Skip to main content

 

333.jpg

 

বাঙালিকে রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন একজন অ্যাবস্ট্র‍্যাক্ট ভগবান। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ দিয়েছিলেন কংক্রিট ভগবান, মা।

রবীন্দ্রনাথের দর্শনে, বিশেষ করে গানে বাঙালি যে অন্তর্যামী, জীবনস্বামী, ভুবনেশ্বরকে পেয়েছে, তাঁর রূপ নেই। মাধুর্য আছে। এ নতুন কিছু না অবশ্য। বাঙালি তার আগে বাউলের গানে, দর্শনে ইতিমধ্যে এ স্বাদ পেয়েছিল। কিন্তু সেখানে সে নিরাকার মাধুরীর সঙ্গে একটা দূরত্ব ছিল। বাউল ছিল এক ভিন্ন সম্প্রদায়। তাই সে ঘরের লোক হয়ে ওঠেনি। রবীন্দ্রনাথ সে নিরাকার মাধুর্যকে ঘরের লোক করে তুললেন। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ যেমন মা কালীকে করে তুললেন ঘরের লোক। স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ ও মা সারদা হলেন সচল কালী। জ্যান্ত দুর্গা। অর্থাৎ ভগবান আর অ্যাবস্ট্রাক্ট রইলেন না। হলেন এক্কেবারে মূর্ত। শিবজ্ঞানে জীবসেবা বলে যে আদর্শটা বিবেকানন্দ বাঙালির মধ্যে আনতে চাইলেন সেটা যদিও জনপ্রিয় হল না। কিন্তু, সচল ভগবান কনসেপ্টটা জনপ্রিয় হল। সেবা স্তিমিত হল, পুজো আড়ম্বর বেড়ে উঠল। বাঙালি রবীন্দ্রনাথের অ্যাবস্ট্রাক্ট আর রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের “মা” - এই দুই কনেসেপ্টেই ভাবুক হল।

মা। বেদান্ত না। তন্ত্র না। পুরাণ না। বাঙালির নিজের মা। তাঁর সঙ্গে তন্ত্র-মন্ত্রের যোগ থাকতে পারে। কিন্তু সেটা বড় কথা না। বড় কথা সে বাঙালির প্রাণের ডাক - মা। এই মা ডাক এমন প্রধান ডাক হয়ে উঠল, যে দেখা যায় রামকৃষ্ণোত্তর যুগে খুব গোঁড়া বৈষ্ণব নন, অথচ বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করছেন যেমন ওঁকারনাথ ঠাকুর প্রমুখের প্রচারেও “মা” ডাক স্থান পাচ্ছে শুধু না, মায়ের মন্দিরও হচ্ছে।

এর আগেও বাঙালির গানে মা ডাক এসেছে। রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, প্রেমিক প্রমুখের গানের মা-ও শাস্ত্রের মা নন, প্রাণের ডাকের মা। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সে তত্ত্বকে মাটির মূর্তির মা থেকে সচল “মা” করে তুললেন। শ্রীরামকৃষ্ণ হয়ে উঠলেন মা কালীর অবতার। কীভাবে?

সেদিন কালীপুজো। ঠাকুর অসুস্থ। কিন্তু ঠাকুরের ইচ্ছাতেই কালীপুজোর আয়োজন হয়েছে। পুজোর সামগ্রী এসে গেছে সব। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হচ্ছে। ভক্তেরা ঠাকুরকে ঘিরে বসে আছেন। কিন্তু কী করবেন বুঝতে পারছেন না। ঠাকুরও স্থির বসে আছেন। এমন সময় এক ভক্ত উঠে গিয়ে ঠাকুরের পায়ে ফুল দিয়ে পুজো শুরু করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুর সমাধিস্থ। বরাভয় মুদ্রায় দাঁড়িয়ে। সবাই তখন ঠাকুরের শরীরেই মায়ের আবির্ভাব জেনে পুজো শুরু করলেন। এখানে আরো পরে ঠাকুরের কল্পতরু হওয়ার ঘটনাও উল্লেখ্য, যেখানেও ঠাকুরের শরীরকে অবলম্বন করে মায়ের আবির্ভাবের কথা আছে।

