ালো। বুকু বাইক থেকে নেমে লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ব্যাগ থেকে একটা বিস্কুটের প্যাকেট বার করে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, আঙ্কেল আপ লিজিয়ে, থ্যাঙ্ক ইউ লিফট কে লিয়ে।
লোকটা হেসে বলল, উয়ো বাত তো ঠিক হ্যায়, পর তুমি যাওগি কিধার?
বুকু সামনের দিকে একটা বাড়ি দেখিয়ে বলল, উয়ো যো হরা কালার কা মাকান হ্যায় না, উহা।
লোকটা ‘ঠিক হ্যায়’ বলে, বিস্কুট নিয়ে চলে গেল।
বুকু জানে সামনের ওই বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে একটা রাস্তা সোজা জঙ্গলের দিকে চলে গেছে। কিন্তু ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়া যাবে না, ওইদিকে গেলেই এ-ও প্রশ্ন করতে পারে। বুকু তাই উল্টোদিকের মাটির রাস্তাটা দিয়ে এগোলো। এইদিকে কিছুটা গেলে একটা পিকনিক স্পট। এই পিকনিক স্পটে সে তার বাড়ির সবাই মিলে কতবার এসেছে!
তারপর তারের বেড়া। বেড়া পেরিয়েই জঙ্গল।
* * * * *
সন্ধ্যে হতে দেরি আছে। বুকু জঙ্গলের মধ্যে অনেকটা চলে এসেছে। একটা ঝরনা সামনে। তার পাশে একটা গাছ বাঁকাভাবে উঠে আবার সোজা হয়ে গেছে। বুকুর গাছটা বেশ পছন্দ হল। এই গাছটাতেই রাতটা কাটানো যাবে।
বুকু গাছটার কাছে এসে দাঁড়ালো। কি গাছ বুঝল না। ব্যাগটাকে আরেকবার শক্ত করে পিঠের সাথে লাগিয়ে গাছটায় চড়ার প্রস্তুতি নিল। ধীরে ধীরে গাছটা বেয়ে উঠছে, এমন সময় কে যেন একটা পাশ থেকে বলল, "পিছল আছে, দেখে উঠিস।"
বুকু হামাগুড়ি দিয়ে উঠছিল প্রায়। ওঠাটা থামিয়ে এদিক ওদিক একবার তাকিয়ে দেখল, ভুল শুনল? না তো! স্পষ্ট শুনল। আবার উঠতে যাবে, সেই গলা, "দেখিস আমার বাসা আছে কিন্তু উপরে, তিনটে বাচ্চা আছে, একটার আবার জ্বর, ঘুমাচ্ছে, আস্তে আস্তে ওঠ।"
বুকু এইবার দেখতে পেল। একটা ইয়াব্বড় হলুদ ঠোঁট পাখি ঝরনায় স্নান করতে করতে তার দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। বুকু বলল, আমায় চেনো তুমি?
পাখিটা বলল, এই জঙ্গল থেকে সাতাত্তর মাইলের মধ্যে আমি সবাইকে চিনি। তোর বাড়ির আচার কতবার খেয়েছি। এবারে আচার বানাসনি কেন রে তোরা?
বুকু অবাক হল। এত কিছু জানে পাখিটা?
বুকু বলল, ঠাম্মির চোখ অপারেশান হয়েছে তো, তাই আচার করেনি, ওসব তো ঠাম্মিই করে।
পাখিটা ডানা ঝাপটিয়ে জলগুলো ফেলে একটা পাথরের উপরে এসে বসল, তারপর বলল, ও... যা, তুই ডানদিকের ডালে উঠে যা, বাঁদিকের ডালে আমার বাচ্চাগুলো আছে। কাল পরিচয় করিয়ে দেব বুঝলি?
বুকু বলল, আচ্ছা। সে ডানদিকের ডালে একটা বড়সড় খাঁজে গিয়ে আরাম করে বসল। ব্যাগটা ঝোলাতে যাবে একটা সরু ডালে, হঠাৎ ‘কিচকিচ’ আওয়াজ, ভালো করে তাকিয়ে দেখল, একটা পিঁপড়ের সারি, তারা বলল, "ওইদিকের ডালে ব্যাগটা রাখো না, আমরা চাপা পড়ে মরে যাব তো?"
একটা পিঁপড়ে ব্যাগটার উপরে উঠে বলল, "কি আছে গো তোমার ব্যাগে, কিরকম মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ বেরোচ্ছে একটা।"
বুকু বলল, বিস্কুট আছে, খাবে?
সবাই একসাথে বলে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ, বিস্কুট খাবো... কি মজা, কি মজা...
বুকু একটা বিস্কুট কয়েক টুকরো করে গাছের একটা কোটরে রাখল। সব পিঁপড়েরা সার বেঁধে সেদিকে যেতে শুরু করল। তারপর টুকরো টুকরো বিস্কুটের কণা মুখে নিয়ে আবার সার বেঁধে ফিরতে শুরু করল। একটা পিঁপড়ে তার ছোট্টো শুঁড় উঁচিয়ে বলল, ধন্যবাদ।
একটা বড় গুবরে পোকা পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, সে বলল, কি যে সব ছাইভস্ম খাস তোরা, ওসব খেলে পেট ছাড়বে যে। তোরা এতগুলো পিঁপড়ে মিলে যদি সারাটা গাছ পায়খানা করে রাখিস, আমরা টিকতে পারব? এমনিতেই হতচ্ছাড়া মানুষগুলো গাছ কেটে কেটে হয়রান করে দিল। বলেই সে বুকুর দিকে তাকালো।
বুকু বলল, সে অন্য মানুষ, আমি না।
গুবরে পোকা বলল, ওই হল।
ইতিমধ্যে বড় হলুদ ঠোঁট পাখিটা নিজের ডালে এসে গেছে, এসেই বলল, "বুকু বাচ্চাগুলো জেগে আছে, আয় দেখা করে যা।"
বুকু বড় গাছের ডালটা হাতড়ে হাতড়ে পাখিটার বাসার কাছে গিয়ে মুখ বাড়ালো। ওমা...! কি সুন্দর বাচ্চাগুলো...!!! তার দিকে তাকিয়ে, মাথা উঁচু করে, ‘চিঁ চিঁ’ করে ডাকতে লাগল। মা পাখিটা বাচ্চাগুলোকে বলল, "এখন কোলে ওঠে না। ও ক’দিন জঙ্গলে থাকুক, শরীর থেকে শহরের জীবাণুগুলো যাক, তারপর কোলে উঠবে, কেমন?"
বাচ্চা পাখিগুলো চিঁ চিঁ করে মাথা নীচু করে বসে পড়ল সবাই আবার।
"আর শোন", বলে পাখিটা বুকুর দিকে তাকালো, "তুই কিন্তু তোর ওইসব খাবার এদের দিস না। ওরা এখন বাইরের খাবার খাবে না। আগে বড় হোক তারপর তো বাইরের খাবার খেতেই হবে"।
বুকু বলল, আচ্ছা। বলে সে আবার নিজের জায়গায় এসে শুলো। তার মনটা একটু খারাপ লাগছে, ইস্... যদি মায়ের মোবাইলটা আনা যেত, তবে একটা সেলফি তোলা যেত বাচ্চাগুলোর সাথে। কি কিউট না বাচ্চাগুলো?
সন্ধ্যে হয়ে আসছে। কত চেনা অচেনা পাখি সব তাদের বাসায় ফিরছে। সারাটা জঙ্গল জুড়ে কিচিরমিচির আওয়াজ। কেউ কেউ এসে বুকুর সাথে পরিচয়ও করে গেল। সে কোন স্কুলে পড়ে, কেন জঙ্গলে এসেছে, এই গাছেই থাকবে কিনা, বাড়িতে কে কে আছে, রাতে সে কি খায়, দিনে কি খায় - কত প্রশ্ন সবার। তারপর সন্ধ্যেটা একটু গাঢ় হতে না হতেই সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। প্রায় নিস্তব্ধ জঙ্গল তখন।
বুকুরও অল্প অল্প ঘুম পাচ্ছে। আর না ঘুমিয়েও বা কি করে, ভিডিও গেমটা সাথে নিয়ে এলে হত। ভুল হয়ে গেল। আসলে একা একা নিজের জিনিস গোছাইনি তো কোনোদিন, ভুল হবে না?
বুকু ব্যাগ থেকে চাদরটা বার করে, নিজেকে গাছের ডালের সাথে শক্ত করে বেঁধে ঘুমিয়ে পড়ল।
জঙ্গলের চারদিকে নানা আওয়াজ। ঝরনার জলের আওয়াজ। দূরে বাঘের গর্জনও শোনা গেল একবার। বুকু তখন গভীর ঘুমে, শুনতে পেল না। তার স্বপ্নের জগতে সে অন্য একটা জঙ্গলে গেছে তখন। কিন্তু বাঘের দেখা পাচ্ছে না। সব বাঘ নাকি সার্কাসে চলে গেছে। বুকু স্বপ্নের মধ্যেই মন খারাপ করে ফেলল।
মাঝরাতে একটা বিকট আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল বুকুর। কিসের আওয়াজ বুঝতে পারল না। খানিক এদিক ওদিক তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনটা কি ভালো হয়ে গেল। মুখের ওপর চাঁদের আলো এসে পড়েছে গাছের ডালপালা ভেদ করে। যেন সে বুকুর বাড়ি থেকে দেখতে এসেছে তাকে, মা পাঠিয়ে দিয়েছে, বলেছে - যা তো বুকুকে দেখে আয়, আজ আর আমাদের ছাদের উপর থাকতে হবে না।
আজ মনে হয় পূর্ণিমা। বুকু গাছের নীচটায় তাকালো। না, কোনো বাঘ তো নেই এখনও। রাতে বাঘ আসে না? আসার তো কথা। তবে কি এখানের বাঘগুলোও সব সার্কাসে চলে গেছে? বুকু আর ভাবতে পারল না। তার আবার খুব ঘুম পাচ্ছে। বাঘের কথা কাল সকালে ভাবা যাবে। বুকু আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
বুকু ঘুম থেকে উঠল। কিন্তু ক’টায় উঠল বুঝতে পারল না। বুঝবেই বা কি করে, জঙ্গলে গাছে ঘড়ি ঝোলানো থাকে নাকি, আর মোবাইলও নেই সাথে। যা হোক, সে উঠেই দেখল গাছে কেউ নেই। হলুদ ঠোঁট পাখিটা নেই। পিঁপড়ের সারিটা নেই। না, একটা কাক তো আছে, সে দূরের একটা ডালে বসে কিছু একটা খাচ্ছে। খেয়াল করেনি বুকুকে সে। বুকু আড়ামোড়া ভেঙে চারদিক তাকালো। এখন কি করবে সে? কি আবার করবে অবশ্যই বাঘ খুঁজতে বেরোবে। তবে তার আগে একবার পাখির বাচ্চাগুলোকে দেখবে না?
বাচ্চাগুলোকে দেখবার কথাটা ভাবতেই তার শরীরে একটা রোমাঞ্চ খেলে গেল। সে তাড়াতাড়ি চাদরটা ভাঁজ করে ব্যাগের মধ্যে ভরে যেই না ওই ডালটার দিকে এগোতে যাবে, অমনি কাকটা এসে সামনে বসে পড়ল, বলল, কোথায় যাচ্ছ?
