অনির্বাণ মা মরা ছেলেটার জন্য নীলের উপোস করে। কাউকে না জানিয়েই করে। প্রথম প্রথম একটা আবেগ ছিল। এখন ভয় হয়, মনে হয়, না করলে যদি কোনো অমঙ্গল হয়! ছেলে এখন কলেজে পড়ায়। ক'দিন পর বিয়ে করবে। তখন না করলেই হবে। তখন তো তার মঙ্গলের জন্য আরেকজন এসে যাবে সংসারে।
অনির্বাণ সুদীপের ঘরে প্রসাদের মিষ্টি আর ফুল রেখে এলো। আজ দেরি করে উঠবে। যাবে না কলেজ। বেলায় বেরোবে, নর্থবেঙ্গলে যাচ্ছে বেড়াতে, বন্ধুরা।
======
সুদীপ বেরিয়ে গেল। শতাব্দী ধরবে। বেলঘরিয়ার এদিক থেকে হাওড়া যেতে অনেক জ্যাম রাস্তায়। ভালোই করেছে।
"নিজের খেয়াল রেখো, নেটটা অন্ রেখো, আমি হোয়াটস অ্যাপ করব"।
অনির্বাণ সুদীপের ঘরের পর্দাগুলো টেনে, ঘর অন্ধকার করে বসে এই কথাগুলো বারবার ভাবছে। পরমার ছবিটায় টেবিলে রাখা ফুলদানিটার ছায়া পড়েছে। অনির্বাণের চোখটা বুঝে আসছে, আরামে, নিশ্চিন্ততায়। ছেলেটার ভালোই হবে। মন বলছে।
======
দার্জিলিং পৌঁছিয়েছে লিখেছে, হোটেলের নাম আর ফোন নাম্বার পাঠিয়েছে, কার্ডের ছবি তুলে। আর তো কোনো খবর নেই, দু'দিন হল। ফোন নট রিচেবল বলছে। একে তো আজকাল ফোন করতে অস্বস্তি হয়, তার উপর ফোন না পেলে। অনির্বাণ সুদীপের ঘরে শিফট করে গেছে। তাই করে। স্বস্তি লাগে।
======
মা চলে গেলে বাবার সঙ্গে একটা দূরত্ব হয়। অনেকেরই হয়। আবার অনেকের হয় না। কিন্তু মা তো সেই কবে চলে গেছেন, ক্লাস সিক্সে পড়তে। তখন বাবার সঙ্গে যেমন সম্পর্ক ছিল, বড় হল যত কেন যে দূরত্ব বাড়ল বুঝে পায় না সুদীপ। কথা হয়। রাজনীতি, খেলা নিয়ে খুব একটা মতপার্থক্য নেই। গান, সিনেমা নিয়ে বাবা অত মাথা ঘামায় না। পুজো-আচ্চাই বড় একটা সময় ধরে করে। রিটায়ার করেছে প্রায় চার-পাঁচ বছর তো হল। প্রত্যেক বছর দু'বার ভাইয়ের কাছে যায় ব্যাঙ্গালোরে। কাকা ওখানে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। বেশ বড় ফ্ল্যাট। কাকা গে। একাই থাকে। বাবার এই নিয়ে কোনো ন্যারো ভিউ দেখেনি কোনোদিন।
আসলে বাবা একা হয়ে যাচ্ছে। মানুষকে একা করে তার হরমোন আর নিউরন। বয়েস যত হয় তার হরমোন আর নিউরনের কীর্তিকলাপ বদলে বদলে যায়। মানুষ কি ভীষণ কণ্ডিশনড!
======
এক-এক সময় নিজেকে গিলটি লাগে সুদীপের। মনে হয় বাবার এই একাকীত্বের কারণ সে নিজে। তার উপর এই আনরিয়েলিস্টিক অ্যাফেকশানের জন্যেই বাবা নিজেকে সেল্ফ ইম্প্রিজন্ড করে ফেলল। অনেক রাতে বাবাকে পর্ণ সাইট দেখতে দেখেছে সুদীপ। মাস্টারবেট করতেও দেখেছে। তখন ঘেন্না লাগত। বাজে ব্যবহার করত। ভীষণ রুড হয়ে যেত। বয়েসটাও কম ছিল, আর সব কিছুতেই ভীষণ রিজিডও ছিল হয় তো। একবার ক্লাস ইলেভেনে খাবার টেবিলে বলেই ফেলেছিল, ডোন্ট বিহেভ লাইক এ মঙ্ক, আই হ্যাভ সিন ইউ জার্কিং…. বাই বাই…. ওয়াচিং দোজ ন্যাস্টি সাইটস….