এগুলো সব ডক্যুমেন্টেড ঘটনা। “কথামৃত” বাঙালির ঘরে ঘরে মা'কে প্রতিষ্ঠিত করল ঠাকুরের অমৃতবাণীকে অবলম্বন করে।

বাঙালির প্রাণের শাস্ত্র এখন দুটো - গীতবিতান আর কথামৃত। অ্যাবস্ট্রাক্ট ভগবান আর কংক্রিট ভগবান। দুইতেই বাঙালি তার প্রাণের আরাম খুঁজে পায়। সান্ত্বনা পায়। আরাম পায়। আশ্বাস পায়। আগে অবিশ্যি বাঙালির “চৈতন্যচরিতামৃত” ছিল। কিন্তু এখন সে সম্প্রদায়ের বই হয়ে গিয়েছে। আপামর বাঙালি সেটা পড়ে না। গীতবিতান আর কথামৃত হল অনেকটা সেকুলার পরা-আনন্দের সম্পদ। যদিও কথাটা একটা অক্সিমোরনের মত শোনালো। তবু এটাই বাস্তব। এই দুইয়ের মধ্যে তুলনা করলে গীতবিতান একটু বেশি সেকুলার।

বাংলা ভাষা যেদিন কী একটা ভাষার তকমা পেল বলে খবর হল। সেদিন আমার মনে হয়েছিল, চৈতন্যচরিতামৃতের কথা। আপামর হিন্দিভাষীর ‘রামচরিতমানস’ আর আমাদের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’র বয়সের পার্থক্য খুব বেশি না। কিন্তু হিন্দিভাষীরা সে বইটাকে তাদের প্রাণের সম্পদ করে রেখেছে। আজও উত্তর ভারতের নানা জায়গায় তার পাঠ হচ্ছে। ব্যাখ্যা হচ্ছে। নিত্য। তাদের অন্তত কিছু কিছু চৌপাইও মুখস্থ। আর আমাদের? ওসব ছেড়ে গেছে। ধর্মীয় গ্রন্থ কি শুধু ওটা? কী অসামান্য কাব্য সেটাও কী অনায়াসে ভুলে গেলাম আমরা। ভাষা ভাবকে দ্রবীভূত করে। স্নিগ্ধ করে। রামচরিতমানস যেমন তা পারে। চৈতন্যচরিতামৃতও তা পারে। কিন্তু কই, সেটা যে আমার ভাষার ঐতিহ্য, তাকে সেভাবে সম্মান দিয়ে ধরে থাকলাম কই? এমন একটা বই যখন শুধু সম্প্রদায়ের বই হয়ে ওঠে তখন মুখ্য আর গৌণ স্থান বদল করে। সঙ্কীর্ণ ব্যাখ্যা প্রবল হয়ে ওঠে সম্প্রদায়ের কৌলিন্য আর শুচিতা রক্ষার দায়ে। তার উদারতার দিক নিয়ে আর কেউ কথাও বলে না। ক্রমে লোকের বিশ্বাস হয় ওটা একটা অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীর কাব্য। ক্ষতি কাব্যের হয় না, আমাদের পরম্পরার হয়। ছিন্নমূল হই।

যা হোক, বাঙালির তো ভোলার ক্ষমতা সাংঘাতিক। নইলে ছোটোবেলায় উদযাপিত বিজয়া উৎসব, যা এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যাতায়াতের আনন্দ উৎসব ছিল, তা মাত্র এ কটা দশকেই শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক বিজয়া সন্মিলনী হয়ে উঠতে পারে? আমরা বড় সহজে ছেড়ে দিই।