বুকু বলল, ওই বাচ্চাগুলোকে দেখতে, কি সুইট না?
কাক বলল, সে যতই সুইট হোক, এখন তুমি যেতে পারবে না।
বুকু বলল, কেন, আর তুমিই বা কে যে আমাকে বারণ করছ?
কাক বলল, আমি বাচ্চাগুলোর মা চলে গেলে ওদের দেখাশোনা করি, তাইতেই আমার সংসার চলে। আমার বাড়িতে আমার বাবা, মা, দুটো বাচ্চা, বউ, কাকু-কাকিমা, শ্বশুর-শাশুড়ি, শালা...
বুকু বলল, হয়েছে আর বলতে হবে না, তুমি তোমার গুষ্ঠি নিয়ে গাছে থাকো, বললেই হয়।
কাকটা বলল, ধুর, বললেই হয় নাকি, ওই যে পাকুড় গাছটা দেখছ, ওর উল্টোদিকে একটা শিশুগাছ আছে। সে গাছ নামেই শিশু, এমনিতে যা বড়ো! ওই গাছে হতচ্ছাড়া কোকিলের দল থাকে, আমাদের সাথে যে কি শয়তানি করে কি বলব। এই গেলবার, আমার বউয়ের তিনটে ডিম ফুটে তিনটে বাচ্চা হল। তা আমি নাম রেখেছি, কুলু, মুলু আর পুলু... শেষে দেখি কিনা... মুলু..., এই বলে কাকটা ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কান্না জুড়ে দিল।
বুকু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, কি হয়েছে, মুলুকে বাঘে খেয়ে নিয়েছে?
অমনি কাকটা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল, বাঘে খাবে কেন রে হতচ্ছাড়া মানুষের বাচ্চা...
বুকু গম্ভীর হয়ে বলল, আমার একটা নাম আছে, বুকু, তুমি তাই বলে ডেকো।
কাকটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আচ্ছা সরি, তা বুকু, আসলে মুলু তো কাকই নয়... সে যে কোকিল... কি বিটকেল গলার আওয়াজ গো..., এই বলে কাকটা আবার কাঁদতে শুরু করে দিল। বুকু বলল, তা কি হয়েছে, মুলু কি তোমায় বাবা বলে ডাকে?
না তো...
তোমার বউকে মা বলে ডাকে?
না তো... সে তো উড়ে গিয়ে ওই শিশুগাছে থাকে এখন। ডাকলেও আসে না। আমরা অবশ্য আর ডাকতেও চাই না। বলেই কাকটা মন খারাপ করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকল। বুকুও কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে গেল।
হঠাৎ কাকটার মুখের ভাব বদলে গেল, সে বলল, তা তুমি এ জঙ্গলে কেন বলো দেখি?
বুকু বলল, বাঘের সাথে আমার কিছু কথা আছে।
কাকটা চিন্তিত হয়ে পড়ল। বলল, কিন্তু উনি তো এখন বড় একটা কথা বলেন না। কেমন জানি গম্ভীর হয়ে গেছেন। মাঝে মাঝেই বলেন হিমালয়ে চলে যাবেন, সাধন ভজন করবেন।
বুকু বড় বড় চোখ করে বলল, এই যা, চলে গেছেন?
কাক বলল, আরে ধুর, ওরকম বললেই চলে যাওয়া যায় নাকি, একে সারা গায়ে হাতে পায়ে বাতটাত তো আছেই, তার উপর পাসপোর্টের ঝামেলা। ওসব জঙ্গলে যাওয়ার জন্য আগে স্বাস্থ্যপরীক্ষা হয়, অনেক প্রশ্ন করে, তবে যাওয়ার অনুমতি মেলে।
বুকু বলল, বেশ, আমি একটু ওই হলুদ ঠোঁট বাচ্চাগুলোকে দেখতে পারি?
কাক বলল, একেবারে না। ওদের মা এলে তবে সে যা ভালো বোঝে করবে, আমি নই।
হঠাৎ একটা ডাক শোনা গেল। কাক সেই ডাক শুনেই তাড়াতাড়ি বলে উঠল, তুমি বাঘের সাথে দেখা করতে যাবে বলছিলে তো, ওই যে হাতির দল আসছে, তুমি এক কাজ করো, ওদের সাথে চলে যাও, ওরা সপ্তাহে একবার বাঘের টিলার পাশ দিয়ে উত্তরের জঙ্গলে যায়। তাড়াতাড়ি যাও।
বুকু পিছন ফিরে দেখল সত্যি একদল হাতি তাদের দিকে আসছে। সে তাড়াতাড়ি নিজের ডালের দিকে ফিরতে যাবে, হঠাৎ কাকটা ডেকে বলল, এই শোনো...
বুকু ফিরে তাকালো।
কাকটা লজ্জা লজ্জা মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে, একটু একটু আড়চোখে তাকে দেখছে।
বুকু বলল, কি বলবে বলো?
কাকটা বলল, লজ্জা লাগছে...
বুকু বলল, আর লজ্জা পেতে হবে না, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, বলো...
কাকটা একটা ডালের আড়ালে চলে গিয়ে একটা ডানা বার করে বলল, আমায় দুটো বিস্কুট দেবে? আমি বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সবাইকে...
বুকু বলল, এই কথা, এক্ষুনি দিচ্ছি...
বুকু যেই ব্যাগ খুলতে গেল, অমনি কাকটা তার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যেতে যেতে বলল, তুমি বার করতে থাকো, আমি হাতিদের সাথে তোমার কাজের কথাটা সেরে আসি।
কাক একটু পরেই ফিরে এসে বলল, দাও বিস্কুট দাও, হাতিরা রাজি হয়ে গেছে বুঝলে, বেশ একটা হিল্লে করে দিলাম তোমার, কি বলো?
বুকু চারটে বিস্কুট কাককে দিল। কাক বলল, চারটে!! বাহ বাহ!
বুকু বলল, তুমি আর কোকিলকে নিয়ে মন খারাপ কোরো না, বুঝলে?
কাক বলল, হুম। তুমি কিছু মনে কোরো না হ্যাঁ, তোমায় বাচ্চাগুলোকে দেখতে দিলাম না বলে, আসলে চাকরির ব্যাপার, বুঝছই তো..
ইতিমধ্যে হাতির দল গাছের নীচে চলে এসেছে। বেশ মিহি একটা ডাক ছাড়ল একটা বড় হাতি। কাক বলল, ওই দলের নেতা, তুমি ওর পিঠে চড়ে যাও।
বুকু আচ্ছা, বলে এগিয়ে গেল।
* * * * *
হাতির দলের যে দলপতি বুকু তার পিঠের উপর বসে। বেশ সুন্দর মিঠে রোদ বুকুর শরীরকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে। একটা ভুল হয়ে গেছে, তাড়াহুড়োতে বুকু পেস্ট আর ব্রাশটা আনতে ভুলে গেছে। হাতিকে সে কথা বলতেই হাতি বলল, বেশ তো, আমি একটা বড় নিমগাছের তলা দিয়ে যাব, তুমি একটা ডাল ভেঙে নিয়ো, তারপর বাঘের টিলার নীচে যখন নামিয়ে দেব তখন তুমি নদীতে মুখ ধুয়ে নিও।
বুকু বলল, ওমা, বাঘের টিলার নীচে নদী আছে বুঝি?
হাতি বলল, আছে তো। তবে কি জানো মানুষেরা এখানে সেখানে বাঁধ দিয়ে, গাছ কেটে সারা জঙ্গলের এমন অবস্থা করে দিয়েছে না, না তো আছে নদীতে আগের মত জল, না তো জলের সেই স্বাদ। কি বলি বলো।
বুকু চুপ করে আছে। তার মন খারাপও হচ্ছে, রাগও হচ্ছে নিজের উপর। কেন সে মানুষ হল, তবে তো এ সব দোষের ভাগ তাকে নিতে হত না।
হাতি বলছে, আগের মত খাওয়াও পাই না আমরা জানো তো এখন। অগত্যা তোমাদের শহরে, গ্রামে ঢুকতে হয়। তোমরা রেগে যাও, আমাদের ক্ষেপাও, মারধোর করো, ভয় দেখাও। কিন্তু আমাদের এখানে পর্যাপ্ত খাবার থাকলে আমরা কেন মিছিমিছি তোমাদের বিরক্ত করতে যাই বলো?
বুকু চুপ করে আছে। তার মনে পড়ছে, সত্যিই তো তাদের ওখানেও হাতি ঢুকে পড়লে সবাই কি হেনস্থা করে হাতিগুলোকে! টিভিতেও দেখেছে, গাছ কাটার কথা, বৃষ্টি কমে যাওয়ার কথা, উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরুতে বরফ গলে যাওয়ার কথা – এসবই কি মানুষের দুষ্টুমির জন্য? কিন্তু সব মানুষ তো দুষ্টু নয়! তার দিদা-দাদু কত গাছ লাগায়। যদিও দাদু মারা গেছে দু’মাস আগে, দাদুর কত বড় বাগান আছে। দাদুর কথাটা মনে পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। মা রাতে উঠে দাদুর জন্য কাঁদে, সে দেখেছে।
হঠাৎ খেয়াল করল, তারা দাঁড়িয়ে গেছে। হাতি বলল, নাও, ডাল পেড়ে নাও।
বুকু মাথা তুলে দেখল সত্যিই একটা বড় নিমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে তারা। দূরে একটা গাছে কিছু হনুমান তাদের দিকে তাকিয়ে। একটা হনুমান ভ্যাঙালো বুকুকে। বুকুও ভ্যাঙালো। হনুমানটা আবার ভ্যাঙালো, বুকুও ভ্যাঙালো। হাতি বলল, উফ্..., কেন তুমি ওদের দিকে তাকাচ্ছো, তোমার স্কুলে যারা বেশি দুষ্টুমি করে, তাদের কি বলে স্যারেরা দিদিমণিরা?
বুকু হনুমানদের ভ্যাঙাতে ভ্যাঙাতেই বলল, হনুমান বলে, বাঁদর বলে... সে তো আমাকেও বলে...
হাতি বলল, তুমি কি হনুমান?
বুকু বলল, তা নই, তবে দুষ্টু।
হাতি একটা সরু ডাল শুঁড়ে করে পিঠের দিকে বাড়িয়ে বলল, এই নাও, আর ব্যাগটা চেপে ধরে বোসো নইলে ওরা ছোঁ মেরে নিয়ে চলে যেতে পারে।
বুকু ব্যাগটা বুকের কাছে একহাতে চেপে আরেকটা হাতে নিমের ডালটা মুখে নিয়ে চিবোতে চিবোতে বলল, কেন আসবে? ওরা তোমায় ভয় পায় না?
হাতি বলল, যখন তোমাদের ক্লাসে কোনো রাগী দিদিমণি বা স্যার আসেন, তখনও কোনো ছেলেমেয়ে দুষ্টুমি করে না?
বুকু বলল, করে তো, পমি আস্তে আস্তে আমার পাছুতে চিমটি কাটে...
হাতি গা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসতে লাগল...