জিভ জড়িয়ে গিয়েছিল। কান্নায় গলা চোকড হয়ে গিয়েছিল। কি ভয়ংকর অভিমান। কিন্তু কেন? বাবা মাথা নীচু করে চুপ করে বসেছিলেন। প্রায় এক সপ্তাহ কথা হয়নি দু'জনের। স্কুল থেকে ফেরার সময় মনে হত বাস থেকে লাফ দিয়ে পালায়। কিন্তু কোথায় যাবে? বাবা যে কম্ফোর্ট জোন দিয়েছে সেটা আর কে দেবে? নিজের স্বার্থপরতা, নিজের ডাবল স্ট্যাণ্ড দেখে নিজেকে ডিসগাস্টিং লেগেছে। তাও, নিজেকে তো অ্যাটলাস্ট সহ্য করেই নেয় মানুষ। যত জাজমেন্ট তো অন্যের বেলায়।
======
অনির্বাণের আগের কথা মনে আনে না আর। বই পড়ে। পুরাণ পড়ে। শিবপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, দেবীভাগবত। আরো অনেক বই আছে। পরাজগত। যেখানে যাচ্ছে সে। যেখানে পরমা একটা আটপৌরে শাড়ি পরে মাঠে অপেক্ষা করছে তার জন্য।
সুদীপের নেটওয়ার্ক এর সমস্যা। আজ কথা হয়েছে। ভালো আছে। অনির্বাণ সাধারণত নিরামিষ খায়। আজ পাশের হোটেল থেকে চিকেন আর রুমালি রুটি আনালো। এক-এক সময় অনেক কিছু আনাতে ইচ্ছা করে ফাঁকা বাড়িতে। মেয়েমানুষ। একটু আদর। উষ্ণ শরীরের ঘ্রাণ। ঈশ্বরের আপত্তি নেই। বিবেকেরও নেই। বাধা হল পাড়া। কারোর তো কোনো ক্ষতি নেই কাউকে যদি নিয়ে আসে, একটু জুড়ায়। কিন্তু সমাজ বোঝে না। সুদীপ?
======
ইচ্ছা করেই নেটটা অফ্ রাখছে। বাবার নি:সঙ্গতাটা কি শুধুই হরমোন আর নিউরনের? সমাজের কোনো দায় নেই? তার নিজের? অভুক্ত মানুষ নিজেকে বঞ্চিত ভাবে। উপোসী না। বাবার চোখেমুখে রুক্ষতাকে পড়তে পারে সুদীপ। তার নিজেরও শরীরে মনে ওই একই ভাষা। মানুষের সবটা অস্তিত্ব জুড়েই তো একই কান্না… সুখ দাও…. সুখ দাও….। অঞ্জলি সুদীপকে সুখী করেনি। বাবা অঞ্জলির কথা জানে। কিন্তু তাদের সেপারেশনের কথাটা জানে না। থাক। অঞ্জলি বড্ড ন্যাগ করে। হয় তো ওসিডি আছে। সব বিষয়ে এত অবসেসান কেন ওর? ও বলে ওর ঠাকুমার কাছ থেকে পেয়েছে। হবেও বা। আসলে মানুষের এখন অনেক অপশান। লংটার্ম রিলেশান বালাই এখন। না পোষায় সরে যাও। স্পেস দাও। আরেকজন আসুক। দেখো অ্যাকোমোডেট করতে পারছ কিনা। হলে ভালো। নয় তো অ্যাডজাস্টমেন্ট। নয় তো কম্প্রোমাইজ। এইগুলোর ড্রাইভিং এজেন্ট কি? ডিল। গুড ডিল ইজ সোল অব লং লাস্টিং লাভ। রিলেশান। কিন্তু এত অফার! মানুষ সব সময়ে দোটানায়। তিনটানায়। শতটানায়। সুখ কই?