এক যুগে বাঙালির শাক্ত বৈষ্ণবের দারুণ কোন্দল ছিল। যে যাকে যতটা পারে হীন দেখাত। যে যতটা পারে নিজেকে নির্ভুল দেখাত। এখন বাঙালির শাক্ত বৈষ্ণবের সেই লড়াইটা রাজনীতির ময়দানে এসেছে। সোশ্যাল মিডিয়া চণ্ডীমণ্ডপ হয়েছে। রাতদিন চলছে হইহই রইরই। গালিগালাজ, ব্যঙ্গবিদ্রুপের বিরাম নেই। পক্ষ-বিপক্ষ হওয়ার রাতদিন মিউজিক্যাল চেয়ার খেলা চলছে।

কিন্তু এ সবের মধ্যে বাঙালি একটা অভূতপূর্ব চরিত্রকে পেয়েছে মা। যে কথাটা দিয়েই এ লেখার ইতি টানি। মা সারদা। সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে, শাস্ত্রীয় বিধানকে শিথিল করে শুধুমাত্র মানবধর্মকে সম্বল করে একজন তথাকথিত অশিক্ষিত গ্রাম্য নারী কী করে “মা” হয়ে ওঠেন, এ এক বিস্ময়। বাঙালি চৈতন্যদেবের মধ্যে যে সঙ্কীর্ণতা ভাঙার ডাক শুনেছিল, আধুনিক যুগে মায়ের মধ্যেও সে-ই ডাক। তবে ভীষণ স্নিগ্ধ। শান্ত। ঘরের ভিতর থেকে ডাক। এমনকি ধর্মীয় অনুসঙ্গ পর্যন্ত মুক্ত। শ্রীরামকৃষ্ণ যে মা'কে সাধনায় অনুভব করেছিলেন, সে-ই মা'কে রক্তমাংসের শরীরে স্থাপন করেছিলেন ফলহারিনী কালীপুজোর দিন রাতে। রামকৃষ্ণদেব চোখের আলোর বাইরে গেলেন। স্বামীজী গেলেন। মা রয়ে গেলেন। এতটুকু ভাঙলেন না। বিহ্বল হলেন না। স্থির দাঁড়িয়ে রইলেন। আশ্রয় হলেন গৃহী সন্ন্যাসী উভয়ের। সেদিন মহাপ্রভু দিয়েছিলেন মহামন্ত্র, কৃষ্ণ নাম। ঠাকুর দিলেন “মা” মন্ত্র। মায়ের নাম। মা সারদা সে নামে প্রাণ সঞ্চার করলেন। আত্মসঞ্চার করলেন।

এ যুগ তড়িঘড়িতে সব পাব, এমন ভাবধারার যুগ। আমাদের হতাশা বিষাদ হুশ করে আসে। আমাদের ধৈর্য্যচ্যুতি পদে পদে হয়। আমাদের রাগ মুহুর্মুহু হয়। ক্রমে রাস্তা হারাই। ক্রমে নিজেকে হারাই। কে ফেরাবে আবার? মা ফেরাবেন। মায়ের জীবনী ফেরাবে। মায়ের অস্তিত্ব ফেরাবে আমাদের আবার রাস্তায়। সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে শুধুমাত্র মায়ের দিকে তাকিয়েই রাস্তা পাওয়া যাবে। দিনের শেষে যখন মনে পড়বে দক্ষিণেশ্বরের ওইটুকু ঘরে একজন “আনন্দঘট” স্থাপন করেছিলেন নিজের হৃদয়ে, তখন নিজের ঘরের দেওয়াল আরো প্রসারিত হবে। দিনের শুরুতে যখন মনে পড়বে জয়রামবাটির মত এক ক্ষুদ্র অখ্যাত গ্রাম কী সাধনায় বিশ্বের অন্যতম তীর্থস্থান হয়ে উঠল, তখন মায়ের প্রসন্ন শান্ত মুখটাই মনে পড়বে, চিত্তশুদ্ধি হবে। রাস্তা পাবে দিশাহারা প্রাণ। যে রাস্তা উদার। শান্তিদায়ী। আনন্দদায়ী। সামর্থ্যদায়ী। সার্থকতাদায়ী।