বুকু বলল, অতো জোরে হেসো না, আমি পড়ে যাব... কি দুলছ তুমি...!
এমন সময় হঠাৎ সামনের হাতিগুলো, ওই ওই..., বলে চীৎকার করতে শুরু করল, চারদিকে গাছগুলো কেঁপে কেঁপে উঠতে শুরু করল। বুকু কিছু বোঝার আগেই কিছু একটা তার হাতের থেকে ব্যাগটা ছোঁ মেরে নিয়ে চলে গেল।
টিলার নীচে বুকুকে নামিয়ে দিল হাতিটা। বুকুর চোখটা ছলছল করছে। হাতি বলল, তুমি ভেবো না, আমরা সন্ধ্যের মধ্যেই ব্যাগটা নিয়ে চলে আসব। তুমি সাবধানে টিলায় ওঠো। তবে আগে যাও, নদীতে মুখটুখ ধুয়ে নাও, নিমকাঠিটা ফেলে দিও।
বুকু মাথা নাড়ল। কাল থেকে সেই লাল ফ্রকটা পরে আছে। ময়লা হয়ে গেছে। এই অবস্থায় কেউ বাঘের সাথে দেখা করতে যায়? সেটা ভালো দেখায়? যাবে না ঠিক করল বুকু। আজ রাতটা সে এই টিলার নীচেই থাকবে, সন্ধ্যের মধ্যে যদি ব্যাগ পেয়ে যায় ভালো, নইলে কাল সকালে উঠে ভাববে কি করা যাবে।
বুকু এক পা এক পা করে নদীর ধারে এলো। মনটা কেমন পর্দা টানা ঘরের মত অন্ধকার হয়ে গেছে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। ব্যাগটা বুকুর খুব প্রিয়। মাত্র চারদিন স্কুলে নিয়ে গেছে। সবসময় ভয় হত, যদি ছিঁড়ে যায়! আর সেই ব্যাগ কিনা হনুতে নিয়ে গেল! উফ্... মানা যায়! কেন যে অমন ঘাবড়িয়ে গেলাম? তা না ঘাবড়ানোরই বা কি আছে? গেলবার পুজোর আগে কি হয়েছিল বাড়িতে মনে নেই তার? বুকুর মা ভাত চাপিয়ে অন্য ঘরে গেছে, ও মা! এর মধ্যে দু-তিনটে এত্ত বড় বড় হনু ঢুকে পড়েছে রান্নাঘরে! এই শিশি ধরে টানে তো সেই কৌটো খুলে মেঝেতে ছড়ায় সব। বাড়িশুদ্ধ লোক একেবারে তটস্থ। কেউ এগোতে পারছিল না। বুকুকে একটা ঘরে আটকে রেখে গেল পিসি। সেই ঘরের জানলা থেকে অল্প একটুখানি দেখা যায় রান্নাঘরের। বুকু তাই দিয়েই দেখছিল সব্বাই কি হুজ্জুতি করে সে হনুমানের দলটাকে তাড়িয়েছিল। তবে? আর এখানে তো সে একাই ছিল। ভয় পাবে না? এসব কথা মনে মনে ভেবে যতই নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করুক না কেন বুকু, ব্যাগের জন্য শোকটা কি একটুও কমছিল? উঁহু, একটুও না।
বাহ! কি সুন্দর নদীটা তো! কি স্বচ্ছ জল। যদিও জলে ভয় বুকুর, মা ছাড়া কোনোদিন পুকুরে স্নান করতে নামেনি। কিন্তু এখন তো সে সব ভাবলে চলবে না, না নেমে তো কোনো উপায়ও নেই। নোংরা হদ্দ হয়ে তো বাঘের কাছে যাওয়া যায় না।
যা হোক বুকু জলটা একটু ছুঁয়ে দেখার জন্য যেই না এগোতে যাবে অমনি কে একটা হেঁড়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, এই বোকা মেয়ে, ওইদিকে ঘাট আছে নাকি? উল্টে পড়বি যে রে, আরেকটু ঘুরে ওই বড় পাথরটার পাশ দিয়ে নাম।
বুকু পিছন ফিরে কাউকে দেখল না প্রথমে। তারপর একটু খেয়াল করে দেখল গাছের উপর একটা সারস বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বুকু বলল, তুমি কথা বললে আমার সাথে?
সারস বলল, উঁহু, আমি না, ও বলল..., বলে সারস তার সামনের একটা ঝোপের দিকে ইঙ্গিত করল।
বুকু ভালো করে তাকিয়ে দেখল ঝোপের অন্ধকারের মধ্যে একটা ভাল্লুক বসে। এমন অন্ধকারে মিশে আছে যে তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না কেউ ওখানে বসে আছে।
বুকু বলল, তোমাদের কাছে গামছা আছে?
অমনি ভাল্লুকটা খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল। বলল, দেখছ আমরা জঙ্গলে জামাকাপড়ই পরি না, তায় গামছা, কিন্তু কেন?
বুকু বলল, একটু স্নান করতাম।
সারস বলল, বেশ তুমি স্নান করে নাও, ফ্রকটা আমায় দাও, আমি তোমার গা মোছার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
বুকু বলল, জামা খুলে স্নানে নামব? ধুর তাই হয় নাকি? বাথরুম কই?
ভাল্লুক বলল, বোকা মেয়ে, জঙ্গলে নাকি বাথরুমে স্নান করবে... আরে নেমে পড়ো, আমরা তো সবাই অমনিই নামি, ওই যে জলে যে মাছগুলো ঘুরছে ওরা কি সুইমিং কস্টিউম পরে ঘুরছে...? বোকা কোথাকার!
বুকু বলল, এই শোনো তুমি আমায় বোকা বোকা বলছ কেন গো? আমি বুকু, তোমাদের জঙ্গলে আমি নতুন না? আমার সেজোপিসি যখন আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছিল, কে তাকে বলে দিয়েছিল, কোথায় টয়লেট, কোথায় পটি করে হাতে দেওয়ার সাবান, কোন কলে গরম জল, কোন কলে ঠাণ্ডা জল! তাই বলছি, আমি না নতুন, তুমি বোকা বোকা বলবে না অমন, বুঝেছ?
ভাল্লুকটা একটা লম্বা হাই তুলে বলল, বোকা বুকু!
বুকু বলল, এ তো আচ্ছা বদ ভাল্লুক দেখছি!
সারস বলল, তুমি স্নানে যাও বুকু, ও তোমায় মিছিমিছি খেপাচ্ছে!
বুকু তাই করল, স্নানে নামল। নদীর জলটা দারুণ ঠাণ্ডা। মাথা ডুবিয়ে স্নান করতে ইচ্ছা করল, কিন্তু যদি কানে জল ঢুকে যায়? যা হোক, পুরো করেই নেওয়া যাক, পরে দেখা যাবে কি হয়, তাছাড়া বুকু এখন অনেক বড়। সে কি আর থ্রি এর বাচ্চা শুধু?
বুকু জলে ডুব দিল তিনবার। মনে মনে বলল, বারবার তিনবার। জলের নীচে কত রঙের পাথর, পিছল কিন্তু দারুণ চকচক করছে। কয়েকটা পাথর হাতে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিল পাড়ের দিকে। পাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখে সারসটা দুটো সুপুরি গাছের খোলা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে তাকাতেই বলল, উঠে এসো ঠাণ্ডা লেগে যাবে নইলে, আমি গা’টা মুছিয়ে দিই।
বুকু নদী ছেড়ে উঠে তীরে গিয়ে বসল। তার ছোটো ছোটো করে কাটা চুল। জল বসার কোন প্রশ্নই নেই তাই। সারসটা ঠোঁটে করে সুপুরিগাছের খোলটা ধরে বুকুর গা মোছাতে লাগল। বলল, কিছু খেয়েছ সকাল থেকে? হনুমানগুলোর কাণ্ডটা তো দেখলাম।
বুকু ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা কথা বলতে যাচ্ছিল, সারস বলল, ওদিকে ফেরো, পিঠটা মোছাই। বুকু ওদিকে ফিরেই বলল, তুমি কোথায় ছিলে তখন?
সারস উত্তর দিল না। গা মোছাতে লাগল। হঠাৎ বলল, জানো আমার একটা বাচ্চা ছিল। কিন্তু এখন আর নেই।
বুকু বলল, কেন? সে অন্য জঙ্গলে চলে গেছে?
সারস কিছুক্ষণ চুপ থেকে বুকুর পা মোছাতে লাগল। তারপর বলল, না, কতগুলো মানুষ গুলতি ছুঁড়ে মেরে ফেলেছে।
বুকু সারসের মুখের দিকে তাকালো। সারসের চোখে জল। বুকুর বুকটায় খুব কষ্টের মত কিছু একটা হল, যেন দাদুর মৃত্যুটার মত কষ্ট কিছুটা, নাকি হাম্পি বলে যে কুকুরটা ছিল তাদের, সে যখন তাদের বাড়ির সামনে রাস্তায় লরি চাপা পড়ে মরে গিয়েছিল, সেই কষ্টটার মত কিছু একটা!
বুকুর গাল গড়িয়ে চোখের জল পড়ল। হাম্পি মারা যাওয়ার পর দু'দিন ভাত খায়নি বুকু। ঠাম্মি খালি হরলিক্স খাইয়ে যেত। বুকু খাটে শুয়ে শুয়ে খালি কাঁদত হাম্পির গলায় বাঁধা চেনটা বুকের কাছে জড়িয়ে।
বুকু বলল, মানুষের উপর রাগ হয় না তোমার? তাও তুমি আমায় ভালোবাসছ যে?
সারস বলল, আগে হত। মনে হত সব মানুষের বাড়ি গিয়ে আগুন লাগিয়ে দিই। ওদের চোখ ঠুকরে দিই। তারপর মনে হল কি লাভ বলো? হিংসা দিয়ে হিংসা জয় করা যায় না, ভালোবাসা দিয়ে যায়, শুনেছ কথাটা?
হ্যাঁ, দাদু বলতেন, এটা নাকি বুদ্ধের কথা। তুমি বুদ্ধকে চেনো?
সারস বলল, উনি সবার কথা বুঝতেন। ওনাকে নিয়ে একটা গল্প আছে জানো তো?
বুকু পরা ফ্রকটা আবার পরে নিয়ে সারসের গায়ে মাথাটা ঠেকিয়ে শুয়ে বলল, কি গল্প?
সারস বলল, আগে তুমি একটা কাজ করো, তারপরে বলছি।
বুকু তড়াং করে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, কি কাজ?
সারস বলল, নদীটার পাড় বরাবর যাও, একটা লিচুগাছ পড়বে, তারপরে একটা পেঁপেগাছ, আর জামরুল গাছ। তুমি তোমার খাওয়ার মতন করে সব একটু একটু করে পেড়ে নিয়ে এসো, কিন্তু মনে রেখো যতটুকু খেতে পারবে ততটুকুই, জঙ্গলে আমরা খাবার নষ্ট করি না, জঙ্গল রুষ্ট হয়।
বুকুর দারুণ লাগল প্রস্তাবটা। নদীর তীর বরাবর একটু এগোতেই সত্যিই গাছগুলো দেখতে পেল। বুকু এত ফল দেখেনি কোনোদিন গাছে। পেঁপেগাছে, কি জামরুল গাছে, কি লিচুগাছে ভর্তি ফল। সব কত নীচুতে নীচুতে। সে হাত বাড়ালেই নাগালে পাচ্ছে। কিম্বা একটা কোনো পাথরে উঠলেই হাতে পেয়ে যাচ্ছে। বুকু কিছু ফল নিয়ে ফিরে এসে সারসের কাছে বসল। বলল, বলো এবার গল্পটা?