বাবা অসুখী। সে নিজেও তাই। কারণ আলাদা। কিন্তু নিট রেজাল্ট একই। বাবার বয়েসের কারণে এক্সপেক্টেশান কম, তাই কম রিয়েক্টিভ। তার অনেক বেশি।
======
অনির্বাণ অনেকবার লিখতে চাইল, ছবি পাঠাস। কষ্ট হচ্ছে না দেখে তোকে। লিখল না। জটিল হয়ে গেছে সব কিছু বড়। সোজা অনুভূতিগুলো বড় বিব্রতকর। বরং শরীরের প্রশ্ন, অ্যাজমার সমস্যাটা বেড়েছে কিনা সেই প্রশ্ন… খাবার, ওয়েদার, ধ্বস…. কত গৌণ কথাকে মুখ্য করে তুলতে হয়। কিন্তু পৌঁছাচ্ছে না কোনো মেসেজ। হয় তো ইচ্ছা করেই অফ্ রেখেছে। হয় তো আমি সাফোকেট করি।
কাল ফিরবে। সকালে। অনির্বাণ বেলায় ফ্লাইট দেখছে। ব্যাঙ্গালোরের। বড্ড অভিমান জন্মে যায় আজকাল। পেটের গ্যাসের মত। বিরক্ত লাগে। ব্যবহার বড্ড রূঢ় হয়ে যায়। ভয় লাগে। এর পরিণাম সহ্য করতে পারবে তো সে নিজে? যদি ছেড়ে চলে যায় সুদীপ? যদি ফ্ল্যাট নিয়ে অঞ্জলিকে নিয়ে চলে যায়? তার কি বলার আছে? অঞ্জলি ভালো মেয়ে। একটু বেশি ভাবে। ভাবুক। ওতে ক্ষতি নেই। আগলে রাখতে গেলে ভাবতেই হয়। ওর মা-ও ভাবত।
======
সুদীপ স্টেশান থেকে কলেজ চলে গেল। ফিরবে না। একেবারে উইকেন্ডে ফিরবে জানালো।
অনির্বাণ কাঁদল। নীলের বাসিফুল ফেলেনি এতদিন। খেয়াল ছিল না। আজ চোখে পড়ল। ডাস্টবিনে ফেলে এলো। আলুসিদ্ধ আর ভাত খেল দুপুরে। কান্না পেল। ফ্রীজে চিকেন রাখা। চিলিচিকেন আর ফ্রায়েড রাইস রাঁধবে ভেবেছিল।
ফ্লাইট রিশিডিউল হয়ে রাত সাড়ে দশটায় হয়েছে। আটটা নাগাদ ঘরের একটা একটা আলো নিভিয়ে বাইরের গেটের দিকে এগোচ্ছে অনির্বাণ। চোখ ভিজে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট। একাকীত্বের না। অবহেলার। বাইরের তালাটা দিয়ে রাস্তায় নেমে আবার ফিরল। তালাটা খুলল। বারান্দার আলোটা জ্বেলে দিল। রাতে ফেরে যদি, ঘর খুললেই অন্তত আলোটা পাবে। অন্ধকার ঘরে তালা খুলে ঢুকলে বড্ড কষ্ট হয়, বিশেষ করে যে ঘরে আগে ভালোবাসার গন্ধ ছিল।
অনির্বাণের বুক করা ক্যাব দাঁড়িয়ে।
======
সুদীপ হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজটা দেখে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, লিভিং ফর ব্যাঙ্গালোর…. ফর ফিফটিন ডেজ… মে বি।
এই "মে বি" শব্দটা অভিমানের। সুদীপ জানে। কেন যায়নি সেটা স্পষ্ট নয়। কিন্তু যেতে পারেনি। এটা স্পষ্ট। সব কেন-র উত্তর মানুষ যদি পেত। মানুষ বড্ড কন্ডিশনড। চিরটাকাল। সুদীপ একবার ব্যাঙ্গালোরের ফ্লাইট দেখল। লিখল, "ওকে, টেক কেয়ার।"
লিখতে চাইল, "ওয়েটিং ফর ইউর আর্লি রিটার্ন"। লিখতে পারল না। হয় তো এর জন্যে পরে ভীষণ বুক মুচড়ানো আফসোস হবে। কিন্তু এখন তো সেটা পসিবল নয়। মানুষ একটা ভুলে, অসামঞ্জস্যে ভরা যন্ত্র। ভিক্টিম অব হিজ ওন থট, ডিজ্যায়ার, মর্যালিটি অ্যান্ড সেন্টিমেন্ট।
সুদীপ ঠিক করল বাড়ি ফিরে যাবে। কাল ক্লাস করেই। রাতে। বাবা নিশ্চয়ই বারান্দার আলোটা জ্বেলে গেছে এবারও। বাবার ভীষণ সাপের ভয়।