Skip to main content

 

007.jpg

 

গীতায় মানুষের চিত্তের দু ধরণের সম্পদের কথা লেখে। সদগুণ সম্বলিত দৈবী সম্পদ আর অসদগুণ সম্বলিত আসুরিক সম্পদ। পাশ্চাত্য প্রাচীন দর্শনে যা ভার্চু আর ভাইস নামে আলাদা করা হয়েছিল। আসুরি সম্পদের প্রধান অবগুণগুলো হল - অহংকার, বিদ্বেষ, স্বৈরাচার, স্বার্থপরতা এবং সর্বোপরি অন্যের যাতনার কারণ হওয়া। বলাবাহুল্য দৈবী সম্পদ এর বিপরীত।

সেই দিক থেকে দেখতে গেলে গোটা বিশ্বে ধীরে ধীরে আসুরি সম্পদের দৌরাত্ম্য ক্রমবর্ধমান। পুরাণ মানুষের ফ্যাকচুয়াল ইতিহাস অবশ্যই নয়, কিন্তু চৈত্তিক ইতিহাস তো বটেই। সেখানে দেবতা ও অসুরের চিরকালীন লড়াইয়ের গল্পগুলো তো শুধুই রূপক। আসল ময়দান তো আমার চিত্ত। দুই সম্পদের লড়াই প্রভাব বিস্তারের জন্য, আধিপত্য স্থাপনের জন্য।

গতকাল অস্ট্রেলিয়াতে প্রায় ৮ হাজার জনের একটা মিছিল বেরিয়েছে, যার উদ্যোক্তারা হল নয়া নাৎসি বাহিনী। এদের প্রতিষ্ঠা ২০১৬ সালে। যাদের মূল উদ্দেশ্য হল অস্ট্রেলিয়াকে কেবল মাত্রই সাদা চামড়ার দেশ করে রাখা। সমকামিতা, উন্মুক্ত ইমিগ্রেশন ইত্যাদি নীতির বিরোধিতা করা। যাদের মূল অনুপ্রেরণা হিটলার। যারা হিটলারের স্বস্তিক চিহ্ন ব্যবহার করে। এমনকি নাৎসি স্যালুট বলতে যা বোঝায়, সেই একটা হাত সুপারম্যানের মত এগিয়ে দিয়ে, তেমনই কিছু একটাও তারা করে। এমনকি হিটলারের মত তারাও তীব্র ইহুদি বিরোধী।

দেশের সরকার এদের বিরুদ্ধে নরমে গরমে কথা বলে। ক বছর আগে যেখানে মাত্র ৮০ জনকে নিয়ে র‍্যালি হয়েছে, এবং যাদের সিডনি প্রবেশ থেকে বিরত করা গেছে, তারাই গতকাল ৮০০০ সংখ্যায় রাস্তায় নেমে প্রবল তাণ্ডব চালিয়েছে। এবং সরকার অবশ্যই নিন্দা করেছে। এই ফেব্রুয়ারিতে এদের বিরুদ্ধে আইনও পাস হয়েছে। ওসব চিহ্ন দেখালে বা স্যালুট করলেই সোজা হাজতে।

এই সংগঠনের বিদ্বেষের অফিশিয়াল তালিকায় ভারতীয়দের নামও আছে। অন্যান্য বহিরাগতদের মত ভারতীয়রাও তাদের দেশে এসে নাকি সংহতি, ঐক্য, সংস্কৃতির পক্ষে একটা দুরূহ সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। “এত ভারতীয় কেন?” এই নিয়েও প্ল্যাকার্ড বের করা হয়েছে।

ইদানীং সারা পৃথিবীর নানা দেশেই এই বিদ্বেষের সংঘাত বাড়ছে। ধর্মীয় বিশ্বাসের গোঁড়ামি আর গায়ের রঙ - এই দুই-ই তো মানুষ সভ্যতার ইতিহাসের পাঁচিল তোলার মূল সরঞ্জাম জুগিয়েছে। আজ সে সরঞ্জামের উৎপাদন দুশ্চিন্তাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিদ্বেষ এখন রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান, সাহিত্য - শিল্প সর্বত্র নিজের আধিপত্য বিস্তার কর চলেছে। ন্যায্য যুক্তি ধোপে টিকছে না। অন্যায্য যুক্তি “প্র‍্যাগমাটিজম” এর আড়ালে নিজেকে কায়েম করার চেষ্টা করছে। যেমন অস্ট্রেলিয়া অধিবাসীদের বোঝানো হচ্ছে যে তোমাদের নিজেদের ঐক্যের জন্য লড়াইয়ে নামতেই হবে, এসব বহিরাগতদের খেদাতেই হবে। এটাই বাস্তব। একবার যেমন নিউজ টাইমস প্রমাণ করেছিল গবেষণা করে কেন কালো চামড়ার মানুষেরা কম বুদ্ধিমান সাদা চামড়ার থেকে ইত্যাদি ইত্যাদি।

মুশকিল হল স্বার্থকেন্দ্রিক বাস্তবতা যত স্পষ্টভাবে নিজেকে জলজ্যান্ত, অকাট্য প্রমাণে জাহির করতে পারে, বিবেচনা কেন্দ্রিক বাস্তবতা তা পারে না। কারণ তার জন্য সময় লাগে। আজকের পরিবেশ দূষণ, ক্ষয় নিয়েও যাবতীয় সমস্যা এই একই কারণে। সেখানেও স্বার্থকেন্দ্রিক বাস্তবতায় যেমন নগদ লাভ হাতে হাতে গরমাগরম পাওয়া যায়, বিবেচনা কেন্দ্রিক বাস্তবতা তো অনেকটা দূরের। গাছ কেটে ফেললে, পুকুর বুজিয়ে দিলে আমার যে আশু লাভ স্বার্থকেন্দ্রিক বাস্তবতার আয়নায় প্রতিফলিত হয় স্পষ্ট, এর বিপরীত কাজটা করলে আদৌ কী লাভ হবে, বা হবে না, সে বুঝব কী করে? অগত্যা কাটো গাছ, বোজাও পুকুর।

তার উপর হয়েছে এই ভীষণরকম পোলারাইজড সামাজিক মাধ্যম। যারা সমান্তরাল বাস্তবায়নের রাস্তায় আমাদের ইতিমধ্যে নামিয়ে এনেছে। ভীষণভাবে মেরুকৃত, একপেশে, একান্তবাদী ন্যারেটিভে মস্তিষ্ক প্রক্ষালনেও তারা উল্লেখযোগ্যভাবে সফল। আমার এই পোস্ট আদৌ থাকবে কিনা, কিম্বা থাকলেও কতজনের কাছে পৌঁছাতে দেবে সে নিয়েও আমি যথেষ্ট সন্দিহান।