বুকু দেখল সারস অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন একটা ভাবছে। বুকু বলল, ও কিছু খাবে না?
সারস মুখ ফিরিয়ে বুকুর দিকে তাকিয়ে বলল, কে?
বুকু বলল, ভাল্লুকটা?
সারস বলল, না, তুমি খাও, ওর জ্বর।
বুকু চোখদুটো গোলগোল করে বলল, তবে ওকে প্যারাসিটামল দিতে হবে! দাদু দিত।
তুমি তোমার দাদুকে খুব ভালোবাসতে না?
বুকু একটা লিচুর বিচি মুখ থেকে বার করে নদীতে ছুঁড়ে ফেলে বলল, হুম... দাদুও আমায় খুব ভালোবাসত, আমার নামটা তো দাদুরই দেওয়া, এই জামাটাও জানো?
সারস জামাটার দিকে তাকিয়ে বলল, বাঃ, খুব সুন্দর, তুমি খাও।
বুকু পেঁপেটা একটা সরু পাথর দিয়ে ছাড়িয়ে এক ফালি সারসের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, তুমিও খাও।
সারস টুকরোটা মুখে নিয়ে বলল, বেশ এবার গল্পটা শোনো। একবার কি হল বুদ্ধ তখন খুব ছোটো। সব ভাই বন্ধুরা মিলে খেলা করছে, হঠাৎ তার দেবদত্ত নামে এক ভাই, সে খুব দুষ্টু ছিল, সে একটা পাখিকে তীর মারে। পাখিটা ছটফট করতে করতে মাটিতে পড়ে যায়।
বুদ্ধ কিছুদূরে বসে একা একা কিছু ভাবছিলেন। বুদ্ধ বেশি খেলতেন না। তিনি দৌড়ে গিয়ে আহত পাখিটাকে তুলে নিয়ে আসেন আর সেবা-শুশ্রুষা শুরু করেন। পাখিটা আসন্ন মৃতুর হাত থেকে বেঁচে যায়। এমন সময় দেবদত্ত সেখানে এসে বলেন, এ পাখি তুমি নিয়েছ কেন? এ পাখি তো আমার।
বুদ্ধ তখন বলেন, কেন?
দেবদত্ত তখন বলেন, কারণ এ পাখিকে আমি শিকার করেছি!
বুদ্ধ হেসে বলেন, মানে তুমি মেরে ফেলতে যাচ্ছিলে তাই তো?
দেবদত্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন, হ্যাঁ তাই, আর সেই জন্যেই এই পাখি আমার।
বুদ্ধ তখন বলেন, তা কি করে সত্য হয় ভাই, তুমিই ভাবো, এ পাখি কার হতে পারে, যে প্রাণ নিতে চাইছিল তার? না যে প্রাণ দান করল তার? শোনো দেবদত্ত, যে জীবন আমরা দিতে পারি না, তা আমাদের কেড়ে নেওয়ার কোনো অধিকার জন্মায় না।
গল্পটা শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে গিয়েছিল বুকু। হঠাৎ কে যেন পিছন থেকে বলে উঠল, বলছি আর কি পেঁপের টুকরো আছে?
বুকু পিছন ফিরে দেখে ভাল্লুকটা তাদের পিছনে এসে কখন বসেছে। বুকু তার দিকে তাকিয়েই ফিক করে হেসে ফেলল। একটা পেঁপের টুকরো তার দিকে এগিয়ে দিয়েই বলল, এই নাও, তোমার জ্বর সেরে গেছে?
ভাল্লুক চোখ বন্ধ করে পেঁপেটা চিবাতে চিবাতে বলল, কখন! আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম। এই যে গল্পটা শুনলাম, এ সব সত্যিই, আমি এই পেঁপে তবে কেন খাচ্ছি বলো তো? কারণ সব গাছ, এই জঙ্গলের সব গাছ আমি একা লাগিয়েছি, তাই সব গাছই আমার, বুঝলে বুকুরাণী?
সারস বলল, শুরু হল ঢপবাজি। তারপর সে ভাল্লুকের দিকে তাকিয়ে বলল, শোনো, আমি এখন বাড়ি ফিরব, সন্ধ্যে হয়ে এসেছে, তুমি বাচ্চাটাকে টিলার নীচে যে একটা চাতাল মত আছে, ওখানে নিয়ে গিয়ে ওর শোয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে ওকে পাহারা দেবে সারারাত, বুঝলে?
ভাল্লুকটা বলল, সে আমি করতেই পারি, কিন্তু আমার পারিশ্রমিক?
সারস কিছু বলার আগেই বুকু বলল, তোমায় আমি একটা আস্ত পেঁপে পেড়ে এনে দেব, হবে?
ভাল্লুক বলল, সে আমি নিতেই পারি, না নিলে আবার তোমারই খারাপ লাগবে, তোমার মনে হবে একটা বুড়ো ভাল্লুককে সারারাত জাগিয়ে তুমি কিচ্ছু না দিয়ে চলে যাচ্ছ। তোমার মনে হবে কিনা?
সারস উড়ে গেল। সন্ধ্যে হয়ে গেছে প্রায়। আবছা আলোয় একটা উঁচু চাতালের উপর ভাল্লুকের সাথে বুকু উঠল। অন্ধকার হয়ে গেল দেখতে দেখতে। ভাল্লুক বলল, তুমি ঘুমাও, আমি নীচে আছি। কিছু লাগলে ডেকো।
বুকু বলল, হাতি আসবে আমার ব্যাগ নিয়ে যে, তুমি ডেকে দিয়ো আমায় তবে?
ভাল্লুক বলল, হাতি?
বুকু হনুমানের উপাখ্যানটা তাকে সবটা বলল। ভাল্লুক সব শুনে বলল, সেকি আর হাতি পাবে, ওরা কোন উঁচুতে নিয়ে গিয়ে তোমার ব্যাগের দফারফা করে ফেলেছে এতক্ষণে... ব্যাগে কি ছিল?
বিস্কুট, জামা...
বিস্কুট শুনেই ভাল্লুকটা দু'পাক ঘুরে নিল ফুর্তিতে, বলল, আহা বিস্কুট! আমি কদ্দিন খাই না... উফ্... কি লোভ হচ্ছে... উফ্... যাক গে তুমি ঘুমাও... আমি আসি...
ভাল্লুক তো ‘বিস্কুট, বিস্কুট' করতে করতে চলে গেল। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। বুকুর সবে চোখটা লেগে এসেছে, হঠাৎ সারা জঙ্গল কাঁপিয়ে টিলার উপর থেকে এলো বাঘের গর্জন। সারাটা গা কাঁপুনি দিয়ে গেল বুকুর। সাথে একটা আনন্দও, যাক বাঘটা তবে সত্যিই হিমালয়ে যায়নি এখনও।
৪
আর ঘুম আসছে না বুকুর। ঝিঁঝিপোকা ডাকছে, প্যাঁচা ডাকছে, আরো কতরকম অচেনা জীবজন্তুর ডাক ভেসে আসছে। ভয় লাগছে না, কিন্তু ঘুমও আসছে না। ব্যাগটার জন্য একটু একটু মন খারাপ লাগছে। যাক গে, কি আর করা যাবে, গেছে যখন গেছেই। আর ভাল্লুক যা বলে গেল, এরপর আর ব্যাগের কি আশা করা যায়! আচ্ছা কাল যখন সে বাঘের কাছে যাবে, বাঘ কি কথা বলতে চাইবে? যদি বলে, এত পুচকে একটা মেয়ে এর সাথে কি কথা? যাও যাও বাড়ি যাও, তখন?
ধীরে ধীরে চাঁদ উঠল। বেশ আলোয় আলো হয়ে গেল চারদিক। যেন টিউবলাইট জ্বেলে দিল জঙ্গলে কেউ। একটু খস খস আওয়াজ হল আশেপাশে। বুকু ঘাড় ঘুরিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। আওয়াজটা কাছে আসছে।
একদল হরিণ। ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। সবাই মন দিয়ে বুকুকে দেখছে। অল্প অল্প ল্যাজ নাড়ছে সবাই টুক টুক করে। বুকু বলল, তোমরা অমন হাঁ করে তাকিয়ে আছ কেন? আগে মানুষ দেখোনি বুঝি?
একটা হরিণ, খুব মিষ্টি গলায় বলল, আহা চটো কেন বুকু, আমরা তোমার খবর পেয়ে তোমায় দেখতে এলাম। তা বাছা তুমি মন খারাপ কোরো না ব্যাগের জন্য, ও তুমি পেয়েই যাবে।
বুকু বলল, তোমরাও জানো ব্যাগের খবর?
পাশের আরেকটা হরিণ বলল, জঙ্গলে কোনো খবর চাপা থাকে না। সবাই সব জেনে যায়।
বুকু কিছু বলল না, একটা বড় পাথরে মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকল।
মিষ্টিগলা হরিণ বলল, এই বুকু নাচ দেখবে?
বুকু বলল, তোমরা নাচবে?
হরিণটা বলল, আমরাও নাচব, তবে আসল যে নাচবে সে লজ্জায় ওইদিকে লুকিয়ে আছে।
পাশের হরিণটা বলল, আসলে ওর খুব ইচ্ছা কোনো মানুষকে নাচ দেখায়, তাই আর কি...
বুকু বলল, বেশ ডাকো...
একটা হরিণ অমনি মুখ দিয়ে আওয়াজ করতেই, একটা ময়ূর পেখম মেলে সামনে এসে দাঁড়ালো। তার গলার কাছে কি অদ্ভুত রঙ! তার উপরে চাঁদের আলো পড়ে এমন সুন্দর দেখাচ্ছে যে বুকু উঠে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। বলল, তোমার গলায় একটু হাত দেব?
ময়ূর বলল, বেশ তো।
বুকু হাত দিল। কি নরম। তার গলায় একটা চুমু খেল। সব হরিণ আনন্দে হইহই করে উঠল। ময়ূর বলল, তুমি বোসো, আমরা নাচ দেখাই।
এই বলে ময়ূর মাঝখানে পেখম মেলে দাঁড়ালো, তাকে ঘিরে হরিণের দল নাচতে শুরু করল। সবাই মিলে তাল দিয়ে দিয়ে নাচছে। বুকুর খুব ইচ্ছা হল সেও নাচে। সে দৌড়ে গিয়ে ময়ূরের পাশে দাঁড়ালো। তারপর "আয় তবে সহচরী / হাতে হাতে ধরি ধরি / নাচিবি ঘিরি ঘিরি" গাইতে গাইতে তালি দিয়ে দিয়ে নাচতে শুরু করল।
কতক্ষণ নাচটা চলল বুকু জানে না, কিন্তু হঠাৎ ধুম করে একটা শব্দ হতেই সব্বাই হই হই করে পালিয়ে গেল এদিক ওদিক।
বুকু একা চাতালে দাঁড়িয়ে। আর মাথার উপর চাঁদ। কি পড়ল?
আরে তার ব্যাগটা তো ! 'হুররে' করে নেচে উঠল বুকু, এই ব্যাগটাই তো তার, কে আনল? হাতিরা? কিন্তু কই? কেউ কোত্থাও নেই তো!
হঠাৎ একটা হনুমান তার সামনে গুটিসুটি মেরে দাঁড়ালো। তার পিছনে আরেকটা, তার পিছনে আরেকটা, এরকম করে প্রায় চোদ্দোটা হনুমান তার সামনে জড়ো হয়ে দাঁড়ালো। কি যেন কিচমিচ করে বলছে নিজেদের মধ্যে ওরা।
বুকু ব্যাগ খুলে দেখল দুটো বিস্কুটের প্যাকেট হাওয়া। একটা জামাও... আরে একি! একটা হনুমান তার জামা পরে মিটমিট করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রাগে মাথাটা গরম হয়ে গেল বুকুর, আরে এটা তো মাসি দিয়েছিল তাকে, যে মাসি ভূপালে থাকে, কত প্রিয় জামা তার, লালের উপর নীল নীল গোলাপ আঁকা। ঠাঁটিয়ে দেয় একচড় মনে হচ্ছে হনুমানটাকে। কিন্তু কি যেন একটা হয়েছে ওদের। কাকে ভয় পাচ্ছে এত?
হঠাৎ একটা বড় হনুমান এক কাঁদি কলা নিয়ে এসে তার সামনে রাখল। বলল, আমাদের মাফ করবেন বুকুদেবী... আমরা আর করব না, আমাদের খুব ভুল হয়ে গেছে... আমরা কি জানতুম আগে... যে...
হনুমানটা কথাটা শেষ করতে পারল না, তার আগেই মনে হল হাওয়ায় কে যেন ঠাঁটিয়ে একটা চড় মারল তাকে, চটাস করে আওয়াজ হল, কিন্তু কাউকে দেখা তো গেল না!
হনুমানটা গালে হাত বোলাতে বোলাতে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। হঠাৎ কেউ যেন বলল, যা তোরা... যা আবার পরে আসিস...
গলাটা তো খুব চেনা... আরে এ তো দাদুর গলা...!
বুকু দাঁড়িয়ে পড়ল... দুটো হাত সামনের দিকে করে বলল, দাদু...
বুকুর ডাকটা সমস্ত পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল। বুকু দেখল তার সামনে একটা নীল আলোর বিন্দু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে, সেই আলোটা তার গালে, তার কপালে, তার দুটো এগিয়ে থাকা হাতের উপর দিয়ে বুলিয়ে গিয়ে একটা পাথরের উপর স্থির হল।
তারপর বাতাসে সেই পাথরের দিক থেকে কন্ঠস্বর ভেসে এল, হ্যাঁ দিদিভাই আমি, কিন্তু তুমি তো আমায় আর দেখতে পাবে না, তাই আমার কথাটাই শোনো, তুমি চুপ করে এসে আমার পাশে বোসো, আমি এই পাথরটাতেই বসে আছি, এসো দিদিভাই। তোমায় আমি কেমন আদর করলাম বুঝলে তো?
বুকু তখন হাপুস কান্নায় ভেসে। সে পাথরটার উপর দাপিয়ে দাপিয়ে কাঁদছে আর বলছে, কেন আমি তোমার কোলে চড়তে পারব না দাদু, কেন, কেন, কেন?
কান্নাভেজা গলায় উত্তর এলো, অমন কোরো না দিদিভাই, আমার কষ্ট হচ্ছে খুব, আমি বেশি কষ্ট হলে আর থাকতে পারব না, আমায় চলে যেতে হবে...
বুকু বলল, কোথায়?
সে তুমি যখন বড় হবে তখন বুঝবে দিদিভাই, তবে তুমি আমার কথা শোনো, আমি দু’ঘন্টার বেশি তোমার সাথে থাকতে পারব না। তাই যা বলে যাচ্ছি মন দিয়ে শোনো।
বুকু চুপ করে পাথরটার পাশে বসে বলল, বলো।
তুমি কাল বাঘের সাথে দেখা করবে। কিন্তু বেশি কথা ওকে দিয়ে বলাবে না, কেমন? ও খুব অসুস্থ।
কেন ওর কি হয়েছে?
ওর খুব মন খারাপ।
কেন?
কারণ তুমি বড় হলে জানবে পৃথিবীতে বাঘের সংখ্যা খুব কমে যাচ্ছে। সব বাঘেরাই আস্তে আস্তে একা হয়ে যাচ্ছে, পৃথিবী যেন বাঘশূন্য হতে চলেছে, তাই ও খুব উদাস থাকে।
উদাস মানে কি?
মানে যখন কিচ্ছু করতে, বলতে, শুতে, খেতে ভালো লাগে না।
আচ্ছা।
তুমি ওর সাথে বেশি কথা বলবে না তাই। কাল কথা হয়ে গেলে নীচে নেমে আসবে। এখানে তোমার জন্য খাবার রাখা থাকবে। সেগুলো খেয়ে নেবে। কাল যে হাতির সাথে এসেছিলে সে তোমায় আবার জঙ্গলের বাইরে ছেড়ে দিয়ে আসবে, তুমি বাড়ি চলে যেও, কেমন?
বুকু মাথা নাড়ল শুধু।
তারপর অনেকক্ষণ বুকু আর দাদু চুপ করে বসে রইল। বুকু বলল, তুমি আমার কোলের উপর এসে বসো না।
আলোটা বুকুর লাল ফ্রকের উপর এসে বসল। মিষ্টি একটা গন্ধ পেল বুকু। বুকু বলল, আচ্ছা দাদু এত বাঘও কি মানুষ মেরেছে?
দাদু বলল, হ্যাঁ দিদিভাই, মানুষ। মানুষ বড় লোভী হয়ে যাচ্ছে।
বুকু চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, তুমি কি রোজ আমায় দেখতে আসো?
দাদু বলল, না দিদিভাই, আমি অনেক দূরে থাকি। যখন কোনো বিশেষ প্রয়োজন হয় তখন আসতে পারি খালি।
আমার যখন তোমার জন্য খুব মন খারাপ করে, কাঁদি, তখন সেটা বিশেষ প্রয়োজন নয়?
না বুকু, আমাদের কান্না, কষ্ট পাওয়া বিশেষ প্রয়োজন না। ওগুলো না পেলে আমরা বড় হইনা, অন্যের কষ্ট বুঝতে পারিনা। ওই যেমন যে বাচ্চা হনুমানটাকে দেখলে তোমার জামা পরে আছে...
হ্যাঁ, কি প্রিয় জামাটা আমার... দেখো...
ওর মা নেই জানো, ও যখন বাচ্চা তখন একটা ইলেকট্রিক তারে জড়িয়ে ওর মা মরে গেছে। তোমার মনে হয় না ওর কষ্ট হয় ওর মায়ের জন্য?
বুকু চুপ করে নীল আলোটার দিকে তাকালো।
তুমি যে অপছন্দ করেছ ওকে ও সেটা বুঝতে পেরেছে। তাই তুমি কাল সকালে ওকে ডেকে নিজের হাতে করে একটা কলা দিও, কেমন?
ও কি করে বুঝল আমি রেগে গেছি?
পশুরা সব বুঝতে পারে। তারা বলতে পারে না, বোঝাতে পারে না, এই যা।
বুকুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। সত্যিই তো তার রাগ করাটা উচিৎ হয়নি। তার আলমারিতে তো কত জামা! কিন্তু ওর কই? এই জামাটা ছিঁড়ে গেলেও তো ওকে আবার ল্যাংটো হয়েই থাকতে হবে, কে ওকে এই জঙ্গলে এসে জামা কিনে দিয়ে যাবে।
দাদু বলল, আমায় এবার যেতে হবে বুকু, তুমি ঘুমাও। যেমন যেমন বললাম মনে রেখো। আর কাঁদবে না এখন, আমার যেতে কষ্ট হবে। আমাদের আবার দেখা হবে, কবে দেখা হবে আমি এখনই বলতে পারছি না। তবে মনে রেখো আমাদের সবার সাথেই সবার দেখা হয়, আমরা চিনতে পারি না।
বুকু বলল, হাম্পিকে দেখেছ তুমি?
কথাটা শেষ হতে না হতেই একটা কিছু তার ঘাড়ের উপর এসে লাগল।
দাদু বলল, ও আমার সাথেই এসেছে, ও অপেক্ষা করছিল তুমি ওকে মনে করো কিনা দেখার জন্য... তাই না হাম্পি?
হাম্পি বলল, হ্যাঁ...
বুকু লাফিয়ে উঠে বলল, কই কই তুই?
বুকুর মনে হল তার পায়ের কাছে কিছু যেন একটা লাগছে, যেন হাম্পি... হ্যাঁ হাম্পিই তো...
বুকু বলল, তোর সেদিন খুব লেগেছিল নারে যখন গাড়ি চাপা দিয়েছিল?..., বলতে বলতে বুকু আবার কেঁদে ফেলল।
হাম্পিও কাঁদছে বুঝল... বুকুর গালটা ভিজে গেল... হাম্পি চাটছে তার গাল...
বুকু কাঁদতে শুরু করল... আমিও তোমাদের সাথে যাব... দাদু... ও দাদু আমায় নিয়ে যাও... দাদু... এই হাম্পি...
কেউ সাড়া দিল না। সব চুপচাপ। চলে গেল? নীল আলোটা আর দেখতে পেল না বুকু কোথাও। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। খুব খুব খুব। সে ভাবল একবার ভাল্লুককে ডাকে, সারসকে ডাকে। কিন্তু ডাকল না। সে একাই থাকবে, যদি দাদু আবার আসে। ফিরতে ফিরতে যদি দাদুর মনে হয়, না একবার বুকুকে নিয়েই যাই আমাদের জায়গায়? তবে? তাই বুকু একাই পাথরে মাথা দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। কত কথা মনে পড়ছে। সব দাদুকে নিয়ে আর হাম্পিকে নিয়ে। ভাবতে ভাবতে ঘুমে চোখের পাতাদুটো মুদে এলো। পাথরটায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল বুকু। তার মাথার উপর সপ্তর্ষিমণ্ডল...
ভোর হল। বুকুর ঘুম ভাঙতেই দেখল তার সামনে বাচ্চা হনুমানটা দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বুকু একটা কলা আর ব্যাগ খুলে বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল। হনুমানটা তার পা দুটো জড়িয়ে ধরে তার মুখের দিকে তাকালো। বুকু হাঁটু মুড়ে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, তুই আমার সাথে আমাদের বাড়ি যাবি? তোকে অনেক জামা পরতে দেব, এর থেকেও ভালো ভালো জামা।
একটা বড় হনুমান এগিয়ে এসে বলল, ও কথা বলতে পারে না বুকু, ও বোবা।
বুকু বলল, ওকে আমি নিয়ে যাব?
বড় হনুমান বলল, না, ও বাইরে গেলে মরে যাবে।
বুকু বলল, বেশ তবে আমি আমার বাড়ির ঠিকানা বলে দেব, তুমি প্রত্যেকবার পুজোর আগে গিয়ে ওর জন্য আমার কাছ থেকে জামা নিয়ে আসবে...
বড় হনুমানটা 'আচ্ছা' বলে বাচ্চাটাকে যেই টানতে গেল, সে বুকুর পা’টা কিছুতেই ছাড়ল না। সে বুকুর মুখের দিকে তাকিয়ে।
বড় হনুমান বলল, আচ্ছা, পরে তোকে নিয়ে যাব, এখন তুই ওর সাথে যা তবে, তবে বাঘকে বিরক্ত করবি না, ঠিক আছে?
সে মাথা নাড়ল।
৫
বুকু ব্যাগটা পিঠে নিয়ে টিলা থেকে নামতে শুরু করল, পিছনে পিছনে বাচ্চা হনুমানটা। বুকু নামতে নামতেই বলল, আমায় স্নান করতে হবে, নতুন জামা পরতে হবে তবে আমি বাঘের সাথে দেখা করতে যাব, নইলে হবে না, বুঝলি?
হনুমানটা মাথা নাড়ল, বুকু খেয়াল করল না। তার বুকের ভেতরটা ধড়াস ধড়াস করছে, যেন আজ অঙ্ক পরীক্ষা। অঙ্ক করতে বুকু খুবই ভালোবাসে, কিন্তু ভয়ও পায় পরীক্ষার দিন খুব। হাজার হোক বাঘ বলে কথা।
বুকু নদীর ধারে এল। ব্যাগটা মাটিতে রেখে গামছা আর একটা নতুন জামা বার করল। সেগুলো ব্যাগের উপর রেখে হনুমানকে বলল, আমি স্নান করে আসি। তুই কি করবি?
হনুমানটা চারবার এদিক ওদিক মাথা নেড়ে দিল। বুকু বলল, আচ্ছা তোকে আর স্নান করে কাজ নেই আর আমার একটাই গামছা। মা বলেন একজনের গামছা অন্যজন ব্যবহার করতে নেই। বুঝলি?
হনুমানটা একটা বড় পাথরের উপর থেকে লাফ দিয়ে নেমে দু'বার ডিগবাজি খেল।
বুকু বলল, তুই তো হনুমানগিরিতে আমাকেও হারিয়ে দিবি! মিছিমিছি আমায় ক্লাসে স্যারেরা হনুমান বলে ডাকে। আমি কি তোর মত স্যারের টেবিলে উঠে মেঝেতে লাফ দিই, আমি হাইবেঞ্চ থেকে লো বেঞ্চে লাফ দিই শুধু, তাইতেই কি না বলে। অবশ্য আরো অনেক কিছু করি। থাক সেসব কথা বলতে গেলে আর বাঘের কাছে যাওয়া হবে না।
এই বলতে বলতে বুকু জলে নেমে গেল। জলে নামতে নামতেই তার মনে পড়ল, দাঁত মাজা হয়নি যে! সে হনুমানকে বলল, আমার জন্য একটা নিমগাছের ডাল এনে দিতে পারবি?
বাচ্চা হনুমানটা তড়াং করে একটা লাফ দিয়ে স্থির হয়ে গেল। কি যেন ভাবল। তারপর হঠাৎ হুড়মুড় করে জঙ্গলের মধ্যে মিশে গেল।
বুকু স্নান করতে নদীতে নামল। স্নান করল। স্নান করে পাড়ে উঠে ভিজে জামাটা একটা পাথরে মেলে দিল। এখন ব্যাগে ভরা যাবে না তো। গামছাটা দিয়ে গা মুছতে মুছতে হনুমানটা চলে এল। হাতে একটা নিমের ডাল। বুকু খুব খুশী হল। একটা নতুন জামা পরে, হনুমানের হাত থেকে ডালটা নিয়ে, তাকে একটা চুমু খেয়ে নদীর তীরে গিয়ে উবু হয়ে বসল। দাঁত মাজতে মাজতে চারদিকটা আবার চোখ বোলালো। থেকে গেলেই হয় এই জঙ্গলে, কি মজা হবে। এই সব ভাবতে ভাবতে দাঁত মাজা হল। তারপর পিঠে ব্যাগ আর একহাতে হনুমানকে ধরে আবার টিলার দিকে এগোতে লাগল।
টিলার কাছে এসে দেখে ভাল্লুকটা। তাদের দিকে মুখ করেই বসে আছে।
যাঃ! বুকুর তো মনেই ছিল না, ওকে তো পেঁপে পেড়ে দিতে হবে! বুকু বলল, দেখো আমি তো ভুলেই গেছি, তোমাকে তো আমার পেঁপে দেওয়ার কথা!
ভাল্লুকটা বুকুর মাথায় হাত রেখে বলল, আরে না না, ছাড়ো, আমি তো রাতে তোমার কাছে আসতেই পারিনি, পাহারা দেওয়া তো দূরের কথা।
বুকু জিজ্ঞাসা করল তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
ভাল্লুক বলল, সে অনেক কথা বোন। আমাদের এখানে জিরাফ আর গণ্ডারের মধ্যে একটা ঝামেলা হয়েছিল গতকাল রাতে, তাই দেখতে চলে গিয়েছিলাম।
বুকু বলল, মারামারি?
ভাল্লুক বলল, উঁহু, ঠিক মারামারি বলা যায় না, ঝগড়াঝাঁটি বলতে পারো। আসলে হয়েছে কি একটা জিরাফ একদিন অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিল। আর সে যে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল সেই রাস্তায় একটা গণ্ডার বসেছিল, জিরাফের চোখ জুড়িয়ে এসেছিল, আর ওর লাথি গিয়ে লাগে গন্ডারের গায়ে..
কিন্তু ও তো গণ্ডারের চামড়া। লাগার তো কথা নয়। আমায় মা যখন বকে তখন বলে, তোকে বকে কোনো লাভ নেই, তোর তো গণ্ডারের চামড়া! আচ্ছা আমার চামড়াটা কি সত্যিই গণ্ডারের মত?
ভাল্লুক বলল, আরে না, তোমার কেন গণ্ডারের চামড়া হতে যাবে। তা শোনো না কি হল। গণ্ডারের দল বলছে জিরাফদের এখন থেকে দূরবীন চোখে দিয়ে হাঁটতে হবে, যাতে ওরা দেখতে পায় কেউ নীচে আছে না নেই। আর ওদিকে জিরাফের দল বলছে গণ্ডারগুলো সারাদিন যেখানে সেখানে পড়ে পড়ে ঘুমায়, কোনো কাজ করে না, আর এর ওর দোষ ধরে বেড়ায়।
বুকু বলল, ঠিকই তো বলেছে। গণ্ডার তো এর ওর দোষ ধরবেই কারণ গণ্ডারের দোষ কেউ ধরলে তো ওর গায়েই লাগবে না, ওর তো গণ্ডারের চামড়া....
এই বলে বুকু হেসে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। ভাল্লুকটা কিছু না বুঝতে পেরে বলল, তার মানে কি হল?
বুকু বলল, আরে ছাড়ো, জোকস ছিল। বলেই সে ব্যাগটা খুলে বিস্কুটের প্যাকেট খুলে, চারটে বিস্কুট নিজের পকেটে রেখে বাকিটা ভাল্লুককে দিয়ে বলল, এই নাও বিস্কুট।
ভাল্লুক 'ছোঁ' মেরে তার হাত থেকে নিয়ে নিল। একসাথে সবক'টা বিস্কুট মুখে পুরে চোখ বন্ধ করে বলল, আহা! কদ্দিন পরে খেলাম! বেশ বেশ... তোমরা এবার উঠতে শুরু করো, নইলে বেলা হয়ে যাবে।
বুকু ভাল্লুককে 'টা টা' করে উঠতে যাবে, হঠাৎ সারস উড়ে এসে তার সামনে দাঁড়ালো। বলল, শোনো বুকু, একটু উঠেই রাস্তাটা দু'দিকে ভাগ হয়ে গেছে, তুমি বাঁদিকের রাস্তাটা দিয়ে যাবে, ডানদিকের রাস্তাটায় কোনো ভালো ফলের গাছ নেই। অনেকটা সময় লাগবে উঠতে। বুঝেছ?
বুকু 'আচ্ছা' বলে সারসের গায়ে একটু হাতটা ঠেকালো। সারস তার ডানা দিয়ে বুকুর মাথায় বুলিয়ে বলল, সাবধানে এসো, আমি দেখা করব নীচে ফেরার সময়।
বুকু উঠতে শুরু করল। বেশ কিছুটা গিয়ে মনে হল এই যাঃ! কোনদিক দিয়ে যেতে বলেছিল যেন? ডানদিক, না বাঁদিক দিয়ে? তার মনে হল, মানুষ তো সব ভালো কাজ ডানদিকের হাত দিয়েই করে, নিশ্চয় ডানদিকের কথাই বলেছে সারস।
বুকু আর হনুমান ডানদিকের রাস্তাটা দিয়ে এগোতে শুরু করল। অনেকটা এগিয়ে গেল কিন্তু কোনো ফলের গাছ নেই। এদিকে খুব খিদেও পেয়েছে। মাত্র চারটে বিস্কুট আছে। সে বিস্কুটক'টা হনুমানটাকে খাইয়ে দিল। জলও নেই। তার জলের বোতলটাও ফাঁকা!
বুকু বুঝল সে ভুল দিকে চলে এসেছে। কিন্তু এখন ফিরে যাওয়াটাও তো ঠিক হবে না। বুকু খিদে চাপতে জানে, বাড়িতে রাগ হলে কিচ্ছু খেতে চায় না বুকু। তাছাড়া মনটাও বড্ড খিদে নেই, খিদে নেই করছে। আসলে সে একটু একটু ভয় কি পাচ্ছে না? পাচ্ছে তো! সে মনে মনে ভাবল, যাক গে, বাচ্চাটা তো খেয়ে নিয়েছে, সে নিজে অনেক বড় এখন, তার না খেলেও চলবে।
বেলার দিকে বুকু আর হনুমানটা টিলার মাথায় এসে পৌঁছালো। টিলার মাথায় একটা বড় গুহা, সেই গুহার সামনেই বাঘ বসে আছে, তাদের দিকে পেছন ফিরে। বুকুর শরীরে আর শক্তি নেই। সে টিলার ওপরে উঠেই বসে পড়ল। প্রচণ্ড খিদে পাচ্ছে। জল তেষ্টা পাচ্ছে। মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে যাবে। একবার স্কুলে প্রেয়ার লাইনে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার বলেছিল দুর্বলতা থেকে হয়েছিল। এখনও তো সে দুর্বল।
হঠাৎ শুনল খুব ভারি গলায় একটা আওয়াজ, তোদের এই রাস্তাটা দিয়ে আসতে বারণ করেছিল না সারস?
বুকু কোনোরকমে মাথাটা তুলে বাঘের দিকে তাকিয়ে বলল, হুম, ভুলে গিয়েছিলাম।
বাঘ বলল, হুম... আগে খেয়ে নিয়ে বিশ্রাম কর, তারপর দুপুরে কথা হবে আমাদের।
বুকু কিছুই বুঝল না। কি খাবে? খাবার কই? ভাবতে ভাবতেই দেখে কয়েকটা সাপ একটা বড় কড়াইয়ের মত কিছু, তার দু'দিকে দুটো হাতল, সেইটা পেঁচিয়ে টানতে টানতে নিয়ে আসছে। বুকুর সামনে রাখল। কড়াইটার মধ্যে অনেকগুলো আম, কলা, লিচু, আপেল। একটা সাপ বুকুর হাতে একটা টোকা দিয়ে বলল, ওই গুহার পিছনে ঝরনা আছে, যাও, জল খেয়ে এসো, আমাদের বোতল নেই।
বুকুর মনে হল সাপটা যেন ডিপ ফ্রিজে শুয়ে ছিল, এত ঠান্ডা গা! সে আর হনুমান গুহার পিছনে গিয়ে ঝরণার জলে চোখ-মুখ ধুয়ে, অনেকটা জল খেয়ে যেন সুস্থ বোধ করল। যদিও খিদে পাচ্ছে কিন্তু কি সুন্দর লাগছে এইখান থেকে পুরো জঙ্গলটাকে দেখতে। ওই দূরে রাস্তাটাও দেখা যাচ্ছে, সাপের মত। গুহার এইদিকে কি দারুণ দারুণ সব ফুল ফুটে আছে! মনটা খুব ভালো হয়ে গেল বুকুর।
আবার গুহার সামনে এলো। কয়েকটা ফল একসাথে হাতে নিয়ে চিবোতে চিবোতে একটা সাপের দিকে তাকিয়ে বলল, বাঘে ফল খায়?
একটা সাপ বলল, রাজামশায় ফল খায় না, এটা অতিথিদের জন্য।
বুকু খুক খুক করে হেসে ফেলল, বলল, আমি কিন্তু বনের রাজা সিংহকে বলি।
একটা সাপ ফণা তুলে বলল, সে যে বনে ওরা থাকে, এখানে ওসব সিংহ টিংহ নেই। কিন্তু তুমি রাজার সাথে দেখা করবে যে উপহার কি এনেছ?
এই যাঃ! এই কথাটা তো মাথায় ছিল না! উপহার তো কিছু আনা হয়নি! সব বিস্কুটও তো শেষ, কি হবে? লজ্জা লাগতে লাগল। হনুমানটা একটু দূরে ঘুমিয়ে পড়েছে। খুব ক্লান্ত নিশ্চয়ই।
একটু পর বাঘ এসে গুহার সামনে বসল। সাপেরা কড়াইটা টানতে টানতে গুহার ভিতরে নিয়ে গেল। বুকু গুটি গুটি পায়ে বাঘের পাশে এসে বসল।
রাজামশায়, আমি একটা ভুল করেছি। আমি আপনার জন্য কোনো উপহার আনিনি।
বাঘ বলল, ঠিক আছে। তুমি বাচ্চা, হতেই পারে ভুল। কিন্তু বলো তো তুমি কেন এই জঙ্গলে একা একা আমার সাথে দেখা করতে এসেছ?
বুকু বলল, সে অনেক কথা। আমার ছোটোবেলা থেকেই বাঘের গল্প শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু সে সব তো মানুষের লেখা। আমার মনে হয় সেগুলো যেন সত্যিকারের গল্প নয়। আমি তাই সত্যি সত্যি বাঘের গল্প বাঘের মুখ থেকেই শুনতে চাই।
বাঘ বলল, কিরকম গল্প?
বুকু বলল, সে আমি জানি না। আপনি যে গল্প শোনাবেন তাই শুনব।
বাঘ বলল, তুমি আমার এখানে রাতে থাকবে?
বুকু বলল, সে হবে কি করে? দাদু যে হাতিকে আসতে বলে দিয়েছে আজকে সন্ধ্যেবেলা। তাছাড়া সারসও অপেক্ষা করবে।
বাঘ বলল, সে আমি কাল সকালে সব ব্যবস্থা করে দেব। তুমি ভেবো না, তুমি শুধু বলো তুমি ভয় পাবে না তো?
বুকু বলল, না না, আমি কেন ভয় পাব?
বাঘ বলল, বেশ। এই বলে সে একটা প্রকাণ্ড গর্জন করল। বুকুর প্রায় পটিই হয়ে যেত, কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিল। হনুমানটা ধড়মড় করে উঠে একটা গাছের মাথায় চড়ে বসল। মুখে কি একটা অদ্ভুত আওয়াজ করতে শুরু করল।
বাঘ হনুমানটার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ভয় পেয়েছে, আমায় এত কাছ থেকে কোনোদিন দেখেনি তো, ওর মা আমায় খুব ভালোবাসত। খুব ভালো ছিল।
বুকু বলল, হুম... শুনেছি আমি, মারা গেছে কারেন্ট লেগে। আর এ বোবা।
বাঘ বলল, জানি। তোমরা মানুষেরা বড্ড নিষ্ঠুর, স্বার্থপর। শুধুই নিজেদের কথাটাই ভাবো।
বুকুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। পৃথিবীতে বাঘের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এটা খুব খারাপ। এটা ঠিক নয়।
একটা বড় ঈগল পাখি ইতিমধ্যে এসে বাঘের সামনে দাঁড়ালো। বাঘ তাকে কি সব বলল, ঈগল বলল, আচ্ছা, জ্বী মালিক। তারপর উড়ে চলে গেল।
বাঘ বলল, তুমি এক কাজ করো, হনুমানটার কাছে যাও, ওকে শান্ত করো, তারপর তোমরা এই গুহাটার পিছনে একটা বড় চাতাল মত আছে সেখানে গিয়ে বোসো, আমরা ওখানেই কথা বলব। আর কাল ফেরা নিয়ে দুশ্চিন্তা কোরো না, আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। তোমার সাহস আমায় মুগ্ধ করেছে। এইটাই আমার উপহার।
৬
কিন্তু হনুমান তো কারো নাম হতে পারে না! আর যখন বুকু ঠিক করেছে তাকে সে বাড়ি নিয়ে যাবেই। তাই বুকু ঠিক করল হনুমানের নাম হবে হুব্বা। হনুমানের পছন্দই হল মনে হচ্ছে, সাড়াও দিচ্ছে 'হুব্বা' বলে ডাকলেই। বিকাল হয়ে গেছে। বুকু হুব্বাকে নিয়ে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলল, লুকোচুরি খেলল, একটা বল বানিয়ে লোফালুফি খেলল। হুব্বার বাঘের ভয়টা বেশ কেটে গেছে। চনমনে হয়ে গেছে। খেলতে খেলতে সন্ধ্যে হল। একটা সাপ গুহা থেকে বেরিয়ে বুকু আর হুব্বার দিকে এগিয়ে এলো। সামনে এসে দাঁড়াতেই বুকু বলে উঠল, একদম ছোঁবে না আমায়, কি ঠাণ্ডা গা তোমাদের! তোমরা কি ফ্রিজে থাকো রাতদিন? না বরফ খাও?
সাপ বলল, আমরা এরকমই। তুমি বলো কিছু খাবে এখন না একেবারে রাতেই খাবে?
বুকু ভেবে দেখল তার এখনও খিদে পায়নি, হুব্বাকে জিজ্ঞাসা করল, খাবি কিছু? হুব্বাও মাথা নাড়ল, মানে খাবে না। সাপ চলে গেল।
চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তারাগুলো ফুটতে শুরু করেছে একটা একটা করে। যেন জঙ্গলের মাথায় কেউ কালীপুজোর টুনিলাইট লাগাচ্ছে। পা ছড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুকু বলল, হুব্বা দেখ কত আলো। আমাদের ওখানে যখন যাবি কালীপুজোর সময় দেখবি আমরাও ছাদে এরকম টুনি লাগাই। তুই তারা চিনিস?
হুব্বা বুকুর কাঁধের উপর লাফ দিয়ে উঠে বসল। তার একটা হাত বুকুর মাথার উপর রেখে আরেকটা হাত দিয়ে আকাশের দিকে কিছু ইশারা করতে লাগল।
বুকু বলল, কি বলছিস? ওই তারাটা? ওটা ধ্রুবতারা। ওটা সপ্তর্ষিমণ্ডল। ওটা কালপুরুষ।
হুব্বা বুকুর ঘাড় থেকে নেমে বুকুর কোলে মাথা দিয়ে শুলো। বুকু বলল, কি হল হুব্বা, মায়ের কথা মনে পড়ছে?
হুব্বা তার মুখটা বুকুর জামার মধ্যে গুঁজে দিল। বুকু হুব্বার গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে কত কথা ভাবতে লাগল --- তার স্কুলের কথা, বাড়ির কথা, হাম্পির কথা, দাদুর কথা। চারদিক থেকে নানা পশুপাখির আওয়াজ আসছে। একটু পর চাঁদ উঠতে শুরু করল। বুকু হুব্বাকে ডেকে বলল, চল হুব্বা, পিছনে চাতালে যেতে হবে। বলেই বুকু উঠে দৌড় লাগাল, হুব্বা পিছনে পিছনে লাফাতে লাফাতে চলল।
বুকু আর হুব্বা যখন চাতালে এল তখন জঙ্গলের আকাশে চাঁদ পুরো উঠে গেছে। চারদিকটা কি সুন্দর লাগছে দেখতে বুকুর! বুকু দূরে রাস্তাটা দেখতে পেল, রাস্তার আলোগুলো বিন্দুর মত লাগছে।
বাঘ বসে আছে জঙ্গলের দিকে মুখ করে। চাতালের সামনেই গভীর খাদ। বুকু গিয়ে পাশে বসল। হুব্বাও বসল।
বাঘ বলল, এসে গেছ তোমরা। আচ্ছা শোনো আমার গল্প দিয়েই শুরু করি, তুমি তাই তো শুনতে চাও বুকু?
বুকু বাঘের আরো কাছে সরে এলো। বলল, হুম... বলো।
বাঘ বলল, শোনো, আমার জন্ম হয়েছিল এই জঙ্গলের থেকে উত্তর দিকে কয়েকশো মাইল গেলে একটা পাহাড়ি জঙ্গল আছে, সেইখানে। আমি বড় হই, শিকার ধরা শিখি সব সেই জঙ্গলেই। তবে আমি মানুষ শিকার করিনি কোনোদিন। আমার বংশেও কেউ করেনি। কিন্তু আমার মা-বাবাকে শিকার করেছে মানুষ। শুনেছি নাকি তাদের গায়ের চামড়া দিয়ে তাদের বসার ঘর সাজানোও আছে। আমার এক ভাই, এক বোন ছিল, তাদের একজনকে তোমাদের চিড়িয়াখানায় নিয়ে গেছে, আরেকজনকে সার্কাসে। আমি একা পালিয়ে এই জঙ্গলে এসেছিলাম। তখন আমার যৌবন বয়েস।
বুকু বলল, তোমার ছেলেমেয়ে নেই?
বাঘ বলল, এই জঙ্গল থেকে অনেকটা দূরে আরেকটা আরো গভীর জঙ্গলে আমার বউ-ছেলেমেয়ে আছে। আমি এই জায়গাটা পাহারায় আছি। যাতে কোনো শিকারি বা দুষ্টুলোক এই জঙ্গল পেরিয়ে ওই জঙ্গলের দিকে না যেতে পারে। প্রতি বছর আমার বউ এসে শীতকালটা পাহারা দেয়, আমি তখন সেই জঙ্গলে গিয়ে আমার বাচ্চাগুলোর সাথে থাকি। এইভাবে আমরা আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছি। মাঝে মাঝে জঙ্গলে আগুন লেগে যায় জানো তো?
বুকু বলল, হ্যাঁ, আমি টিভিতে দেখেছি।
বাঘ বলল, আমাদের অনেক কিছুর সাথে লড়তে হয় --- খরা, দাবানল, বন্যা, শিকারী অনেক কিছু। তবে মানুষেরা আমাদের মত অনেক প্রাণী, গাছপালা কমিয়ে ফেলছে। শুধু তোমরাই থাকবে বললে কি করে হয় বলো। আমরা কোথায় যাই?
বুকুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। মানুষ এত লোভী কেন? এত বাজে কেন? সারা আকাশ তারা জ্বলজ্বল করছে। বুকুর মনটা কেমন করে উঠল বাঘটার জন্য। সে বলল, আমি তোমায় একটু ছুঁতে পারি?
বাঘ এই প্রথম সরাসরি বুকুর মুখের দিকে তাকালো। বলল, আচ্ছা বেশ।
বুকু বাঘের গায়ে হাত বোলালো। তারপর বাঘের গায়ে মাথা দিয়ে শুয়ে তারাদের তাকিয়ে থাকল। হুব্বা একটু দূরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাঘটা তার লেজ দিয়ে বুকুর হাতের উপর ধীরে ধীরে বোলাতে লাগল।
বুকু বলল, তুমি কোনোদিন শহরে গেছ? মানে মানুষ যেখানে থাকে?
বাঘ বলল, না, দূর থেকে দেখেছি।
বুকু বলল, তুমি পিঠে খেয়েছ?
বাঘ বলল, না।
তুমি রাজকন্যাকে বিয়ে করতে চেয়েছ?
বাঘ বলল, না।
তোমাকে কোনোদিন ডিসকভারিতে, অ্যানিম্যাল প্ল্যানেটে, ন্যাশেনাল জিওগ্রাফিতে দেখিয়েছে?
বাঘ বলল, হুম, তা একবার দেখিয়েছে। কিন্তু ছবি তোলার সময় ওরা বড্ড কথা বলে। আমার ভালো লাগে না। আসলে আমরা মানুষদের বলি তোমরা তোমাদের মত থাকো, আমরা আমাদের মত থাকি। আমরা কি তোমাদের বাড়িতে কি খাচ্ছ, কি পরছ, কেমন পটি করছ, কি গান করছ, কোন দিদিমণির কানমলা খাচ্ছ - এ সব ছবি তুলতে যাই?
বুকু বলল, না তো।
বাঘ বলল, তবে তোমরা কেন বারবার আমাদের ছবি তুলে বিরক্ত করো বলো?
বুকু বলল, থাক তোমায় আর গল্প বলতে হবে না, আমি তোমায় জড়িয়ে একটু ঘুমাই? আমার ঘুম পাচ্ছে। এতটা রাস্তা উঠেছি তো বলো?
বাঘ বলল, বেশ ঘুমাও, কিন্তু খাবে না কিছু?
বাঘ আর উত্তর পেল না। বুকু ঘুমে তলিয়ে গেছে।
বুকুর ঘুম ভাঙল যখন তখন সূর্য উঠে গেছে। চোখ মেলেই দেখে সাপগুলো চাতালের উপর খাবার সাজিয়ে রেখে তার দিকে তাকিয়ে বসে আছে।
বুকু বলল, একদম আমার গায়ে হাত দেবে না, মনে আছে তো? কি ঠাণ্ডা তোমাদের গা!
সাপ বলল, জানি, তুমি খেয়ে এখন উদ্ধার করো আমাদের।
বুকু বলল, হুব্বা কোথায়? মানে আমার হনুমানটা?
একটা সাপ আড়মোড়া ভেঙে বলল, সে আমরা কি জানি।
বুকু অস্থির হয়ে উঠল, যাঃ! বাঘের ভয়ে পালালো নাকি? সে জিজ্ঞাসা করল, রাজা কই?
একটা সাপ বলল, জানি না। তিনি আজ বিকালের আগে আসবেন না বলে গেছেন। জঙ্গলের পশ্চিম দিকে নাকি কিছু শিকারী এসেছে তাদের তাড়াতে গেছে। তোমাদের এখান থেকে নামিয়ে হাতির পিঠে তুলে দিতে দু'জন পালোয়ান আসবে। বুঝেছ?
বুকু বলল, পালোয়ান?
হঠাৎ একটা লাফ দিয়ে হুব্বা এসে হাজির। তার হাতে একটা নিমের ডাল। বুকুর ধড়ে যেন প্রাণ এলো। সে হুব্বাকে জড়িয়ে বলল, আমায় না বলে যাবি না কোত্থাও আজ থেকে, ঠিক আছে?
হুব্বা একটা ডাল ভেঙে নিজে মুখে দিল আর আরেকটা বুকুর হাতে দিল। একটা সাপ বলল, ঢং দ্যাখ, হনুমানে দাঁত মাজে কোনোদিন শুনেছিস লো? আদিখ্যেতা যতো...
বুকু কিছু বলল না। তার অভিমান হচ্ছে কেন বাঘ তাকে 'টা টা' না করে চলে গেল?
একটা কলা নিজে খেয়ে আর হুব্বাকে দিয়ে সাপগুলোকে বলল, কই পালোয়ান তোমাদের?
একটা সাপ বলল, আনছি।
কিছুক্ষণ পরেই ইয়া তাগড়া দুটো শিম্পাঞ্জি এসে হাজির। সাপদুটো বলল, নাও, চড়ে পড়ো তো দেখি এদের ঘাড়ে।
বুকু কিছু বোঝার আগেই ছোঁ মেরে শিম্পাঞ্জি তাদের তুলে চাতালের খাদের দিকে যেতে লাগল। কে যেন বলল, বুকু ধরে বোসো, খুব শক্ত করে। বুকু আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল সেই সারসটা, যেন তার মায়ের মত। একটা বড় হনুমান তাদের সাথে লাফাতে লাফাতে যেতে যেতে বলল, বাচ্চাটাকে কিন্তু সামলে রেখো। আমি মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসব ওকে।
সারস আবার বলল, নীচে হাতির দল অপেক্ষা করছে তোমাদের জন্য, এরা একটা একটা বড় বড় গাছের ঝুরি ধরে লাফাবে আর নামবে, তোমরা শক্ত করে ধরে রাখো।
বলতে বলতেই শিম্পাঞ্জিটা একটা বিরাট লাফ দিল। আচমকা একটা আর্তনাদ শুনে বুকু পিছন ফিরে দেখল হুব্বা টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে নীচে পড়ে যাচ্ছে শিম্পাঞ্জির কাঁধ থেকে। বুকু কিছু না বুঝেই একটা লাফ দিল শিম্পাঞ্জির কাঁধ থেকে... চীৎকার করে উঠল... হুব্বা.... ওকে বাঁচাতেই হবে.. চীৎকার করে আবার ডাকল, হুব্বা.. সে নীচে পড়ে যাচ্ছে... অনেক নীচে...
হঠাৎ মাথার কাছে শক্ত কিছু একটা ঠেকল, সব কেমন গুলিয়ে গেল। মাথাটা ঝনঝন করে উঠল, ব্যথা করছে। চারদিকে কি শোরগোল, যেন জঙ্গলের সব পশুপাখি একসাথে চীৎকার করতে শুরু করে দিয়েছে। হঠাৎ তাকিয়ে দেখে একটা গাছ কেমন করে খাটের একটা পায়া হয়ে যাচ্ছে। আকাশটা ছাদের মত হয়ে যাচ্ছে। মুখের কাছে ঝুঁকে আছে মা।
বাড়ির মধ্যে শোরগোল পড়ে গেছে, অত উঁচু খাট থেকে পড়ে গেছে। নিশ্চয়ই মাথাটা ফেটে গেছে। বুকু কিছুই বুঝতে পারছে না। সে শুধু বলে যাচ্ছে, হুব্বা কই... হুব্বা...
ঠাম্মা বলছে, নিশ্চয়ই কোনো বাজে স্বপ্ন দেখেছে... আগে দেখো মাথাটা ফেটেছে কিনা।
না, মাথা ফাটেনি। বুকু জিজ্ঞাসা করল, এখন বিকাল না সকাল?
ঠাম্মা বলল, বিকাল।
বুকু বলল, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম?
ঠাম্মা বলল, হ্যাঁ তো। তোর মাথাটা কি যন্ত্রণা করছে?
বুকু বলল, অল্প।
মা এসে বুকুর মাথায় বরফ দিতে দিতে বলল, উফ... এ মেয়ের যে স্কুলটা কবে খুলবে...
বুকু বলল, স্কুল বন্ধ?
মা বলল, বাহ্ রে! লকডাউন চলছে না...
বুকু বলল, ও হ্যাঁ তো! বুকু খেয়াল করল সে একটা লাল জামা পরে আছে।
বুকু বলল, আমি একটু শুয়ে থাকি ঠাম্মি? তার মনটা খুব খারাপ লাগছে, সবার জন্য খারাপ লাগছে। বিশেষ করে হুব্বার জন্য।
হঠাৎ ছাদ থেকে পিসির চীৎকার, ও বৌদি... শিগগির ছাদে এসো গো... কে একটা হনুমানের বাচ্চা ফেলে চলে গেছে...
বুকু আর কিচ্ছু শুনল না... এক দৌড়ে ছাদে। কেউ পৌঁছাবার আগেই সে ছাদে উঠে পিসিকে এক ঝটকায় সরিয়ে হনুমানটাকে জড়িয়ে ধরল, 'হুব্বা হুব্বা' বলে আদর করতে লাগল। হনুমানটাও মাথাটা বুকুর কাঁধে গুঁজে শুয়ে পড়ল। ইতিমধ্যে বাড়ির সবাই ছাদে। কেউ কাছে যাচ্ছে না। সবাই বলছে, বুকু ওকে ছেড়ে দে... জঙ্গল থেকে চলে এসেছে... কামড়ে দেবে... ছাড় ছাড়... এই লকডাউনে কোথায় যাব তোকে নিয়ে ও কামড়ালে...
বুকু ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। বলল, এ আমার, এ আমার সাথেই জঙ্গল থেকে এসেছে। ওকে কিচ্ছু বলবে না তোমরা, নইলে আমি কিন্তু সত্যিই জঙ্গলে চলে যাব...
বুকুর কান্না দেখে সবাই চুপ করে গেল। এমন কান্না তো মেয়ে কাঁদে না! আর হনুমানটাই বা ওর কোলে ওভাবে শুয়ে আছে কেন?
বুকু ওকে কোলে নিয়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ির দিকে এগোতে লাগল। সবাই রাস্তা ছেড়ে দিল। সবার চোখে মুখে বিস্ময়। বুকু বলল, ওর নাম হুব্বা।
হঠাৎ ঠাম্মি বলল, ওর হাতে ওটা কি রে?
বুকু হুব্বার হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল, একটা নিমডাল।
[সমাপ্ত]